যে মেলায় ৩০ টাকায় মেলে গাছ
সোনা রোদের আলোয় ঝলমল করছে সূর্যমুখী। পাশে রাশি রাশি হলুদ গাঁদা ফুল, আর উঁকি দিচ্ছে গোলাপি নয়নতারা। শুধু এসবই নয়, এখানে জবা, হাসনাহেনা, অপরাজিতা, চন্দ্রমল্লিকা, কৃষ্ণচূড়া, অলকানন্দা, কামিনীসহ নানা রকম বাহারি ফুল গাছের সমাহারও রয়েছে।
ফুলের পাশাপাশি আছে লেবু, আপেল, আনারসহ নানা ধরনের ফলের গাছ। সেগুলো কিনতে ভিড় জমিয়েছেন শত শত মানুষ। মজার ব্যাপার হলো, এখানে যেকোনো গাছের দাম মাত্র ৩০ টাকা!
রাজধানীর মিরপুরে সরকারি বাংলা কলেজের প্রাঙ্গণে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বসেছিল '৩০ টাকায় গাছ' মেলা। এ মেলায় মাত্র ৩০ টাকায় পাওয়া গিয়েছিল ফুল, ফল ঔ ঔষধি গাছ, সবজি, মশলা, এবং ইন্ডোর প্ল্যান্টসহ প্রায় ৭০ প্রজাতির গাছ।
৩০ টাকায় গাছ-এর মেলার মূল আয়োজক গ্রিন লাইফ সোসাইটি। মূলত প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে যে বন্ধন, সেটি জোরদার করতেই মেলার আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরে মোট ৬টি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ মেলা।
সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এহসানুল কিবরিয়া রাফি বলেন, 'গাছের জন্য আমাদের বছরে দুটো মৌসুম থাকে। একটা গরমের, আরেকটা শীতের। গরমের মৌসুম মানে গ্রীষ্ম আর বর্ষা মিলিয়ে আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেলার আয়োজন করি। প্রত্যেক জায়গাকে আমরা "ফেজ" হিসেবে চিহ্নিত করি।
'এ মৌসুমের শেষ ফেজ মিরপুরে। এরপর এক থেকে দেড় মাস বন্ধ থাকবে। তারপর শীতকাল এলে আবার এ জায়গাগুলোতেই মেলা হবে। প্রত্যেক জায়গায় বছরে দুইবার মেলা হয়।'
এবারের গরমের মৌসুমে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের দুই পাড়, শনির আখড়া, কোনাপাড়া, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমণ্ডি এবং মিরপুরে আয়োজিত হয়েছে এ ৩০ টাকায় গাছের মেলা।
শুরুর দিকে গাছ নিয়ে মেলার আয়োজন করার পরিকল্পনা ছিল না রাফির। তিনি চেয়েছিলেন ছাদবাগান নিয়ে প্রকল্প করার। সেখান থেকেই ভাবনা এল, 'স্বল্পমূল্যে মানুষের কাছে গাছ পৌঁছে দিলে কেমন হয়?'
ছোটবেলা থেকেই গাছ লালনপালনের অভিজ্ঞতা ছিল রাফির। কোন গাছে কোন সার দিলে ফলন ভালো হয় কিংবা কোন সময়ে গাছ লাগানো উচিত, সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল তিনি অনেক কম বয়স থেকেই।
রাফি বলেন, 'ক্লাস টু থেকে বাগান করি আমি। টিফিনের টাকা জমিয়ে জমিয়ে আগে গাছ কিনতাম। সেখান থেকেই ভাবনায় এল, একসঙ্গে একটা গড় দাম ধরে যদি মানুষকে গাছ দেওয়া যায়, তাহলে তাদের নিজের মতো নার্সারি করতে সহজ হবে।'
২০২১ সালে গ্রিন লাইফ সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পর রাফি ২০ টাকার বিনিময়ে গাছ বিক্রির উদ্যোগ নেন। তাতে বিপুল সাড়া পান। তবে কিছুদিন কাজ করার পর বুঝতে পারলেন, ২০ টাকায় গাছ বিক্রি করলে যাদের কাছ থেকে গাছ আনেন তাদের তেমন কোনো লাভ থাকে না। এরপর ২০ টাকার উদ্যোগ রূপ নেয় ৩০ টাকায়।
'এখনো প্রতিবছরে একবার ২০ টাকায় গাছ বিক্রি করার চেষ্টা করি,' বলেন রাফি।
তিন বছর ধরে গাছ বিক্রির উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে গ্রিন লাইফ সোসাইটি। রাফি বলেন, 'আমাদের এখানে অনেক কাস্টমার আছেন, যারা পেজে নিয়মিত আমাদের জানান যে গত তিন বছর ধরে গাছ নিচ্ছেন এবং তারা এ ইভেন্টের জন্য অপেক্ষা করে আছেন।'
