চকবাজারের রুবিক্স কিউবের আজব রাজ্য!
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/06/1738644674773.jpg)
'শাহী ইন্টারন্যাশনাল' ছিল চকবাজারের বিসমিল্লাহ টাওয়ারের নিচ তলায়। সে সময়ে দোকানের হালচাল এখনের মত ছিল না। কম মালামাল নিয়ে ছোট একটি দোকান। সেলফে সাজিয়ে রাখা গুটিকয়েক রুবিক্স কিউব এবং বাচ্চাদের কিছু খেলনা—এভাবেই শুরু হয়েছিল শাহীর যাত্রা। অবশ্য দশ-বার বছর আগে ঢাকায় রুবিক্স কিউব নিয়ে তেমন একটা হইচই ছিল না, বরং কিউব পাগলদের জন্য মানসম্পন্ন রুবিক্স কিউব সংগ্রহ খুঁজে পাওয়াই ছিল বিরল ঘটনা।
তবে কথায় আছে না, সময়ের সাথে সাথে কতই কিছুই তো পালটে যায়। হয়েছেও তাই। এখনকার তরুণদের কাছে কিউবিং হলো অন্য মাত্রার আনন্দ। ফুটবল-ক্রিকেটের চেয়ে যেন এই ধাঁধাতেই সুখ। আর এসবের সাথে শাহীর চেহারা-কাঠামোতেও এসেছে বদল। এখন অবশ্য নিচ তলায় নয়, বরং টাওয়ারের পাঁচ তলাতেই দোকানের অবস্থান।
বছর পাঁচেক আগে জায়গা পাল্টেছেন তারা৷ শুধু তাই নয়, দোকানের পরিসরেও এসেছে পরিবর্তন। আগের মত ছোট্ট দোকানটির অস্তিত্ব আর নেই৷। এখন নামকরা বেশ বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। নানা ধরনের পণ্যের বিশাল সম্ভার আছে এখানে। তবে আজ শাহীর রুবিক্স কিউব নিয়েই না হয় লেখা যাক!
শাহীর সংগ্রহ
বিশ বা ত্রিশ নয়, প্রায় পঞ্চাশেরও বেশি ক্যাটাগরির রুবিক্স কিউবের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে শাহীতে। ঢাকার আর কোনো দোকানে রুবিক্স কিউবের এত বিশাল সংগ্রহ আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই। তবে দোকানের ম্যানেজার এবং দোকানে উপস্থিত ক্রেতাদের ভাষ্যমতে, এত ধরনের কিউব নেই আর কোথাও। বলতে গেলে এখান থেকেই কিউব যায় ঢাকার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন দোকান ও দেশের নানান প্রান্তে৷
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/06/1738644674884.jpg)
অবশ্য এই খবর অজানা নয় কিউব প্রেমীদের। বরং তারা সময় করে একটিবার হলেও ঢুঁ মেরে যান এই দোকানে। নিয়মিত কিউবিং করেন যারা, কিংবা নতুন শখ তৈরি হওয়া কিউবপ্রেমীরা এখানে এলে যেন হারিয়ে যান। প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন কিউবে সজ্জিত থাকে দোকানের একটি পাশ।
ক্লাসিক ৩x৩ কিউব থেকে শুরু করে মিরর কিউব, মেগামিনক্স, গিয়ার কিউব কিংবা গোল্ডেন কিউব—সবই মেলে এক ছাদের নিচে। রুবিক্স কিউবের বিশাল সংগ্রহ নিয়ে এই দোকানটি যেন এক স্বর্গরাজ্য কিউব প্রেমীদের জন্য। ফলে শৌখিন কিউবার থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতারাও এখানে ভিড় জমান নিয়ম করে।
আবার যারা রেয়ার কিউবের খোঁজে থাকেন, তাদের জন্যও বন্দোবস্ত আছে শাহীতে। কিংবা কিউবিং কমিউনিটির জন্য কিছু কিউব সংগ্রহ করতে চান যারা, তাদের জন্য শাহী হতে পারে উত্তম গন্তব্য।
চকবাজার মোড়ে নেমে যে কাউকে বিসমিল্লাহ টাওয়ার এর অবস্থান জিজ্ঞাসা করলেই ঝটপট চিনিয়ে দেবেন। টাওয়ারের ৫ তলাতে উঠেই চোখে পড়বে মস্ত বড় দোকান, 'শাহী ইন্টারন্যাশনাল'।
তবে 'শাহী' অনেকের কাছে অনেকভাবেই পরিচিত। শুধু কিউবই নয়, শিশুদের জন্য ভালো মানের খেলনা বা ঘর সজ্জার 'ইউনিক' সব সংগ্রহের জন্যও বেশ নামডাক আছে তাদের। কারণ প্রতিটি পণ্যই বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা হয়। বিশেষ করে চীন থেকে। ফলে পণ্যের মানও হয় বেশ ভালো।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/06/1738644674810.jpg)
শিশু থেকে তরুণ–প্রায় সব বয়সী মানুষের খেলার জিনিসপত্র কিনতে পাওয়া যায় শাহীতে। তবে সেসব কিনতে গেলে বেশ মোটা অঙ্কের টাকাও কিন্তু গুনতে হবে!
