আগামী বছরেই পৃথিবী পাবে বন্যা সহনশীল ভাসমান শহর
সমুদ্রতীরে মানুষ হাজারো জনপদ গড়েছে। বিক্ষুদ্ধ উর্মিমালায় ভাসিয়েছে পাহাড়সম সব বাণিজ্যতরী। এবার সে সাগরের বুকেই শহর গড়বে মানুষ। এমনই একটি প্রকল্পে সবুজ সংকেত দিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান নগর কর্তৃপক্ষ।
অনুমোদন পাওয়ায় আগামী বছর থেকেই ভাসমান এ মানব বসতির প্রথম মহল্লা নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
পরস্পর সংযুক্ত অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম মিলে গড়ে উঠবে প্রস্তাবিত 'ভাসমান শহর'। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে এতে ১০ হাজার মানুষ থাকতে পারবে বলে জানিয়েছেন এর মূল নকশাকারীরা। তাদের মতে, উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হুমকি মোকাবিলার অনন্য সমাধান হবে এ প্রকল্প।
ওশিয়ানিক্স প্রজেক্ট ২০১৯ সালে এ প্রকল্পের মূল নকশা প্রকাশ করে। যার উদ্দেশ্য ভবিষ্যতের বন্যামুক্ত উপকূলীয় শহর নির্মাণ। বুসানে প্রথম প্রকল্পটি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে পরীক্ষামূলকভাবে।
ওশিয়ানিক্স প্রজেক্ট গ্রুপের এ প্রকল্প ডিজাইনার, স্থপতি ও প্রকৌশলীদের যৌথ প্রচেষ্টার ফসল। ২০১৯ সালে উপকূলীয় বন্যামুক্ত এ প্রকল্পের পরিকল্পনা উন্মোচন করা হয়। তারপর থেকেই একটি পরীক্ষামূলক আবাস নির্মাণে সমুদ্রের উপযুক্ত স্থান খোঁজা হচ্ছিল।
এরপর গত মাসে বুসান নগর কর্তৃপক্ষ ও জাতিসংঘের নগর উন্নয়ন সংস্থা ইউএন হ্যাবিটাটের সঙ্গে চুক্তি সই করে গ্রুপটি। ফলে প্রথম ভাসমান নগর পাবেন বুসানবাসী।
যেভাবে হবে নির্মাণকাজ
ভাসমান প্লাটফর্মগুলো শহরের নানান অবকাঠামোর আকার ও ওজন অনুসারে প্রথমে কারখানায় উৎপাদন করে তারপর সেগুলো সাগরে ভাসানো হবে। এগুলো সমুদ্রের পানির উচ্চতা হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করবে।
প্রতিটি মহল্লার আকার হবে পাঁচ একর, যাতে সাততলা সমান উঁচু ভবনে থাকতে পারবেন ৩০০ জন বাসিন্দা।
তবে ভবিষ্যতে রয়েছে শহরের পরিধি আরো বাড়ানোর সুযোগ। পায়ে হাঁটার পথ ও বাইসাইকেল চলার ভাসমান পথের মাধ্যমে অনেকগুলো আবাসিক এলাকার নেটওয়ার্ক তৈরি করা যাবে।
প্রকল্পের নকশায় নেতৃত্বদানকারী ডেনিশ সংস্থা বিয়ার্ক ইঙ্গেলস গ্রুপ (বিআইজি) জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় একটি পোতাশ্রয়ের চারপাশে মহল্লার সংখ্যা বাড়ানো যাবে। যার প্রতিটিতে ১ হাজার ৬৫০ জন থাকবেন।
ধীরে ধীরে সব মহল্লা মিলে ১০ হাজার মানুষের নগরে রূপ নেবে, যাকে তারা বলছেন ওশিয়ানিক্স সিটি। এই শহরে রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে চাষাবাদ ও বিনোদন স্থাপনা, সবই থাকবে।
সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূল অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বুসান। গেল বছর পরিবেশবাদী সংস্থা গ্রিনপিস সতর্ক করে জানায়, ২০৩০ সালের মধ্যেই সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে শহরটির বিখ্যাত হায়েনদায়ে সৈকত। এজন্যে ওশিয়ানিক্স সিটির জন্য বুসানকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
ইতঃপূর্বে জার্নাল সাসটেইনেবিলিটিতে প্রকাশিত এক গবেষণা জানায়, ২০২০ সাল পর্যন্ত বিগত ১০ বছরে সামুদ্রিক বন্যায় দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে বুসানে।
দূষণমুক্ত ও স্বনির্ভর শহর
প্রস্তাবিত আবাসিক এলাকাগুলো হবে স্বনির্ভর। বাসিন্দারা নিজেদের দরকারি খাদ্য ও শক্তি নিজেরাই উৎপাদন করতে পারবে। শূন্য দূষণ নীতির মাধ্যমে বর্জ্যকে আবার পণ্যে রূপ দেওয়া হবে। একে বলা হয় 'আবদ্ধ চক্র' বা ক্লোজড লুপ সিস্টেম।'
সব মহল্লায় থাকবে কমিউনিটি ফার্ম, অ্যাকুয়াপনিক বা মাটি ছাড়াই খাদ্য উৎপাদনের অবকাঠামো। মাটিতে ফসল উৎপাদনের জন্য থাকবে জৈব সার ভিত্তিক বাগান। আবাসিক এলাকার আশেপাশেই ভাসমান ক্ষেতে উৎপাদিত হবে সি-ফুড।
অনাবাসিক প্ল্যাটফর্মগুলোয় বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উইন্ড টার্বাইন এবং সৌর বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল থাকবে। এছাড়া, সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের উপকরণ বাঁশও চাষ করা হবে।
বিআইজির প্রস্তাবিত নগর নকশায় রাখা হয়েছে মিঠা পানি উৎপাদনের ব্যবস্থা। থাকবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ সাগরের নোনা পানি পরিশোধনের স্থাপনা।
চলাচলের জন্য নগরবাসী ব্যবহার করবেন সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত যানবাহন। ওয়াটার ট্যাক্সি এবং সৌরবিদ্যুৎ চালিত ফেরি এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় যাত্রীবহন করবে। মূল ভূখণ্ডের বুসানের সাথেও ভাসমান শহরের যোগাযোগ রক্ষা করবে তারা।
ওশিয়ানিক্স এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ইতাই মাদামোম্বে বলেন, বুসান উপকূলে পরীক্ষামূলক আবাসিক প্রকল্পটি নির্মাণ হওয়ার পর ২০২৫ সাল নাগাদ সেখানে মানুষ বসবাস করতে পারবে।
বুসানে ব্যবহৃত প্রযুক্তি অন্যান্য স্থানে ব্যবহারের জন্য তার সংস্থা আরো ১০টি দেশের সরকারের সাথে আলোচনা করছে বলে জানান তিনি।
বুসানের মেয়র পার্ক হিয়ং জুন এক বিবৃতিতে নতুন চুক্তিটির প্রশংসা করে বলেছেন, 'উপকূলের শহরাঞ্চল আজ জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে। তাই মানুষ, প্রকৃতি ও প্রযুক্তি একসঙ্গে সহাবস্থান করবে আমাদের এমন স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে।'
ইউএন হ্যাবিটাটের পরিচালক মায়মুনাহ মোহাম্মদ শরীফ পরীক্ষামূলক ভাসমান শহরের জন্য বুসানকে 'আদর্শ' স্থান বলে উল্লেখ করে বলেন, 'জলবায়ু সহনশীলতা কৌশলের অন্যতম হাতিয়ার হবে টেকসই ভাসমান শহর। পানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বদলে আমাদের তার ওপরই শান্তিপূর্ণ বসবাসের উপায় শিখতে হবে।'
- সূত্র: সিএনএন