কম যত্নে বাঁচানো যায় এমন গাছই মেলায় পাওয়া যায় বেশি। সাধারণত ঋতু বুঝে গাছ আনা হয়। যে-সব গাছের ফলন শীতকালে ভালো হয়, সেগুলো শীতের মেলায় প্রাধান্য পায়। গ্রীষ্ম-বর্ষায়ও এই রীতি অনুসরণ করা হয়।
ফল গাছের মধ্যে পেয়ারা, লেবু, আনার, মাল্টা, অড়বরই গাছ বেশি পাওয়া যায়। ফুলের মধ্যে রয়েছে চাইনিজ ভায়োলেট, হাসনাহেনা, বেলী, কামিনী, কুঞ্জলতা, সূর্যমুখী, নয়নতারা, রেইনলিলি, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ব্লু ডেইজি, শিউলি, গন্ধরাজ, রঙ্গন, লাল জবা, গোলাপী জবা, রাধাচূড়া, চায়না টগর, মাধবীলতা, দোলনচাঁপা, মেলাপুটিয়াম, রুয়েলিয়া, মুসান্ডাসহ আরও অনেক গাছ।
এছাড়াও এ মেলায় থাকে নানা জাতের ইন্ডোর প্ল্যান্টের; যার মধ্যে রয়েছে ক্যালাথিয়া, ফিলোডেনড্রন, রিও প্ল্যান্ট, লাকি ব্যাম্বু, মানিপ্ল্যান্ট, পার্পেল হার্ট, স্টার ক্যাকটাস, স্নেক প্ল্যান্ট, স্পাইডার প্ল্যান্ট, অগ্নিশ্বর প্রভৃতি গাছ। তাছাড়া মশলার গাছের মধ্যে পোলাও গাছ, লেমনগ্রাস, কারিপাতা অন্যতম।
বর্তমানে গ্রিন লাইফ সোসাইটিতে ৫০–৬০ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়মিত কাজ করেন। প্রতি ইভেন্টের আগে তাদের গাছ চেনার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। তাছাড়া গাছের গায়ে নেমপ্লেট থাকে, যাতে গ্রাহকেরা সহজে দেখে কিনতে পারেন।
অক্টোবরের মেলার প্রথম দিনে তিন হাজারের অধিক গাছের সমারোহ ছিল মেলায়। এর মধ্যে প্রথম দিনেই এক হাজার ৭০০-এর বেশি গাছ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তবে ধানমণ্ডিতে হওয়া গাছ মেলায় অনেক মজার অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হয়েছেন তারা।
রাফি বলেন, 'ধানমণ্ডির মেলায় ভিড় এত বেশি ছিল যে, সেখান থেকে আমাদের অনেক গাছ চুরি যায়। ১১৬টি গাছের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
'অনেকে নেট ভেঙ্গে ঢুকে গেছে গাছ কিনতে। কে টাকা পরিশোধ করেছেন, কে করেননি; সে হিসাব রাখাও সম্ভব হয়নি। আমরা শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম, মানুষ গাছের জন্যও এমন করে!'
মেলায় গাছ কিনতে আসা গ্রাহকদের প্রতি দুটি অনুরোধ করে গ্রিন লাইফ সোসাইটি কর্তৃপক্ষ। প্রথমত, ৩০ টাকার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি গাছের মধ্যে এক জাতের গাছ একাধিক নেওয়া যাবে না। অর্থাৎ কেউ যদি সূর্যমুখী ফুল গাছ কিনতে চান তবে তিনি একটিই কিনতে পারবেন। সূর্যমুখীসহ অন্যান্য গাছ নেওয়া সম্ভব, কিন্তু একই গাছ একাধিকবার নয়।
দ্বিতীয়ত, গ্রাহকদের অনুরোধ করা হয় বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে আসার জন্য। পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় তারা পরিবহনযোগ্য ব্যাগে গাছ বিক্রি করছেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব গাছের উপরেও পড়ছে বলে মন্তব্য করেন রাফি। তার মতে, গাছের মাটি, সার, মোড়কের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তবুও ঊর্ধ্বগতির বাজারে তারা চেষ্টা করছেন গাছের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার। রাফি বলেন, 'যতই দাম বাড়ুক, আমরা চেষ্টা করব ৩০ টাকা মূল্যে গাছ দেওয়ার।'