খুচরা মূল্যে বিক্রি নেই
কেনই বা এত টাকা গুণতে হবে? এর উত্তরটা দিলেন দোকান ম্যানেজার মো: শাহীন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই দোকানে কাজ করছেন তিনি। বলতে গেলে শাহীর আজকের যে উত্থান তার চাক্ষুষ সাক্ষীও তিনি।
শাহীন জানালেন, "দাম বেশি কেন হবে না বলেন? সবগুলোই কিন্তু বিদেশি জিনিসপত্র। টেকসই ও মানে ভালো। আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো পণ্যের দাম তো বাড়তি আছেই, তার উপর এখানে কোনো কিছুই খুচরা বিক্রি হয় না৷ যা-ই নেবেন, পাইকারি নিতে হবে। এক-দুইটা জিনিস আমরা বিক্রি করি না।"
শাহীনের কথায় বোঝা গেল, শাহীর সমস্ত পণ্য ক্রয়-বিক্রয় চলে পাইকারি মূল্যে। এক-দুইটি করে পণ্য কেনা যাবেনা কোনোভাবেই। কিনতে হলে একই জিনিস নিতে হবে কমপক্ষে ৬-১২টি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খুচরা বিক্রেতারা এভাবেই মালামাল কিনে নেন শাহী থেকে। ফলে খুচরা ক্রেতাদের খুব একটা আনাগোনা নেই এই দোকানে।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/06/1738644674860.jpg)
তবে কিছু শৌখিন ক্রেতা এমনও আছেন, সমস্ত শর্ত মেনে সংগ্রহ করে নেন পছন্দের কিউবটি। এত দামে সবসময় পুষিয়ে উঠতে পারেন না, আবার তারা না কিনেও থাকতে পারেন না—এমন একজন ক্রেতা হলেন খাদেমুল ইনসান। কিউব এবং পাজল নিয়েই তার ধ্যানজ্ঞান। তাই নিয়ম করে ঢুঁ মারেন শাহীতে। ব্যতিক্রমী কোনো কিউব বা পাজল পেলেই চড়া মূল্য দিতেও প্রস্তুত তিনি। শাহীর নিয়মিত ক্রেতা ইনসান প্রায় এক যুগ ধরে এখান থেকেই কিউব, পাজল কেনাকাটা করছেন।
ইনসানের ভাষ্যে, "বেশ উন্নত এবং ব্যতিক্রমী পাজল হয়েছে শাহীতে। বলতে গেলে পাজলের রেয়ার কালেকশন পাওয়া যাবে তাদের কাছে। যেমন– ইন্টারলকিং পাজল, কাঠের পাজল সবগুলোই আছে শাহীর শোকেসে। তাছাড়া, বিভিন্ন ধরনের এবং লেয়ারের কিউব তো আছেই।"
"আমি রুবিক্স কিউবের পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ৫-৬টা পাজল কালেক্ট করেছি। তাদের আলাদা একটা ব্যাপার হলো, তারা বাচ্চাদের নিয়ে ভাবে। আপনি ওই দোকানে গেলে দেখবেন তাদের কাছে বাচ্চাদের খেলনার বেশ ভালো কালেকশন আছে। আবার ম্যাটেরিয়ালগুলোও দারুণ," বলেন ইনসান।
শাহী থেকে কিউবের এক বিশাল সংগ্রহ করেছেন তিনি নিজেও। সময় এবং সামর্থ্য হলেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কিউব কিনেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– গিয়ার ব্যারেল, ফিশার কিউব, ফ্লাকচুয়েশন, ওইয়াইন্ড মিল কিউব, ২*২ মিরর ব্লক, সিক্স স্পট কিউব, ম্যাপল লিভস স্কিউব প্লাস কিউব, হাউস কিউব্ ড্যারেল কিউব, ডিপ্লোডোকাস ২*২*৩, টরি কিউব, ইউক্লিডিয় কিউব, সুপার স্কয়ার-১, ৩*৩*৩ ব্লক, রব'স পাইরামিনক্স, ডোমিনো কিউব, টেট্রা পিরামিড কোয়াড্রাঙ্গল, আইভি কিউব, গিয়ার পাইরামিনক্স, গিয়ার স্ফেয়ার গিয়ার বলসহ আরও অনেক কিউব।
তবে মজার ব্যাপার হলো, ইনসানের মতো শাহী থেকে অনেকেই কিউব না কিনে খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয় করে নেন। আবার এসব খুচরা বিক্রেতারা শাহী থেকেই নিয়ে আসেন সেসব কিউব। এতে করে ভালো পণ্যটি যেমন কিনতে পারা যায়, তেমনি দামও থাকে তাদের নাগালে। কারণ তখন আর ডজন হিসেবে নয়, কেনা যায় একটি কিউবও!
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/06/1738668681496.jpg)
প্রতি শিপমেন্টে নতুন কিউব!
ভালো পণ্যের দাম বেশি– এমনটি শুনতে পাওয়া লোকমুখে। শাহীর কিউবের চাহিদার ক্ষেত্রেও তাই৷ পণ্য দামি হলেও বিক্রি কিন্তু কমেনি, বরং কিউবের বিক্রি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক শিপমেন্টে যা আসে, বিক্রি হয়ে যায়।
শাহীন বললেন, "চাহিদা না থাকলে তো এত কিউব আনবো না। দাম বেশি হইলেও মানুষ কিনছে। আর এসবের মার্কেট আছে বলেই আমরা প্রতি শিপমেন্টে আবার রুবিক্স কিউব নিয়ে আসি। বলতে গেলে আমাদের এখান থেকে ভালোই কিউব কেনেন ক্রেতারা।"
শাহীর উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, প্রতি শিপমেন্টেই আসে নতুন নতুন পাজল এবং কিউব। এক্ষেত্রে দোকানদাররা কিছুটা সতর্ক থাকেন। যেসব কিউবের বিক্রি থাকে না সেগুলো পরেরবারে আর নিয়ে আসেন না। ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মূলত কোনটার চল বেশি বা ক্রেতারা কোন ধরনের কিউবের প্রতি বেশি আগ্রহী, সেটি মাথায় রেখেই পণ্য আনেন তারা।। বিশেষ করে কিউবের ক্ষেত্রে 'এক্সক্লুসিভ' গুলোই থাকে পছন্দের শীর্ষে।
শুধুমাত্র শিশুদের কথা মাথায় রেখে আলাদা করে নিয়ে আসা হয় রুবিক্স কিড কিউব। যেমন– নাম্বার রুবিক্স কিউব, ম্যাজিক কিউব, ফ্রুটস কিউব, কিউব সিরিজ, ব্রেইভ পিরামিড, স্নেক কিউবসহ আরও অনেক ধরনের কিউব। তিন বছরের বাচ্চাদের থেকে শুরু করে প্রায় সব শিশুরা এই কিউব নিয়েই কিউবিং চালিয়ে নিতে পারবে।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/06/1738668681619.jpg)
সারা দেশে সরবরাহ
কিউবের বিপুল ভাণ্ডার শাহী ইন্টারন্যাশনাল শুধুমাত্র রুবিক্স কিউব আমদানি করেই থেমে থাকে না, বরং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিউব সরবরাহও করে। শাহী থেকে রুবিক্স কিউব যায় সারা বাংলাদেশে। যেমন– চট্টগ্রাম, রাজশাহী, পঞ্চগড়, দিনাজপুর– সব জায়গার ব্যবসায়ীরা শাহী থেকে পাইকারি হিসেবে কিনে নেন কিউব। একইভাবে ঢাকার অনেক খুচরা দোকানীও শাহী থেকেই কিউব কিনে আনেন।
