বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক প্রাণী মশা: তবুও কেন সব মশা নিধন নিয়ে বিতর্ক আছে!
দেখতে ছোট্ট, সাদাসিধা একটি প্রাণী; কিন্তু এর একঘেয়ে পোঁ পোঁ শব্দ আমাদের কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং একইসঙ্গে প্রাণীটি প্রাণঘাতী হিসেবেও বিবেচিত। সন্ধ্যা না হতেই বিনা আমন্ত্রণের অতিথির মতো যে প্রাণীটি আমাদের ঘরে এসে জুটে তা হলো মশা। হুল ফুটিয়ে কামড়ের মাধ্যমে এরা ভাইরাস এবং পরজীবী ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, চিকুনগুনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন মশাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী হিসেবে অভিহিত করেছে এবং মশার কামড়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে।
রক্তচোষক এই প্রাণীটি যে মানুষের বেজায় অপছন্দ তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং পৃথিবী থেকে মশা দূর করতে পারলে যে কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচবে এবং একটা বড় যন্ত্রণার উৎস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সেটিও নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
কিন্তু আমরা কি সত্যিই সব মশা দূর করতে পারবো? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
কিছু মশা উপকারীও হতে পারে
প্রথমত, এখানে সমস্যাটা হচ্ছে 'সব' শব্দটি নিয়ে। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৩ হাজারেরও বেশি প্রজাতির মশা চিহ্নিত করা গেছে। "জীব ও তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের আন্তঃসম্পর্ক বিবেচনায়, প্রতিটি মশার ধরনই আলাদা আলাদা হয়; এগুলো কোথায় থাকে, মানুষকে কামড়ায় নাকি ব্যাঙকে কামড়ায় নাকি পাখিদের কামড়ায়। কোন ধরনের মশা নিয়ে কথা বলছি সে অনুযায়ী এই চক্র ভিন্ন ভিন্ন হয়", বলেন লুইজিয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টেন হিলি।
ক্রিস্টেন হিলি একইসঙ্গে আমেরিকান মসকুইটো কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তিনি লুইজিয়ানাকেই উদাহরণ হিসেবে দেখান, কারণ এ অঞ্চলে প্রচুর জলাভূমি রয়েছে যেগুলো মশার আদর্শ বাসস্থান। হিলি বলেন, "এই মশাগুলো হয়তো জলাভূমির পানির মধ্যে মাছ এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হয়তো আরও অনেক ছোট প্রাণী রয়েছে যারা পূর্ণবয়স্ক মশাকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।"
একইভাবে অন্যান্য মশাও হয়তো তাদের আবাসভূমিতে একই ধরনের ভূমিকা রাখে। তাই মশা সম্পূর্ণ নির্মূলের কিছু বিরূপ প্রভাব তৈরি হতে পারে। সেইসঙ্গে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন- পৃথিবীতে মশার জনসংখ্যা এত বেশি যে কোনোদিনই মশা সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়।
আর আমাদেরও সব ধরনের মশা নির্মূলের প্রয়োজনও নেই।
যে মশাগুলো আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত, যেগুলোর কামড়ে শরীরের নানা অংশ ফুলে ওঠে, চুলকানি হয় এবং গুরুতর রোগ হয়- সেগুলোর সংখ্যা আসলে কম।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক লরা হ্যারিংটনের ভাষ্যে, "মশা সম্পূর্ণ নির্মূল করলে খাদ্য শৃঙ্খলের উপর একটা প্রভাব পড়বে। তবে একটা বা দুটো প্রজাতি নির্মূল করলে তেমন প্রভাব পড়বে না।"
সমস্যাটা তাহলে কাদের নিয়ে?
এডিস, অ্যানোফিলিস এবং কিউলেক্স মশাই মূলত মানুষের শত্রু। এই গোত্রের সবগুলো প্রজাতিই একাধিক ভাইরাস বা পরজীবী বহন করতে পারে। অ্যানোফিলিস ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়, কিউলেক্স মশার কারণে ফাইলেরিয়া রোগ ছড়ায় এবং শুধু এডিস মশা থেকেই চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ও ইয়েলো ফিভারের মতো ভাইরাসজনিত রোগ ছড়ায়।
আমাদের বাস্তুসংস্থানে এই মশাগুলোর প্রয়োজন নেই।
"এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস অ্যালবোপিকটাসের মতো রোগ-সংক্রমণকারী মশার প্রজাতি বিশ্বের বিভিন্ন অংশে প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে... এগুলো ছাড়াই আমরা ভালো ছিলাম", বলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োস্ট্যাটিসটিকস ও এপিডেমিওলজি বিভাগের অধ্যাপক জন মার্শাল।
"পৃথিবীতে হাজার হাজার প্রজাতির মশা আছে, যার মধ্যে মাত্র কয়েকটি প্রজাতি রোগজীবাণু বহন করে। তাই রোগ সৃষ্টিকারী প্রজাতিগুলোকে যদি নির্মূল করা হয়, তবেই রোগ-সৃষ্টিকারী নয় এমন প্রজাতির মশারা বাস্তুসংস্থানে টিকে থাকতে পারবে", বলেন তিনি।
মার্শাল যোগ করেন, "ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকেই রোগ সৃষ্টিকারী মশা নির্মূল করা হয়েছে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে মশা নিধন অবশ্যই সম্ভব।"
এই যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কিউলেক্স মশা। বাড়িঘরে সাধারণত এই মশাই বেশি দেখা যায় এবং এটি নিধনের জন্যও চলছে জোর প্রচেষ্টা। তবে কিউলেক্স মশা প্রথমে কোনো পাখিকে কামড়ায়, এরপরে মানুষকে কামড়ালেই বিপদ, কারণ সেখান থেকেই তারা ওয়েস্ট নিল ভাইরাস নিয়ে আসে। কিন্তু লার্ভা এবং শূককীট অবস্থায় এই মশা দূষিত পরিবেশে, নোংরা বদ্ধ পানিতে, আবদ্ধ জলাশয়ে বা নর্দমায় বাস করে।
আরও যে প্রজাতির মশা নিধনের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ, সেগুলো বাড়ির পেছনে বা আশেপাশেই থাকে। বদ্ধ কন্টেইনার, টায়ারে বা পানি জমে থাকলে এই মশা সেখানে বাঁসা বাধে।
কিন্তু এই মশাগুলোর বাস যেসব জায়গায়, সেই বাস্তুসংস্থানে এমন কিছু থাকে না যাতে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতি হতে পারে। তাই এ প্রজাতির মশা নিধনে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে না, বলেন হিলি।
তবে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী অ্যানোফিলিস মশা আবার জলাভূমিতে থাকতে বেশি পছন্দ করে এবং সেখানকার বাস্তুসংস্থান আরও বৈচিত্র্যময়।
"ওখানে যদি মশার লার্ভা ধ্বংস করতে চান, তাহলে আপনাকে আগে চিন্তা করতে হবে কি ব্যবহার করছেন এবং তা পরিবেশের উপর কি প্রভাব ফেলবে", বলেন তিনি।
আমরা যেভাবে চেষ্টা করছি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের জন্য বা বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর, এমন রাসায়নিক ব্যবহার করার দিন ফুরিয়েছে। এখন মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও উন্নত হয়েছে।
যেমন, এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির মশাকে জীবাণুমুক্ত করার একটি টুল হিসেব 'উলবাকিয়া' কৌশলের মাধ্যমে কিছু সফলতা পাওয়া গেছে। এটি এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া যা মশার রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা কমায়। এর একটি পদ্ধতি হলো, পুরুষ মশার ভেতরে এই ব্যাক্টেরিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যেসব ভাইরাস দ্বারা জিকা, ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার এবং চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ হয়ে থাকে, এডিস ইজিপ্টাই মশার ভেতরে সেই ভাইরাস রেপ্লিকেট হওয়া প্রতিহত করে এটি।
ভাইরাসবাহী মশা যেন বংশবিস্তার করতে না পারে তার জন্য জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও, অপরিণত মশা নিধনে অ-রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে- যেমন, গাপ্পি মাছ ছেড়ে দিয়ে মশার লার্ভা খাওয়ানো; আবার ড্রোন ব্যবহার করে কোনো স্থানে নোংরা পানি জমে আছে কিনা তা খুজে বের করে পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা।
কিন্তু মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যে এখনও জিততে পারেনি মানুষ তা অস্বীকারের উপায় নেই।
হ্যারিটন বলেন, "এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু মশাদের মৌলিক জীবতত্ত্ব এবং তাদের আচরণ সম্পর্কে আমরা এখনও তেমন কিছু জানিনা, সেজন্যেই মশা নির্মূলের কার্যকর উপায় বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে।"
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন এবং সহজলভ্য ও সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় এমন টুল উদ্ভাবন করতে হবে।"
তাছাড়া, মশা নিধন সম্পর্কে সঠিক শিক্ষাও দরকার। সঠিকভাবে স্প্রে ব্যবহার করতে না পারার ফলে অন্যান্য পোকামাকড়ও মারা যায়।
আমাদের করণীয় কী?
মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রজাতির মশা নির্মূল করা কি আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। কিন্তু অনেক সময় লাগবে।
আপাতত, নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করতে পারেন মশার উপদ্রব থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকতে:
- স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইটে দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলুন।
- সম্ভব হলে বাইরে বের হওয়ার সময় ঢিলেঢালা, লম্বা হাতার জামা এবং লম্বা প্যান্ট পরুন।
- মশা যেন ঘরে ঢুকতে না পারে সেজন্য দরজা-জানালায় নেট ব্যবহার করতে পারেন।
- সপ্তাহে একদিন নিজের বাড়ির আঙিনা ও আশেপাশে পরিষ্কার করুন। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে তা লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বাড়ির আশেপাশে ময়লা কন্টেইনার, বালতি বা ক্যান ফেলে রাখা যাবে না।