আফগানিস্তানের নির্বাসিত নারী সংসদ সদস্যদের খোঁজে...
চলতি বছরের আগস্টে রাজধানী কাবুল দখল করে আফগানিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফেরে তালেবান। এসময় দেশটির ৬৯ জন নারী আইনপ্রণেতাদের মধ্যে যে ৯ জন তখনও দেশে ছিলেন তারা প্রাণের ভয়েই গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
তবে যারা পালাতে পেরেছেন তারা এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তারা নিজ দেশে নারী অধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেপ্রকাশ করেছেন এবং এ লক্ষ্যে নির্বাসনে একটি নারী পার্লামেন্টও গঠন করতে চান।
নির্বাসিত নারী এমপিদের সবচেয়ে বড় দলটি রয়েছে গ্রীসে, ২২ জন। আরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছেন আলবেনিয়া, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে।
এদের মধ্যে একজন আফগানিস্তানে ফিরে যেতে চান। তার যুক্তি- বিদেশে থেকে কিছুই করা যাবে না। তিনি বলেছেন- 'প্রকৃত উন্নতির জন্য আমাদের দেশের মধ্যেই কাজ করতে হবে।'
তালেবান ক্ষমতা দখলের সঙ্গেসঙ্গেই গা ঢাকা দেন মাশিদ (ছদ্মনাম) নামের এ এমপি। দেশ ছেড়ে পালানোর পথ সহজ ছিল না। পদে পদে প্রতিহিংসার ভয়। পালিয়ে বেড়ানোর সময় এক বাড়িতে টানা দুবার থাকেননি।
ওই সময়ে কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরে জনতার ঢল নামায় সৃষ্টি হয় অরাজকতা। ভিড়ে একাধিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস-খোরাসান। তাই বিমানবন্দরে পরিবারসহ যাওয়ার ঝুঁকিও নিতে চাননি মাশিদ। তিনি বলেন, চোখের সামনে যেন আফগানিস্তান থেকে বেরোনোর সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল।'
টানা তিন মাস তিনি আফগানিস্তানেই লুকিয়ে থেকেছেন। এরপর দুই সপ্তাহ আগে মুখ ঢেকে বোরকা পরে সন্তানদের নিয়ে হেরাতগামী একটি বাসে ওঠেন। হেরাত থেকে রওনা দেন ইরান সীমান্তের দিকে।
পালানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'তালেবানের একটি দিক উল্লেখ না করলেই নয়, তারা কখনো মুখ ঢাকা নারীদের চেহারা দেখাতে বাধ্য করে না।'
তালেবান চেকপয়েন্টে পরিচয় ফাঁস হলে মাশিদ গ্রেপ্তার হতেন নিশ্চিত। তবে তালেবান কর্মকর্তারা সাবেক সরকারের একজন এমপি বোরকা পরে পালাবেন সেকথা হয়তো ভাবেননি বলে জানান তিনি।
মাশিদ বলেন, 'তাদের ধারণা সাবেক সরকারের সব রাজনৈতিক ও নারী অধিকার কর্মীদের বিদেশিরা সাথে নিয়ে গেছে।'
টানা ১০ দিন ধরে ইরান পাড়ি দিয়ে মাশিদ শেষমেশ আশ্রয় নিয়েছেন তুরস্কে। কিন্তু, এখানে থাকার ইচ্ছে নেই তার। মাশিদ মনে করেন, তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হলেই তাকে বহিষ্কার করা হবে।
আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অধীনে নারী ও কন্যা শিশুরা যে ভয়াবহ পরিণতির শিকার হচ্ছেন বিশ্বকে তা জানানো অব্যাহত রাখতে চান মাশিদ। একইসঙ্গে, চালাতে চান পরিবর্তনের আন্দোলন। তবে আফগানিস্তানে থাকা আত্মীয়-পরিজনদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই নিজ পরিচয় এই মুহূর্তে গোপন করছেন।
ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিশ্চিত হয়েছে যে, ৬৯ জন নারী এমপির মধ্যে ৯ জন এখনও আফগানিস্তানে লুকিয়ে রয়েছেন।
বাকিরা উদ্ধারকারী ফ্লাইটে জায়গা পেতে সমর্থ হন। তাদের মধ্যে ৪৬ জন বর্তমানে ইউরোপ ও তুরস্কে রয়েছেন। বাকিরা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কাতারসহ বিশ্বের অন্তত এক ডজন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
এমন আরেক এমপি হলেন সেরিনা (ছদ্মনাম)। স্বামী ও তিন মাসের সন্তানসহ তাকে জার্মানিতে আনে উদ্ধারকারী ফ্লাইট। আফগানিস্তান ছাড়ার সময় সেরিনা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। এখন তার অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা চলছে। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী তিনি। পরিবারসহ থাকছেন আশ্রয়প্রার্থীদের একটি শিবিরে।
এভাবে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে তা কল্পনাও করতে পারেননি সেরিনা। আগে কখনোই ইউরোপ আসেননি। এবার অজানা মহাদেশে এসে বুকের গভীরে এক হাহাকার কাজ করে তার। এমন দেশে আশ্রয় চাইছেন যে দেশের সংস্কৃতি অনেক ভিন্ন, যার ভাষাও তিনি জানেন না।
'জীবনে অনেক প্রতিকূল দিন পার করেছি। এখনও খারাপ অবস্থার মধ্যেই আছি। কিন্তু, সাধারণ আফগানরা যেসব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন- যখন তা জানতে পারি তখন নিজের সব ব্যথা ভুলে যাই'- তিনি বলছিলেন।