শাহীতে পাওয়া যায় ২×২, ৩×৩, ৪×৪, ৫×৫, ৬×৬, ৭×৭ এবং ৯×৯ লেয়ার পর্যন্ত কিউব। এরমধ্যে কোন লেয়ারের বিক্রি বেশি জানতে চাইলে ম্যানেজার শাহীন বলেন, "আমাদের এখান থেকে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় থ্রি ইন্টু থ্রি এবং টু ইন্টু থ্রি।"
এখানে কিউবের দাম শুরু হয় ৮০ টাকা থেকে। সর্বোচ্চ সে দাম দাঁড়ায় ৩-৪ হাজারের মধ্যে। তবে শাহীর বর্তমানে সবচেয়ে দামি কিউবের মূল্য ২,৬০০ টাকা।
কখন থেকে শুরু হয় শাহী কর্মযজ্ঞ? জবাবে শাহীন বলেন, "কাস্টমার থাকলে সকাল ১০টার দিকে দোকান খুলি। আর বেচাকেনা কম বা কাস্টমার কম থাকলে ১১-১২টার দিকে। আর রাত ৭-৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।"
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/06/1738668681841.jpg)
রুবিক্স কিউব বৃত্তান্ত
যে রুবিক্স কিউব নিয়ে তরুণদের মধ্যে এত উন্মাদনা সেটি তৈরির গল্পও বেশ মজার। এক অধ্যাপকের হাত ধরে জন্ম রুবিক্স কিউবের।
গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। হাঙ্গেরির এক তরুণ স্থপতি এবং অধ্যাপক এর্নো রুবিক তার ছাত্রদের ত্রিমাত্রিক নকশা বোঝানোর জন্য এমন একটি মডেল তৈরি করতে চাচ্ছিলেন, যা বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে ফেলা যাবে। ছয় মাসের চেষ্টার পর কাঠ, কাগজ, রাবার ব্যান্ড ও আঠা দিয়ে তিনি তৈরি করলেন একটি কিউব, যার নাম দিলেন 'Magic Cube' বা জাদুর কিউব।
পাঁচ বছর পর, ১৯৭৯ সালে আইডিয়াল টয় কোম্পানি কিউবটি বিপণনের অনুমতি নেয়। ১৯৮০ সালে নাম বদলে রাখা হয় 'Rubik's Cube'।
কিন্তু রুবিকের তৈরি কিউব নিয়ে বিতর্কও কম ছিলনা। ১৯৭০ সালে আমেরিকার ল্যারি নিকোলস নামে একজন ব্যক্তি প্রায় একই ধরনের একটি কিউব তৈরি করেছিলেন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তবে ১৯৮৪ সালে রায় হয় এর্নো রুবিকই প্রকৃত উদ্ভাবক।
বিশ্বজুড়ে রুবিক্স কিউবের উত্থান ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন রুবিক্স কিউব বিক্রি হয়, যা এক বিশাল সাফল্য।
বর্তমানে রুবিক্স কিউব শুধু খেলনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়– বরং এটি বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা, ধৈর্য্য ও ফোকাস যাচাইয়ের এক অসাধারণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে কিউবিং প্রতিযোগিতাও। জনপ্রিয়তার সে হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশের নতুনদের মধ্যে। তাই তারাও কিউবিং এর দিকে আগ্রহ নিয়ে ঝুঁঁকছেন। আর তাদের জন্য নিত্য নতুন কিউব নিয়ে বাজারে 'শাহী ইন্টারন্যাশনাল' তো আছেই!
ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/টিবিএস