ঢাকার পানি সংকট; সামনে কী?
১২ বছর বয়সী রিতু মনি। ছোট্ট দুটি হাত, অথচ এ দুটি হাত বহন করছে বারবার পানি নেওয়ার কারণে হলুদ হয়ে যাওয়া চারটি ৫ লিটারের খালি বোতল। যদিও এগুলো সে বয়ে নিয়ে যাবে কি না জিজ্ঞেস করা হলে বলেছে, এগুলো নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে লোক আসছে। প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিং সোসাইটির একটি বাড়ির গভীর নলকূপ থেকে পানি নিতে আরও ২০-২৫ জনের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে রিতু। প্রতিদিনই এ এলাকার মানুষ পানি নেওয়ার জন্য বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার রাজধানী ঢাকার এটি প্রতিদিনকার চিত্র। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর চার লাখ নতুন বাসিন্দা ঢাকায় আসে। এ দ্রুতগতির নগরায়ণের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং ক্রমেই নিচে নামতে থাকা পানির স্তর ঢাকার পানির উৎসগুলোকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
ঘরে পানির লাইন থাকা সত্ত্বেও পাইপে পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না বলে জানান লাইনে দাঁড়ানো আরেক নারী রাবেয়া আক্তার। ৩৫ বছর বয়সী এ নারী বলেন, পানির লাইন থেকে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এখানকার গভীর নলকূপটির পানি সরাসারি পান করা যায়, তাই তারা প্রতিদিন এখানে এসে লাইনে দাঁড়ান।
তীব্র তাপদাহের কারণে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রাবেয়ার বাসায় পাঁচ সদস্যের জন্য প্রতিদিন ১৫ লিটার করে পানির প্রয়োজন হয়। আর এ বাড়তি চাহিদা মেটাতে তাদেরকে পানি পানির বিকল্প উৎস খুঁজতে হয়।
রাবেয়ার মতো অনেকেই অন্যের ব্যক্তিগত নলকূপ থেকে পানি নেওয়া ছাড়াও ঢাকায় স্থাপন করা ২৯০টি পানির এটিএম বুথ থেকেও পানি সংগ্রহ করেন। তবে এখান থেকে পানি সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য। কারণ এখানেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয় এবং পানির ভারী বোতল নিজেকেই বহন করতে হয়।
এটিএম বুথের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ ট্যাপ-টু-ড্রিংক ওয়াটার কর্মসূচির অংশ। এ কর্মসূচি ঢাকাবাসীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও চাওয়া ছিল, কিন্তু এটি তাদের জন্য মরীচিকা হয়ে আছে বলেই মনে হচ্ছে। যারা সচ্ছল, বোতলজাত পানি ব্যবহার করা তাদের জন্য একটি বিকল্প হতে পারে, কিন্তু এটি এক প্রকার আর্থিক বোঝাও। শেষ বিকল্প হিসেবে পানি ফুটিয়ে খাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এর জন্যও অর্থ খরচ করতে হয়।
ব্র্যাকের ২০২০ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা শহরে বছরে পানি ফুটিয়ে খেতে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহৃত হয়, তার মূল্য ১৭০ কোটি টাকা। এখন সে মূল্য আরও বেড়ে গেছে।
পানির চাহিদা বাড়ছে
ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শহীদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর গ্রীষ্মকালে পানি ব্যবহারের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত গরমের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে মানুষ কয়েকবার গোসল করছে; বেশি বেশি পানি পান করছে সবাই।
তিনি আরও বলেন, 'সাধারণত গরম আবহাওয়ায় বিগত বছরগুলোতে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ২৬০ মিলিয়ন লিটার পানি লাগে আমাদের। কিন্তু এ বছর ২৮০ মিলিয়ন লিটারের বেশি পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ওয়াসার দৈনিক পানি সরবরাহের সক্ষমতা প্রায় ২৮৫ মিলিয়ন লিটার।'
এদিকে ওয়াসার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন গড় পানির চাহিদা ২৬০ থেকে ২৭০ মিলিয়ন লিটার, সেখানে ঢাকা ওয়াসা দিনে গড়ে ২৭৫ মিলিয়ন লিটারের মতো পানি সরবরাহ করে।
কর্মকর্তারা বলেন, পানির চাহিদা এখনও সরবরাহ সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে না গেলেও কিছু কিছু এলাকায় হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