বর্তমান অবস্থায় আফগানিস্তানে ফেরার প্রশ্নই ওঠে না বলে জানান সেরিনা। স্বামী, সন্তানসহ জার্মানির কোনো শহরে কবে ঘর-সংসার শুরু করতে পারবেন এখন সেই অপেক্ষার দিন গুনছেন। একটু থিতু হয়ে ফেলে আসা মাতৃভূমির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে চান।
তিনি বলেন, 'যুদ্ধ ও দুর্দশার মধ্যেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তবুও আমি নিজ সন্তানকে আফগানিস্তানের সংস্কৃতি, প্রথা শিক্ষা দিয়ে বড় করতে চাই। আমার লক্ষ্য, ওর ভেতরে যেন মাতৃভূমির টান থাকে।'
নারী এমপিদের অনেকে কানাডায় যেতে যান, কারণ দেশটি পাঁচ হাজার আফগান শরণার্থী গ্রহণের কথা জানিয়েছে।
তবে যেখানেই যান না কেন, মাশিদের মতো অধিকাংশ এমপি আফগান নারী অধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে চান। এজন্যই তারা নির্বাসনে নারীদের পার্লামেন্ট গঠন করতে চান। এই পার্লামেন্ট আফগানিস্তানে নারী অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে তালেবানকে চাপে রাখবে।
নারী এমপিদের উদ্ধারকারী একটি এনজিও প্রথমে এই আইডিয়া দেয়। তবে ইউরোপে থাকা কিছু আফগান এমপি সানন্দে এ প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছেন। আগামীতে এটি বাস্তবায়িত হবে কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
প্রস্তাবটির একজন বড় সমর্থক শিনকাই কারোখাইল। এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি ছিলেন কানাডায় আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত। এখন তিনি টরেন্টোর বাইরে এক ছোট শহরতলীতে বাস করছেন। তিনিও কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী।
গত ১৫ আগস্টের দ্রুত ঘটে চলা ঘটনাক্রম তুলে ধরে শিনকাই বলছিলেন, 'সকালে জানলাম আমার প্রদেশ তালেবানের দখলে, বিকেলে জানলাম প্রেসিডেন্ট পালিয়েছেন। দিনশেষে আমাকে বিস্মিত করার মতো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।'
আফগানিস্তানে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের আইন পাসে অন্যতম চালিকাশক্তির ভূমিকা পালনকারী ছিলেন তিনি। শিনকাই সতর্ক করে বলেন, 'কোনো কিছু অর্জন করতে চাইলে নির্বাসনে থাকা সব নারী এমপিকে তাদের বিভেদ ভুলে ঐক্যবধ্য হতে হবে।'
'তাদের প্রত্যেকে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আগে তাদের সবার গুরুত্বের বিষয় ছিল আলাদা। ছিল ভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ। কিন্তু, আমরা সব হারিয়েছি। আমাদের যত বিভেদের উৎস ছিল, সেসবও হারিয়েছে। তাই এখন দেশ বাঁচাতে ও জনগণকে সমর্থন দেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- আমাদের তা উপলদ্ধি করার এটাই প্রকৃত সময়। আফগান নারীদের বঞ্চণার কথাও তার মাধ্যমে উঠে আসবে।'
নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে থাকেন আরেক আইনপ্রণেতা এলাই এরশাদ। বাড়িতে সেদিন রান্না করছিলেন আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাদী একটি পদ। কিন্তু, স্থানীয় বাজারে সব উপকরণ খুঁজে পেতে বেশ সমস্যায় পড়েন।
সঠিক উপকরণ পাওয়াকে তিনি কেন বেশি গুরুত্ব দেন তা জানিয়ে এলাই বলেন, 'খাবার আমাকে নিজ দেশের মানুষের কথাও মনে করিয়ে দেয়। তারা অনেকেই একবেলাও খেতে পারছেন না।'
আফগানিস্তানের সবশেষ নির্বাচনে নির্বাচিত হতে পারেননি এলাই এরশাদ। তবে আগের পার্লামেন্টে তিনি সদস্য ছিলেন। এমপি হিসেবে তার অভিজ্ঞতা এক যুগেরও বেশি। পরবর্তীতে তিনি আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির একজন মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
কাবুল দখলের পর তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে তালেবান। কিন্তু, এলাই আত্মগোপনে না গিয়ে প্রকাশ্যেই একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে চেপে দেশত্যাগ করেন।
তিনি আবার দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তালেবান সরকারের পরিচিতদের থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার আশা করছেন তিনি। দেশের বাইরে থেকে সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব- তিনিও এমন ধারণাই বিশ্বাস করেন না।
'বিদেশে থেকে কিছু করা যাবে না। আমাদের আফগানিস্তানে থাকতে হবে। সমাধান আফগানিস্তানেই রয়েছে এবং সেখানেই আমাদের তা খুঁজে বের করতে হবে'- বলছিলেন এলাই।
তিনি দেশে ফিরে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সাথে কন্যা শিশুদের জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজ করতে চান।
দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে এলাই বলেন, 'হোক তালেবানের সরকার, আমরা কাজ করে যাব। সমস্যা দেখে পালালে, সমস্যা চিরকাল রয়েই যাবে।'
সূত্র: বিবিসি