জঙ্গলের ‘কাল দীর্ঘায়ন’: মিরসরাইয়ে যেভাবে গড়ে উঠল এক মিয়াওয়াকি বন, দেড় বছরেই দেখায় বহুবর্ষী
নাম ছাড়া সোনাপাহাড়ের আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে, গাছ-পালা গেছে পাহাড়েরও আগে। কাজের মধ্যে বাকি ছিল কেবল নামটিই। প্রকৃতি ধ্বংসের নমুনা হয়ে ধুকছিল সোনাপাহাড়।
সাবেক ব্যাংকার আমজাদ হোসেন একজন উদ্যোক্তা। সমুদ্র থেকে পাওয়া অকেজো মাছ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে প্রাণীখাদ্য হিসাবে বাজারে বিক্রি করেন। চট্টগ্রামে তাদের কারখানা। কাছাকাছি একটি গুদামখানা খুঁজছিলেন। সোনাপাহাড়ে তখন একটি মুরগীর খামার ছিল। জায়গাটা শ্রীহীন হয়ে গেলেও আশপাশ মনোরম। তিনি ভাবলেন, সোনাপাহাড়কে তার হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে দিলে কেমন হয়?
মালিকের কাছ থেকে তিনি সোনাপাহাড়ের ১৮ বিঘা জমি ইজারা নিলেন। তার মধ্যে গুদামঘর হয়েও অনেকটাই খালি থাকবে। প্রাকৃতিক কৃষির দেলোয়ার জাহানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল, তাদের ভাবনায় মিল ছিল। তারা কৃষককে সম্মান দেওয়ার কথা ভাবেন।
প্রাকৃতিক কৃষি ও আমজাদ হোসেন
দেলোয়ার জাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করেছেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি-অর্থনীতি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। তিনি থাকেন মানিকগঞ্জে এবং প্রাকৃতিক কৃষি নামে ১৮ বিঘা জমিতে একটি খামার গড়েছেন। প্রাকৃতিক কৃষি আসলে একটি আন্দোলনের নাম, যার বয়স এক যুগ হতে চলেছে। রাসায়নিকমুক্ত ফসল উৎপাদন, হাইব্রিড সংস্কৃতি বিতাড়ন এবং বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য।
আন্দোলনের অংশ হিসাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রাকৃতিক কৃষি। তারই কোনো এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন আমজাদ হোসেন এবং পরিচিত হয়েছিলেন দেলোয়ার জাহানের সঙ্গে। আমজাদ হোসেন দেলোয়ারকে বলেছিলেন, 'সোনাপাহাড়ে একটা বন গড়তে চাই, আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের উদ্দেশ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংঘাত কমানো।'
দেলোয়ারের তখন মনে পড়ে গিয়েছিল, আগে প্রায় সব বাড়িতেই ছিল বাঁশ বন, আম বাগান বা বেতবন। এগুলোকে গৃহস্থ বন বা পালানের বন বলা হতো। তখন আম খেতে বাজারে যেতে হতো না, ঘরের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে গেলে একটি শক্ত বাঁশ কেটে জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হতো।
কৃষকের গৃহস্থালির সঙ্গে গোয়াল, খড়ের গাদা এবং গৃহস্থালি বনও হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে শিল্প কারখানাগুলো যে কার্বণ নিঃসরণ করছে, তার পরিশোধক (অ্যাবজর্বার) পাওয়া যাচ্ছে না।
জাপানে শিল্পায়ন ও মিয়াওয়াকি
জাপানে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটে। বাস্তুসংস্থানবিদ আকিরা মিয়াওয়াকি ভাবলেন, বিপদ ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। জাপানের গাড়ি, স্টিল এবং ইলেকট্রনিক পণ্যের কারখানাগুলো ব্যাপক মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ঘটাচ্ছে। এসব কারখানা তৈরিও হয়েছে বিস্তীর্ণ বন উজাড় করে। সমস্যা তৈরি হয়েছে দ্বিমুখী।
সত্তরের দশকের গোড়ায় মিয়াওয়াকি কৃত্রিম বন তৈরির নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যাকে বলা হলো নগর বন। পতিত জমি ব্যবহার করে নগর বন তৈরির প্রয়াস নিলেন তিনি। যেহেতু নগরে দূষণ বেশি, গাছপালা কম—তাই মিয়াওয়াকি পদ্ধতি নগরের জন্য হয়ে উঠল আশীর্বাদ। অল্প জায়গায় বন গড়ে তোলা সম্ভব বলে এটি দ্রুত জনপ্রিয়তাও পেল।
প্রথম এ ধরনের বন তৈরির সফল উদাহরণ সৃষ্টি করে নেদারল্যান্ডস। সেখানে এখন প্রায় ৬০টি বাড়ির পিছনে এ ধরনের বন আছে। ভারতের চেন্নাইয়ে ১ হাজার নগর-বন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম আর যুক্তরাজ্যেও মিয়াওয়াকি বন তৈরির প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।
এ বনের বৈশিষ্ট্য হলো ৬ মিটার বা একটি ড্রইংরুমের পরিসরেও তৈরি করা যায়, ৩০-৪০ বছরে এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, মনে হয় বনটির বয়স কয়েকশ বছর। কার্বন শোষণ করতে পারে প্রাকৃতিক বনের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি।
স্বল্প পরিসরে কৃত্রিম বন
দেলোয়ার জাহান মিয়াওয়াকি বনের কথা প্রথম শুনেছেন স্থপতি নাজমুল ইসলাম পলাশের কাছে। বিদেশে তার ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অনেক, জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিখাদ আগ্রহ। মিয়াওয়াকি বনের কথা তিনিই প্রথম দেলোয়ারকে জানান।
তখন ছিল গরম কাল। প্রাকৃতিক কৃষির খামারে চলছিল বন সৃজন কর্মশালা। শহরের গাছ উজাড় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, বলা হচ্ছিল বন সৃজনের স্থানীয় পদ্ধতি নিয়ে, আলোচনা প্রসঙ্গে মিয়াওয়াকি পদ্ধতির কথাও উঠে এসেছিল।
এ সময় দেলোয়ার সোনাপাহাড় প্রকল্পের কথা ভাবলেন। ১৭-১৮ বিঘার প্রকল্প হলেও জলাভূমি, গুদামঘর, আবাসন বাদ দিয়ে বনের জন্য পাওয়া যাবে ৮ শতাংশ। মিয়াওয়াকি বন তৈরির জন্য জায়গাটুকু যথেষ্ট। পরেরবার যখন আমজাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা হলো, দেলোয়ার তাকে মিয়াওয়াকি বন সম্পর্কে জানালেন। কৃত্রিম এ বন যে প্রাকৃতিক বনের চেয়েও কার্যকর তাও জানাতে ভুললেন না। ইতিবাচক বা সৃজনশীল কিছুর খবর পেলেই আমজাদ হোসেন লুফে নেন। এবারও ব্যতিক্রম হলো না।
তিনি দেলোয়ারকে সঙ্গে করে নিয়ে চললেন সোনাপাহাড়। মিরসরাই নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এখন অবশ্য পাহাড় ও বন উজাড়ে অনেকটাই হতদরিদ্র। আমজাদ হোসেন দুঃখ করে বললেন, 'আমরা নদী নষ্ট করেছি, এখন যদি নদীর উৎস পাহাড়ও নষ্ট করে ফেলি, আমাদের আর কিছু থাকবে না।'
দেখা গেল মাশরুম গজিয়েছে
দেলোয়ার দুটি কাজকে অগ্রাধিকার দিলেন—টপ সয়েল উঠিয়ে ফেলা এবং প্রচুর পরিমাণে জৈব সার মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া। আশপাশে ইটভাটা বলেই টপ সয়েল তুলে ফেলতে হলো। আর নাইট্রোজেনের ঘাটতি যেন না হয়, তার জন্যে জৈব সার মাটিতে মেশাতে হলো প্রচুর পরিমাণে। এ কাজগুলো হয়ে গেলে খড়, গাছের ছাল-বাকল ও গোবর দিয়ে জায়গাটি ঢেকে দিলেন।
তারপর গেলেন বনের গভীরে। তার আগে সিদ্ধান্ত নিলেন জমিটি এক মাস ফেলে রেখে পরখ করে দেখবেন কতটা উর্বর হয়েছে। জমিতে কিছু ধানবীজও ছড়িয়ে দিলেন।
বনের গভীরে গিয়ে তারা স্থানীয় গাছ খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। মিয়াওয়াকি বন তৈরির শর্ত হলো স্থানীয় প্রজাতির গাছ বাছাই করা। বহুকাল ধরে আছে বলে সেগুলো স্থানীয় প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। দেলোয়াররা কাঠুরেদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুললেন। তাদের জন্য গাছপ্রতি কিছু বিনিময়মূল্যও ধার্য করলেন। একটি গাছ যথেচ্ছ উঠিয়ে আনার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন।
এর মধ্যে এক মাস পার হলে দেখা গেল বেশ ভালো ধান গাছ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, মাশরুম গজিয়েছে। জমিটি যে প্রস্তুত এবং যথেষ্ট উর্বর, মাশরুম তার নির্দেশক। তবে কাঠুরেরা তাদের কাজে খুব সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেননি। তারা ৩০০টি চারা যোগান দিয়েছেন, দেলোয়ারের লাগবে ১২০০টি।
তিনি জানলেন, চট্টগ্রামের একটি নার্সারি থেকে স্থানীয় গাছ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। নার্সারি থেকে বাকি চারা আনিয়ে নিতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। তারপর শুরু হয় বৃক্ষরোপন। দুই বাই দুই বর্গফুট জায়গা মেপে, চার কোনায় চারটি ভিন্ন ভিন্ন জাতের গাছ লাগালেন। বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্যই কাজটি করলেন।
এতে বনজ যেমন, ফলদ গাছও থাকল। যেমন শিমুল, কদম, মুচকুন্দ চাঁপা, আমড়া, গামারি, গর্জন, সেগুন, রুদ্রপলাশ, মানকচু, হরিতকি, অশোক ইত্যাদি।
পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখতে
বৃক্ষরোপণের পরই একটি ভালো বৃষ্টি পেয়েছিল সোনাপাহাড়। তাতে চারাগুলো পুষ্ট হয়েছে। তারপর এসেছিল শীত। ছয় মাস পরে গিয়ে দেলোয়ার দেখেন, গাছগুলো ভালো বড় হয়েছে।
এ বনের আরেকটি শর্ত হলো, কোনো ডাল ছাটা যাবে না। দেলোয়ার বললেন, সূর্যের আলো পাওয়ার জন্য প্রতিটি গাছই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। তাই বনটি দ্রুত বর্ধনশীল, তবে তার আগের শর্ত দুটি মানতে হবে—মাটিতে পর্যাপ্ত খাবার থাকতে হবে এবং গাছগুলো হবে স্থানিক।
সোনাপাহাড়ের মিয়াওয়াকি বনের বয়স আজ ১৬ মাস। এর মধ্যেই একে দেখে বহুবর্ষী মনে হয়। আমজাদ হোসেন জানালেন, গাছগুলোর গড় উচ্চতা ইতোমধ্যে ১৫ ফুট হয়ে গেছে, কোনো কোনো গাছ ২০ ফুটে পৌঁছেছে।
তিনি বললেন, 'আমরা চেয়েছি এটাকে নমুনা হিসাবে দেখাতে। যাদের বয়স ৫০, এখন তারাও তাদের বাড়ির ধারে বন দেখেছেন, অথচ আজকে দেখছেন না। কিন্তু পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখতে এর বিকল্প কোথায়? গরম যে চরম মাত্রা ধারণ করছে, তাতে কষ্ট কার না হচ্ছে! এসি দিয়ে কতদিন ঠেকানো যাবে?'
প্রকৃতিবিদ মোকাররম হোসেন বৃক্ষায়নের গোড়ার দিকেই সোনাপাহাড়ে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, 'খুবই চমৎকার উদ্যোগ। যেভাবে পাহাড়, বন উজাড় হচ্ছে, সেখানে দ্রুত বৃক্ষ বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে পদ্ধতিটি কার্যকর। ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন, প্রতিষ্ঠানও এমন প্রকল্প নিতে পারে। সরকারও গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটি বিবেচনা করতে পারে।
'তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, এমন প্রকল্পে যেন স্থানীয় উদ্ভিদই কেবল স্থান পায়, বৈচিত্র্যের দিকেও নজর রাখতে হবে। তার জন্য প্রকল্প তৈরির আগে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে নিলে সুবিধা হবে।'
ছবি: সৌজন্যে