‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে ৫ আগস্ট যে পরিকল্পনায় এগিয়েছিল হাসিনা সরকার
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/13/unhr_report_cover.jpg)
বুধবার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য এবং আন্দোলনকারীদের ঘোষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আগেই জানতে পারে যে, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল (মার্চ টু ঢাকা) পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ৪ আগস্ট সকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন।
এতে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ এবং পুলিশের বিশেষ শাখাসহ স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ঢাকামুখী এই আন্দোলন ঠেকাতে ফের কারফিউ জারির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় জানায়, পূর্ববর্তী কারফিউ আরও কঠোরভাবে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য বলবৎ থাকবে। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দিয়ে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান, 'এই সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করুন।'
৪ আগস্ট রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আরেকটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, পুলিশপ্রধান, র্যাব, বিজিবি, আনসার-ভিডিপি প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্টাফ অফিসার এবং সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সেনাপ্রধানসহ নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন যে, ঢাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেনাবাহিনী ও বিজিবি একসঙ্গে কাজ করবে এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে প্রতিবাদকারীদের ঢাকার কেন্দ্রে প্রবেশ ঠেকাবে। সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে শহরের প্রবেশপথ বন্ধ করতে বলা হয়, আর পুলিশকে 'জনতা নিয়ন্ত্রণের' দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, ৫ আগস্ট রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী) সাবেক মহাপরিচালক বিজিবি প্রধানকে দুটি পরপর হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান। ওই বার্তাগুলোর হার্ডকপি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার হাতে আসে।
প্রথম বার্তাটি ছিল একটি সম্প্রচারিত বার্তা, যা সম্ভবত আন্দোলনের নেতাদের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিল। এতে বিক্ষোভকারীদের জন্য ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশের রুট সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় বার্তায় একটি ভিডিও ছিল, যেখানে 'যুদ্ধ কৌশল' ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এতে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইন, তৃতীয় লং-রেঞ্জ ইউনিট, ব্যাকআপ ইউনিট এবং রিয়ার গার্ডের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা ছিল।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/13/captureunhcr.jpg)
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি। এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পর্যাপ্ত বাহিনী মোতায়েন করেনি। অন্য এক কর্মকর্তা জানান, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে শহরে প্রবেশ করতে দিয়েছে।
তৃতীয় একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সিসিটিভি ফুটেজে ৫০০ থেকে ৬০০ বিক্ষোভকারীকে সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে আসতে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে।
চতুর্থ আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।
পুলিশ ঢাকার উদ্দেশ্যে বিক্ষোভকারীদের 'মার্চ টু ঢাকা' (প্রতিবেদনে 'মার্চ অন ঢাকা' উল্লেখ করা হয়েছে) থামাতে এবং শহরের কেন্দ্রস্থলে তাদের পৌঁছানো প্রতিরোধ করতে বিভিন্ন স্থানে সরাসরি গুলি চালায়। এক পুলিশ কমান্ডার ব্যাখ্যা করে বলেন, 'সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানত শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়েছেন, কিন্তু পুলিশ জানত না। তাই পুলিশ তখনো সরকারকে রক্ষা করতে মাঠে ছিল।'
ওএইচসিএইচআর বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যার প্রতিটি একই ধরনের প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে।
চাঁনখারপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ও অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের শাহবাগ অভিমুখে যেতে বাধা দিতে রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি চালায় এবং কম মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'পুলিশ যাকে দেখেছিল, তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল।'
রামপুরা ব্রিজে বাড্ডায় প্রবেশের চেষ্টাকালে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ ধাতব গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, এতে শিক্ষার্থীসহ অনেকে আহত হন। সকালেই এই এলাকার গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী এক শিশু জানায়, 'পুলিশ এমনভাবে গুলি চালাচ্ছিল যেন বৃষ্টি পড়ছে।' সে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে।
আশুলিয়া ও সাভারে প্রথমদিকে পুলিশ বিভিন্ন চেকপোস্ট বসিয়ে বিক্ষোভকারীদের প্রতিহত ও আটকানোর চেষ্টা করে। তবে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তারা প্রথমে কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করলেও পরে ধাতব গুলি ভর্তি শটগান দিয়ে গুলি চালায়। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি আহত বিক্ষোভকারীদের সহায়তা করতে গেলে ধাতব গুলির আঘাতে আহত হন। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
