‘সহজাতভাবে শেখা’: মহাকাশবিজ্ঞান ও শিল্পকলা নিয়ে গবেষণা করা এমআইটির মিজানুল চৌধুরী
২০১১ সালে জাপানের স্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জাক্সা) আয়োজিত এশিয়া-প্যাসিফিক স্পেস রোবট প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা কিবো-আরপিসিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। এর মধ্যদিয়ে প্রথম দক্ষিণ এশীয় দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) জাপানি মহাকাশ কর্মসূচির সঙ্গে সহযোগিতা করার সুযোগ পায় বাংলাদেশ।
এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এর মূল কারিগর বহুদিন ধরেই এ কাজের প্রস্তূতি নিচ্ছিলেন।
আসুন আমরা মিজানুল এইচ চৌধুরীর কথা জানি। তিনি ২০১৩ সাল থেকে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) একাধিক পদে কর্মরত।
বর্তমানে তিনি এমআইটিতে নাসার 'অ্যাস্ট্রোবি' বিজ্ঞানী। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানের স্পেস সিস্টেম ল্যাবরেটরির স্থপতি এবং চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরও তিনি।
২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি এমআইটি লিংকন ল্যাবরেটরির স্পেস সিস্টেম ডিভিশনে স্যাটেলাইট সায়েন্টিস্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
তার কর্মজীবন বর্ণাঢ্য। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) পরিচালিত তিনটি স্পেস রোবটের গ্রুপ 'অ্যাস্ট্রোবি'র হার্ডওয়্যার ডিজাইন ও অটোমেশনের ক্ষেত্রেও মিজানুল অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এমআইটির 'জিরো রোবোটিক্স' প্রকল্পের প্রধান হিসেবে তার দল, মধ্য ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মহাকাশ প্রযুক্তি সংক্রান্ত জটিল সমস্যার সমাধানে প্রস্তুত করে।
এই অর্জনগুলোর ফলেই বাংলাদেশ দল জাপানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পায়।
শিক্ষার্থীরা তার তত্ত্বাবধানে অ্যাস্ট্রোবি রোবটের মাধ্যমে মহাকাশে পাঠানোর জন্য সফলভাবে একটি বার্তা প্রোগ্রাম করেছিল।
প্রথম চেষ্টাতেই তারা 'আমার সোনার বাংলা' বার্তা পাঠিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার মতো বড় দেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বাংলাদেশ।
এই স্মরণীয় অর্জনে মিজানুল এবং তার সংস্থা এসটিইএমএক্স৩৫৬- বাংলাদেশ দলের পরামর্শক ছিল এবং এখনও অবধি তিনি এই কাজ করে যাচ্ছেন।
মিজানুলের সঙ্গে কথোপকথনের সময় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছাড়াও, তার চরিত্রের আরও কয়েকটি দিক সম্পর্কে জানতে পারে।
মনেপ্রাণে একজন শিল্পী
তিনি খুব আবেগ নিয়ে বলেন, 'অনলাইন গ্যালারি ছিল আমার প্রথম ওয়েবসাইট, ২০০০ সালের গোড়ার দিকে আমি এটির ডিজাইন করেছিলাম। সেই সময়ে আমি নিজে নিজে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও অন্যান্য বিষয় শিখছিলাম।'
শহুরে ল্যান্ডস্কেপ, বিমূর্ত চিত্রকলা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার বিভিন্ন শিল্পকর্ম রয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমি প্রকৃতির দেখানো পথেই চলি। আমি মনে করি বৈজ্ঞানিক কোনো মডেলের ডিজাইন, সৃজনশীল কিছু করার চেষ্টা এবং চিত্রকলার মধ্যে গভীর সাদৃশ্য রয়েছে।'
ইউটিউবে তার নাম সার্চ করলেই, এই শিল্পীর সম্পর্কে আরেকটি বিশেষ তথ্য জানা যায়- তা হলো সুরের প্রতি তার ঝোঁক।
মান্না দে'র গান গাইতে খুব ভালোবাসেন মিজানুল।
অ্যাস্ট্রোবি, জিরো রোবোটিক্স
জিরো রোবোটিক্স একটি এমআইটি প্ল্যাটফর্ম, যা আইএসএস-এ মধ্য থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রোবটের সঙ্গে কোডিং ও প্রোগ্রামিং শেখায়।
কিন্তু কীভাবে তিনি শিশুদের এই কাজে আগ্রহী করলেন? উত্তর হলো গেমিংয়ের মাধ্যমে।
শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করার অংশ হিসেবে আইএসএস-এ রোবট চালনা করতে প্রোগ্রামিং ব্যবহার করে।
মিজানুল বলেন, কোডভিত্তিক স্পেস-গেমিংয়ের জন্য শিশুদের প্রস্তূত করা জটিল একটি কাজ।
এর স্থপতি ও সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে, মিজানুল মেন্টরিং এবং প্রোগ্রামিং স্পেস গেমগুলোর পাশাপাশি একটি অনলাইন সিমুলেশন পরিবেশ বজায় রাখেন।
তিনি বলেন, 'বৃহৎ পরিসরে আমরা স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। যাতে তারা স্কুল ছাড়ার আগেই কোডিং, সমস্যা সমাধান এবং নেতৃত্ব ও দলবদ্ধভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে ওঠে।'
২০২২ সাল থেকে প্রকল্পটি অ্যাস্ট্রোবিরোবটসের সঙ্গে মিলে কাজ করছে।
অ্যাস্ট্রোবি রোবট কি?