আর জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে পানির চাহিদা যেকোনো সময় সর্বোচ্চ সরবরাহ সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে শহীদ উদ্দিন বলেন, দিনকে দিন পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সর্বোচ্চ পানি সরবরাহ সক্ষমতা ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়ছে। 'আর গরমের কারণে পানি ওঠানোর কাজে ব্যবহৃত পাম্পগুলোও গরম হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে পাম্পগুলোর কার্যক্ষমতা ঠিক রাখতে ঠান্ডা করার জন্য প্রায়ই এগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে।'
বাড়তি চাহিদার জন্য পানি সরবরাহ সক্ষমতা আরও বাড়ানো সম্ভব কি না—এ প্রশ্নের জবাবে শহীদ উদ্দিন বলেন, চলমান পানির উৎসগুলো থেকে এ সক্ষমতা বাড়ানো আর সম্ভব নয়। তিনি বলেন, 'আমাদের নতুন করে আরও কূপ খনন করতে হবে। কিন্তু জায়গার অভাবে সে কাজও ব্যহত হচ্ছে।'
২০২২ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ঢাকা পরিবেশবান্ধব টেকসই পানি সরবরাহ প্রকল্প।
প্রকল্পটির লক্ষ্য সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পানি সরবরাহ পরিষেবা নিশ্চিত করা ও গুণমান উন্নত করে ঢাকায় পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের প্রচলন বাড়ানো।
এ প্রকল্পের অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—উত্তোলিত পানির অপচয় রোধ, ভূপৃষ্টের পানির উৎসগুলোর ব্যবহার বাড়ানোসহ দাম যৌক্তিকীকরণ ও পানি সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত নদীগুলোকে রক্ষা করা। এগুলোর পাশাপাশি পানি সরবরাহ পরিষেবার মাধ্যমে নারী ও অনগ্রসর গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ছিল অর্থায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোনো প্রতিশ্রুতিই এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি।
সামনে কী?
জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, বাড়ছে তাপমাত্রা, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, কমছে বিশুদ্ধ পানির উৎস ও সহজলভ্যতা—এক কথায় বলা যায়, ঢাকার ওপর দিয়ে যেন ঝড় বইছে। এভাবে আরও ১০ বছর নগরায়ন চলতে থাকলে এসবের মাত্রা আরও বাড়তে থাকবে। ঢাকার পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত।
পানি ও জলাধার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শরীফ জামিল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জীবিকার তাগিদে মানুষের রাজধানীতে আগমন—সবকিছুই নগরায়নকে ত্বরান্বিত করছে।
এসব কারণে পানির চাহিদা আরও বাড়াবে।
অবকাঠামো ও পরিবেশগত পরিষেবা প্রতিষ্ঠান ইসলভ ইন্টারন্যাশলানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ জামান বলেন, সময়ের সাথে সাথে আবহাওয়ার ধরন আরও বেশি অনিশ্চিত হবে।
এতে আরও চাপ পড়বে পানির উৎসগুলোর ওপর।
২০১৪ সালে চূড়ান্ত হওয়া ওয়াটার সাপ্লাই মাস্টারপ্ল্যান ফর ঢাকা সিটি প্রকল্পে প্রাক্কলন করা হয়, ২০৩৫ সালে রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা দাঁড়াবে ৫ হাজার ৪০০ মিলিয়ন লিটার। তখন দৈনিক ৬ হাজার মিলিয়ন লিটার পানি উৎপাদন সক্ষমতার প্রয়োজন পড়বে।
এ চাহিদা মেটাতে ঢাকা ওয়াসা তাদের আওতাভুক্ত এলাকা বাড়ানোসহ কার্যকর চাহিদা ব্যবস্থাপনা কৌশল বাস্তবায়নের চিন্তা করছে। তবে শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নদী দূষণ এ পরিকল্পনাকে ব্যাহত করছে।
তবে ঢাকার ভবিষ্যৎ পানি সংকট পরিমাপ করার আগে জেনে নেওয়া যাক কীভাবে আমরা এ অবস্থায় এলাম।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৪৭ সালের দিকে ঢাকায় মাত্র দুই থেকে তিন লাখের মতো মানুষ বাস করত। এ স্বল্প মানুষের চাহিদা মেটাতে তৎকালীন চকবাজারের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদীর চাঁদনী ঘাট থেকে পরিশোধিত পানি সরবরাহ করা হতো।
১৯৭২ সালের দিকে এ জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে সাত লাখে। এ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য চাঁদনী ঘাটের পক্ষে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
এ কারণে তৎকালীন সরকার বর্ধিত চাহিদা মেটাতে নলকূপ স্থাপন শুরু করে। নলকূপের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা)।
১৯৯৬ সালে ওয়াসাকে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০০২ সালে সায়দাবাদে পানি শোধনাগার বসানো হয়।
এ পর্যন্ত অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুলই রয়ে গেছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি তীব্রমাত্রায় দূষিত হওয়ায় চাঁদনী ঘাটের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
পরিবেশবাদী কর্মী শরীফ জামিল বলেন, 'সায়দাবাদ শোধনাগারের মানও পড়ে গেছে। ট্যানারি থেকে ছড়িয়ে পড়া ক্রোমিয়াম আর তেজগাঁওয়ের মতো শিল্প এলাকা থেকে ছড়িয়ে পড়া পারদ-জাতীয় পদার্থ এ শোধনাগার আটকাতে পারছে না।'
ফলে আগে পাঁচ থেকে আট ফুট গভীরে যে পানি পাওয়া যেত, এখন ১৬০ গভীরে গিয়েও অনেকসময় বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ মাটি পর্যাপ্ত হারে পানি মজুত করতে পারছে না। ফলে কারণে পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছে।
ক্রমেই নেমে যাচ্ছে পানির স্তর
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আসিফ জামান বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া আরও বৈরী হবে; শুষ্ক মৌসুম অত্যন্ত শুষ্ক হয়ে যাবে এবং বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি হবে।' অনাবৃষ্টি বা বন্যা দুটোই মাটির পরিশোধন ও পানি ধরে রাখাকে আরও কঠিন করে তোলে।
শরীফ জামিল আরও বলেন, 'তাছাড়া ঢাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় এ শহরের ওপর আরও নিবিড় মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।'
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটা অভিবাসন এবং কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থার কারণে ঢাকার বিকাশ প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক মানুষ এসে আশ্রয় নিচ্ছে ঢাকায়।
যেমন ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বহু মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। ঢাকায় তাদের আত্মীয় বা বন্ধু থাকলে সেই বন্ধুরা তাদের ঢাকায় টেনে আনবে। ফলে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।
ঢাকার অধিকাংশ রাস্তা যেহেতু পিচ ও কংক্রিটে ছেয়ে আছে, তাই মাটিও পানি শোষণ করে নিতে পারছে না—আর তা প্রবাহিত হচ্ছে অন্যত্র। এছাড়া শহরের বেশিরভাগ ছোট জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে।
এর ফলে প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নেমে যাচ্ছে। অথচ ১৯৭০-এর দশকে ভূগর্ভের ছয় মিটার নিচেই পানি পাওয়া যেত।
২০১৯ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্থায়িত্বের ওপর করা একটি সমীক্ষা অনুসারে, ভূগর্ভস্থ পানির গড় গভীরতা তালিকায় উল্লেখ ছিল ৭৮ মিটার, যা আগামী ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে ১৩২ মিটারে নেমে যেতে পারে। আর এটি হলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে।
বর্তমান ধারা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকার স্থির পানির স্তর গড়ে ১৬১ মিটার কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের এই উল্লেখযোগ্য হ্রাসের কারণে অনেক নলকূপ কার্যকারিতা হারাতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে, উত্তরের জলাভূমি ও আশপাশের উপশহরগুলো ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি পরিশোধন করে থাকে। কিন্তু এখন এসব এলাকাও কমে আসছে। তাই এই এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক রাখতে ও হ্রাস ঠেকাতে গভীর নলকূপ বসানো ক্ষেত্রে নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
২০০৬ সালে ইমারত নির্মান আইন প্রণয়ন করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক পরিবার, বৈধ ও অবৈধ উভয়ভাবেই, গভীর নলকূল বসিয়ে সমস্যা আরও বাড়াচ্ছে।
ঢাকাকে বাঁচাতে হলে ভূপৃষ্ঠের পানির দিকে নজর দিতে হবে। শীতলক্ষ্যা নদী থেকে পানি আসছে; ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে মেঘনা নদী থেকে পানি আনার চেষ্টা চলছে। তবে শরীফ জামিল বলেন, 'আমাদের পরিকল্পনা শুধুই পরিকল্পনা থেকে যায়।'
তিনি মনে করেন, পানি সংকট ও মৌসুমী আবহাওয়ার সময়ের জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব পুরোনো খালগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে। এতে জলাবদ্ধতা যেমন কমবে, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানিও মজুত হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যদি পর্যাপ্ত জলাধার রাখতে পারি, তাহলে ঢাকার নদীপথের নেটওয়ার্ক আরও সম্ভাবনাময় হতে পারে। হাতিরঝিল বনানীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে উত্তরা পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। অনেক পানিভিত্তিক যোগাযোগ রুট সম্ভব, যা ঢাকার যানজটও কমিয়ে দিতে পারে। এভাবে একটি সমাধান থেকে একাধিক সুফল পাওয়া সম্ভব।
ইনস্টিটিউট অভ ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের চেয়ারম্যান ইনামুল হক বলেন, ঢাকার পানি সরবরাহ গভীর নলকূপ ও পরিশোধিত পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এসব দিয়ে শহরের পানির চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ হয়। 'সায়েদাবাদ পরিশোধনাগারের নেটওয়ার্ক সীমিত। তাই ঢাকার পানির প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ গভীর নলকূপ থেকে আসে। ওয়াসা যতগুলো গভীর নলকূপ চায়, তার প্রায় দ্বিগুণ ব্যক্তিগত গভীর নলকূপ রয়েছে এখানে।'
পরিশোধনাগারগুলো যেহেতু চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়, তাই গভীর নলকূপগুলোকে এ প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে।
সংকট সমাধান হবে কীভাবে?
সমাধান সোজা। আমাদের সম্ভাব্য সবগুলো উপায়ে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করতে হবে।
ঢাকার চারপাশে যেহেতু ছয়টি নদী আছে, তাই এই নদীগুলোই আমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমরা যদি ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও ধলেশ্বরী থেকে পানি পরিশোধন করতে পারি, তাহলে সম্ভবত এ সংকট মোকাবিলা করা যাবে।
নদীগুলো ঢাকার জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা ছিল। আমরা যদি রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোকে হত্যা না করতাম, তাহলে ঢাকাকে কখনও পানি নিয়ে চিন্তা করতে হতো না।
অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য ঢাকার পানিকে পরিশোধন-অযোগ্য করে তুলেছে। ইংল্যান্ডের টেমস নদীর উদাহরণ টেনে পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা নদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি।'
কিন্তু সেসব তো ভবিষ্যতের কাজ; এর জন্য লম্বা সময় দরকার। এখন কী করতে হবে, তা নিয়ে ভাবা যাক। বর্তমানে কয়েকটি পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে সময়মতো প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করতে পারেনি ওয়াসা।
ঢাকা ওয়াসার ডেপুটি চিফ পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার মোস্তফা তারেক বলেন, '২০২৯ সালের মধ্যে ঢাকা ওয়াসা নগরবাসীর মধ্যে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৭ শতাংশ পানি এবং বাকি ৩৩ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করবে। ফলে ঢাকা ওয়াসার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর কোনো খারাপ প্রভাব পড়বে না।'
গত বছর প্রধানমন্ত্রী ঢাকার দশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন পানি শোধনাগার উদ্বোধন করেন। কিন্তু শোধনাগারটির গুরুতর ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। চীনের সহায়তায় ৩২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের প্রকল্পটি কোনো স্থানীয় পয়ঃনিষ্কাশন নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না।
ঢাকার এমন অনেক মানুষ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতার বাইরে। স্থানীয় জলপথে অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। দাশেরকান্দি প্রকল্প উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহরে টয়লেটের 'কালো পানি' পরিশোধনের সুযোগ পাবে।
গত বছর প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, এ পরিশোধনাগার গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন, বসুন্ধরা ও সংলগ্ন এলাকার মতো অভিজাত এলাকাগুলোতে প্রতিদিন উৎপাদিত ৫০০ মিলিয়ন লিটার পয়ঃনিষ্কাশনের পানি বালু নদীতে মেশার আগেই পরিশোধন করতে সক্ষম।
যদিও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তারা এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা নির্মাণের সময় প্রয়োজনীয় পাইপলাইনের সঙ্গে যুক্ত না করে তৈরি করা এ পরিশোধনাগারের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
মানুষের বাড়িতে সেপটিক ট্যাঙ্কগুলোর সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাড়ির মালিকরা গোপনে ভূগর্ভস্থ আউটলেট পাইপ তৈরি করেন, যা বর্জ্য নিয়ে ফেলে নর্দমা, গুলশান লেক ও খালগুলোতে। এসব বর্জ্য শেষ পর্যন্ত নদীতে মিলিত হয়।
এই মানুষদের সত্যিই দোষ দেওয়া যায় না। নর্দমার পানি প্রবাহিত হওয়ার জন্য পাইপলাইন না থাকলে তারা কী করতে পারেন? তারা তো আর ট্রাকে করে পরিশোধনাগারে নর্দমার পানি নিয়ে যেতে পারবেন না।
বিশেষজ্ঞরা শুধু পানীয় জল সরবরাহের জন্য নয়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্যও নতুন শোধনাগার স্থাপনের প্রস্তাব দিচ্ছেন। তাদের মতে, পাগলায় এখন যে ধরনের পযঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রয়েছে, সেরকম শোধনাগারসহ পুকুরের স্থিতিশীলতা ও জমাট প্রক্রিয়াও এর আওতায় আনতে হবে। এছাড়াও হাতিরঝিলের মতো জলাশয় থেকে নদীতে প্রবাহের আগে গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য উভয়ই পরিশোধন করা দরকার।
ইনামুল হক আরও বলেন, ছোট নগর এলাকা হওয়ায় সীমিত পরিসরেই 'স্লাজ' পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা যায়। পার্কের কাছে কিংবা সিটি করপোরেশনের জায়াগায় এ ধরনের পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগার গড়ে তোলা সম্ভব।
আরেকটি উপায় হতে পারে শহরের বিভিন্ন এলাকার জন্য নির্দিষ্ট পরিশোধনাগার তৈরি করা, যাতে আরও কার্যকরভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যায় এবং যেকোনো একক সিস্টেমের ওপর বোঝা কমানো যায়।
শিল্প মালিকদের লোভের কারণে ঢাকার নদীগুলো দূষিত। আমরা উৎপাদনশীলতার কাছে আমাদের ভবিষ্যৎ বিক্রি করি। এখন সময় এসেছে শিল্পবর্জ্য যাতে নদী দূষিত না করে, তার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নজর রাখার।
ইনামুল পরামর্শ দেন, শিল্পবর্জ্যকে পরিবেশে অবমুক্ত করার আগে পুকুর কিংবা সেপটিক ট্যাঙ্কে রাখা যেতে পারে এবং সেগুলো শোধন করে ছাড়তে শিল্পমালিকদের উৎসাহ দিতে হবে। শিল্পমালিকরা তাদের কারখানার গুদামের মেঝের নিচেই এ ধরনের জায়গা করে নিতে পারেন।
যদিও বর্তমান অবস্থায় আমরা গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীল, তারপরও ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ওপর মনোযোগ দেওয়া উচত। সবশেষে, বিদ্যমান জলাধারগুলোসংরক্ষণ ও রক্ষা করাও আবশ্যক।
আগামী ৩০ বছরে বুড়িগঙ্গার সম্ভাব্য লবণাক্ততা বিবেচনা করে, এই সমস্যা মোকাবিলা করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই পানির উৎস নিশ্চিত করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
আইনুন নিশাত মনে করেন, 'ঢাকার দক্ষিণের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে যথেষ্ট পানি থাকলেও এদের দূষণের মাত্রা নদীগুলোকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলেছে।' পদ্মা থেকে পানি আনার পরিকল্পনা চলছে, তবে গতিপথের স্বাভাবিক পরিবর্তন এ নদীকে উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। একইসঙ্গে মেঘনা থেকেও পানি আনার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু কাজটি কঠিন।
আইনুন নিশাত বলেন, 'দুই দশক আগে আমি কৃষি চাহিদার পাশাপাশি মানুষের জন্য পানীয় জলকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ কান দেয়নি। এখন আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, ৩০ বছরের মধ্যে বুড়িগঙ্গার পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে। আমাদের সেই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে।'
তিনি বলেন, এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য জলাধারের সংখ্যা যথাসম্ভব বাড়াতে হবে। যেমন, আশুলিয়া ও বিরুলিয়ার মধ্যবর্তী জলাভূমি এলাকা খনন করে একটি জল সংরক্ষণ এবং বিনোদনমূলক এলাকা গড়ে তোলা যেতে পারে, যা পানি সঞ্চয় এবং মানুষের বিনোদন—দুই খাতেই ব্যবহার করা যাবে।