সাভার বাসস্ট্যান্ডে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর সরাসরি গুলি চালিয়ে বহু হতাহত করে। এক সাংবাদিক স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশেই তারা মোতায়েন ছিল, তবে সাধারণ পুলিশ সদস্যরা অতিরিক্ত হতাহতের ঘটনা ঘটাতে চাইছিল না। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ৫ আগস্টের সংঘর্ষের পর এক নিহত কিশোরের মরদেহ তিনি দেখতে পান। তিনি বলেন, '৫ আগস্ট আমাদের জন্য আনন্দের দিন ছিল, কিন্তু ওই ছেলের মায়ের জন্য ছিল সবচেয়ে দুঃখের দিন।'
৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী থানায় মোতায়েন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা থানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর নির্দেশ পায়। তারা থানার ভেতর ও চারপাশ থেকে রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়। সরকারি কর্মকর্তারা জানান, কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করছিল। এতে বেশ কয়েকজন নিহত এবং বহু আহত হন, যার মধ্যে দুটি গুলিবিদ্ধ এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছিলেন।
দুপুরের দিকে সেনাবাহিনী সেখানে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করে, তবে পরে সরে যায়। সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারের পর পুলিশ ফের সংঘর্ষ শুরু করে—প্রথমে থানার ফটকের বাইরে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে, এরপর সারিবদ্ধভাবে বেরিয়ে এসে শটগান ও রাইফেল দিয়ে গুলি চালায়। ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, পুলিশ কাছ থেকে গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যা করেছে, যখন তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছিল বা পালিয়ে যাচ্ছিল। পাশাপাশি পুলিশ জনতার ওপরও নির্বিচারে গুলি ছুঁড়েছিল।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/13/captureunhcr3.jpg)
৫ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনার বিদায় উদযাপনের সময়ও কিছু পুলিশ সদস্য বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী গুলি চালাতে থাকে। এতে বেশ কয়েকজন শিশুও নিহত হয়।
উত্তরায় এক প্রত্যক্ষদর্শী ও চিকিৎসা নথি অনুযায়ী, বিজয় মিছিলে অংশ নেওয়া মাত্র ৬ বছর বয়সী এক শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়ে। তবে হঠাৎ গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। শিশুটি উরুতে গুলিবিদ্ধ হয় এবং পরে হাসপাতালে মারা যায়। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, কে গুলি করেছে তা তিনি দেখেননি, তবে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মতো পোশাক পরা কিছু লোককে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে দেখেন। ঘটনাস্থলের কাছেই আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের একটি ঘাঁটি ছিল, এবং পুলিশ সদস্যরা দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মিছিলে অবস্থান নিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী আরও জানান, সেখানে অনেক আহত মানুষকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে, যাদের মধ্যে এক শিশুর মাথায়ও গুলি লেগেছিল।
মিরপুরে একজন প্রত্যক্ষদর্শী ও চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, বিজয় মিছিলে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২ বছর বয়সী এক কিশোর নিহত হয়।
গাজীপুরে বিকেলে ৫ থেকে ৬ হাজার মানুষের একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চলাকালে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করা হয়। তার ডান হাতে কাছ থেকে শটগানের গুলি ছোড়া হয়, যাতে তার হাত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভকারীরা নিরস্ত্র ছিল এবং কোনো হুমকি সৃষ্টি করেনি। তবে পুলিশ কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালায়। ফরেনসিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ছেলেটির হাতে ৪০টিরও বেশি ধাতব গুলি বিদ্ধ হয় এবং হাড় ও টিস্যু গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গুলি করার আগে পুলিশের এক সদস্য বলেছিল, 'তুই আর এই হাতে পাথর ছুড়তে পারবি না।'
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/13/captureunhcr2.jpg)
গাজীপুরেই আরও একটি ঘটনায় পুলিশ এক নিরস্ত্র রিকশাচালককে ধরে এনে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। পরে তারা লাশ সরিয়ে ফেলে, যা আর পরিবারকে ফেরত দেওয়া হয়নি। নিহত ব্যক্তির পরিবার জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার কাছে অভিযোগ করে বলেন, 'আমি ন্যায়বিচার চাই, স্বাধীন তদন্ত চাই এবং লাশ ফেরত চাই।'
আশুলিয়ায় বিকেলে থানা ঘিরে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ বারবার পিছু হটার চেষ্টা করলেও বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, যা মূলত জনতাকে আতঙ্কিত করতে করা হয়েছিল, কিন্তু এতে অনেক সাধারণ মানুষও আহত ও নিহত হয়।
এক ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থী কাছ থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পায় এবং স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা নিহতদের লাশ একটি ভ্যানে তুলে আগুন ধরিয়ে দেয়, যাতে এটি দেখানো যায় যে নিহতরা বিক্ষোভকারীদের হামলায় মারা গেছে।