অ্যাস্ট্রোবি হলো এক থেকে তিন ধাপ বিশিষ্ট আমেরিকান সাউন্ডিং রকেটের সিরিজের নাম। এগুলো তিনটি ঘনক্ষেত্র আকৃতির রিচার্জেবল উড়ন্ত রোবট [বাম্বল, হানি ও কুইন]।
আইএসএস-এ নিয়মমাফিক রক্ষণাবেক্ষণ, ডকুমেন্টেশন এবং শ্রমসাধ্য কাজগুলো করার জন্য এগুলো তৈরি করা হয়েছে। যাতে মহাকাশচারীরা মহাকাশ গবেষণার মতো জটিল কাজগুলোতে মনোনিবেশ করতে পারেন।
রোবটগুলো নিজে নিজে চলতে পারে। আবার নভোচারী বা স্থলভাগের গবেষকদের দ্বারা দূর থেকে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
কিবো-আরপিসি বা জিরো রোবোটিক্সের মতো সৃষ্টির মাধ্যমেও এগুলোই করা হয়।
মিজানুল অনলাইন ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মটির উন্নয়ন ও ডিজাইন করেছেন। এটি অ্যাস্ট্রোবি ও এর পূর্বসূরী এসপিএআরএসের কাজকর্ম ও গবেষণায় সহায়তা করে।
তিনি বলেন, চূড়ান্ত পরিকল্পনা ছিল মহাকাশে মানুষের পরিমাণ কমানো। 'রোবটগুলো অনেক দূর পরিভ্রমণ করবে এবং নভোচারীরা নিরাপদ জায়গা থেকে তাদের গাইড করবেন।'
বুয়েট থেকে এমআইটি: এক অদ্ভুত যাত্রা
মিজানুল চৌধুরী ১৯৮৬ সালে বুয়েট থেকে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে, কয়েক বছর তিনি প্রথমে পেট্রোবাংলা এবং পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রকৌশলী হিসেবে পেশাগত জীবন কাটান।
১৯৯৩ সালে টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যাচারাল গ্যাস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি টেক্সাসের গ্রামে ভালভ ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন।
তবে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাকরির সুযোগ তেমন একটা ছিল না। তাই তাকে বিকল্প পেশার কথা ভাবতে হয়েছিল।
ভালভ ইঞ্জিনিয়ারের ক্যারিয়ারে তিনি যে সামান্য প্রোগ্রামিং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, তা দিয়ে মিজানুল অবশেষে একটি সাহসী পদক্ষেপ নেন।
তার প্রথম আইটি কাজ ছিল আমেরিকান এয়ারলাইন্সে, সেখানে তার কাজ ছিল মূলত বিদ্যমান সফ্টওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত। অবসর সময়ে তিনি নিজে নিজে কম্পিউটারে দক্ষতা বাড়াচ্ছিলেন।
২০০৭ সালের মধ্যে কম্পিউটারে তার দক্ষতা এত বেড়ে যায় যে তিনি জেরিকো সিস্টেমগুলোতে কাজ করার সুযোগ পান। এটি এমন একটি সংস্থা, এটি সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের অংশীদার।
মেশিন সচল রাখা
মিজানুল যখন অবসর সময় কাটাচ্ছেন, তখনও তিনি কোনো না কোনো ডিজাইনের কথা ভাবছেন, কিংবা ছবি আঁকছেন বা নতুন প্রচ্ছদ তৈরি করছেন।
এখন তার বয়স ৬০ বছরের কিছু বেশি। তবু এখনও নতুন কিছু শেখার জন্য তার আগ্রহের সীমা নেই।
তার প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশে যেসব শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি।
তিনি বলেন, 'স্পেস রোবটিক্সে অংশগ্রহণের দিক থেকে এমআইটির শিক্ষার্থীদের চেয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে।'
তাই এসটিইএমএক্স৩৬৫ বর্তমানে মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রোগ্রামিংয়ের ওপর বিভিন্ন সেশন, ভার্চুয়াল ল্যাব এবং কোর্স করায়।
তাদের ফেসবুক পেজে সবগুলো টিউটোরিয়াল ও ট্রেনিং সেশনের ভিডিও আছে।
তিনি বলেন, 'আমরা আন্তর্জাতিক স্পেস প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখব।'
মিজানুল এই প্রজন্মের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিভা সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী। তবে তিনি বহুদিন ধরে চলে আসা বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও এই বিষয়গুলো তরুণদের মনের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
তিনি বলেন, 'ক্লাসে র্যাংকিংয়ের ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমি আমেরিকায় এরকম কিছু দেখি না। বাংলাদেশে এখনও এ ধরনের প্রথা আছে, তা মেনে নিতে কষ্ট হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'স্টেম শিক্ষা হোক বা মহাকাশ বিজ্ঞান- সবই পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়। প্রতিযোগিতা থেকে অল্প কয়েকজন মানুষ উপকৃত হতে পারে, তবে সহযোগিতার সুবিধা সবাই পায়। আমাদের এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীরা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে, দলবদ্ধভাবে কাজ করবে এবং একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করবে না।'
মিজানুল আরও বলেন, 'কারণ এভাবেই সম্পৃক্ত প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে উন্নতি করে, তাই সবার লক্ষ্য এমনটাই হওয়া উচিত।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি