পশুপালনকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাইলে এ টিপসগুলো আপনার লাগবেই লাগবে
তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব শৈশব থেকেই গবাদিপশুর প্রতি একপ্রকার আলাদা টান অনুভব করতেন। প্রতি ইদে বিপুল আগ্রহ নিয়ে কুরবানীর পশু কিনতে হাটে যেতেন। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ড থেকে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে বিপ্লব দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি তাদের বগুড়ার পারিবারিক আটার মিলটির দ্বায়িত্ব নেন। এর পাশাপাশি ছয়টি গরু ও মহিষ কিনে একটি খামার শুরু করেন। খামারটি মূলত বিপ্লব ব্যবসায়িক উদ্দশ্যের চেয়ে ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে শুরু করেছিলেন।
এভাবেই বিপ্লবের খামারের সূত্রপ্রাত। বিপ্লবের একনিষ্ট আগ্রহের দরুণ সেই ছোট্ট খামার আজ ফুলেফেঁপে এক বিরাট পশুশালায় পরিণত হয়েছে। সেখানে এখন শ'য়ে শ'য়ে পশুর বিচরণ। কয়েকশ' গরু এবং ষাঁড়, কয়েক ডজন ছাগল ও কয়েকটি হরিণ নিয়ে বিপ্লবের খামার আজ পরিপুষ্ট।
প্রথম দিককার পশু বিক্রির অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বিপ্লব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "২০১৫-১৬ সালের দিকে আমার কিছু নিকটাত্মীয় আমার কাছ থেকে গবাদি পশু কেনে। তাদের কাছে আমি স্বল্পলাভে মোট ১২ টি ষাঁড় বিক্রি করেছিলাম। সেই প্রথম আমার মাথায় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পশুপালনের চিন্তা আসে।" পরের বছরগুলোতে বিপ্লবের পশুবিক্রির পরিমাণ দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে।
বিপ্লব আরো জানান, "২০ টি থেকে ৩০ টি, পরের বছর ৬০ টি, এর পরবর্তী বছর ৭০ টি এবং এ বছর ইদ-উল-আজহার আগে আমি ২৬৯ টি পশু বিক্রি করেছি।" এ বছর ইদ-উল-আজহা থেকে আগামী বছর ইদ-উল-আজহার মধ্যে ৩৬৫ টি পশু বিক্রি করা বিপ্লবের টার্গেট এবং ইতোমধ্যে তিনি ১২০ টি পশু বিক্রি করে ফেলেছেন।
"আমি আশা করি আগামী ছ'মাসের ভেতর আমার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। আজকেও খামার থেকে ছয়টি পশুর চালান দেওয়া হয়েছে। আর খামারে বর্তমানে পশুর সংখ্যা ১৮০ টি। কুরবানীর আগে এ সংখ্যা ৩৫০ টি-তে উন্নীত হবে।"
পশুপালন কেন?
বিপ্লব সেই পশুপালকদের একজন যারা শুধু ডেইরি ফার্মিং নয় মাংসের চাহিদা পূরণের জন্যে পশুপালন করে থাকেন। বাংলাদেশে লাল মাংসের বাজারের হাল খুব সুখকর নয়। সরকার যদিও বলছে যে বাংলাদেশ লাল মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের বাজার বলছে ভিন্নকথা। বাংলাদেশে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৬০০ টাকা যেটি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এ দেশে একমাত্র ধনী-অভিজাতবর্গই গরুর মাংস কেনার সামর্থ্যশালী। দরিদ্রদের মাংসের গন্ধ শুঁকে পেট ভরানো ছাড়া উপায় নেই। সরকারি হিসেবের সাথে বাজারের প্রকৃত অবস্থার খুব কমই মিল পড়ে।
বাজার বিশেষজ্ঞগণ এর কারণ হিসেবে কয়েকটি দিক তুলে ধরেছেন - গরুর হাটে অবৈধভাবে চাঁদাবাজি, অধিকমাত্রায় করারোপ, চাহিদামাফিক পশু সরবরাহের অভাব, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে সীমান্তে ভারতের পশু পাচারের ব্যাপারে কঠোর নজরদারি।
চাঁদাবাজিসহ পূর্বোল্লিখিত কারণগুলোর সমাধান করলেই যে পশু উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এমনটি ভাবাও সমীচীন হবে না। পশুপালনে আগ্রহীদের এগিয়ে আসতে হবে। তবেই লাল মাংসের বাজারে চাহিদা ও বিপণনের সঠিক ভারসাম্য বিরাজ করবে।
এ ব্যাপারে বিপ্লবের অভিমত হল, "আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি মানে এই নয় যে আমরা মাংস খেতে একদম অপছন্দ করি। মাংস খাওয়ার প্রবণতা দিনদিন বাঙালির ভেতর বাড়ছে। সে মাংস আমরা দেশে উৎপাদনের বদলে ভারত থেকে আমদানি করছি। পৃথিবীর আরো কয়েকটি দেশ থেকে আমাদের দেশে কাঁচা মাংস রপ্তানি হয়। এসব কারণেই আমাদের দেশে লাল মাংসের বাজারের এমন দশা। এ থেকে মুক্ত হবার উপায় একটিই। আমাদের নিজেদের পশুপালনের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আগ্রহীরা একে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারেন। এ পেশার গুরুত্ব দিনদিন বাড়ছে। আর সেরকম হলে একদিন আমরা দেশের চাহিদা পূরণ করে লাল মাংস বিদেশেও রপ্তানি করতে পারব।"
নবাগতদের জন্য ফার্মিং হ্যাকস
বিপ্লব তার এক দশক কালের পশুপালনের অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন উদ্যোক্তা বা আগ্রহীদের কিছু পরামর্শ প্রদান করেছেন। বুলেট পয়েন্ট আকারে সেগুলোর বর্ণনা দেওয়া হল –
- আপনি এ রাস্তায় নতুন হলে হুট করে মোটা অঙ্কের টাকা এখানে বিনিয়োগ করতে যাবেন না। অল্প করে টাকা ঢালুন, বেশি করে শিখুন। প্রথমবারে পাঁচ-সাতটি পশু দিয়ে শুরু করুন। অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথেসাথে বিনিয়োগও বাড়ান।
- কোনো জায়গা থেকে প্রশিক্ষণ নিন। খামারে গিয়ে সরেজমিনে দেখুন সবকিছু। ফার্স্ট-হ্যান্ড বা মৌলিক প্রশিক্ষণ ছাড়া পশুপালনে হাত দেবেন না। উল্লেখ্য, বিপ্লব নিজেই পশুপালনের প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন। আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন।
- আপনি যদি একে পুরোপুরি পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান তাহলে সর্বাত্মকভাবে খামারের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করুন। একটি গরুর পেছনে মাসে মোটামুটি ৬০০০ টাকা ব্যয় হয়। আর একশ' গরু একসাথে পালন করলে গরুপ্রতি খরচ পড়ে ৪০০০ টাকা। "এর মানে এই নয় যে আমি আপনাদের একশ' গরু একসাথে কিনতে বলছি" বিপ্লব বলেন।
- ফার্মিং শুরুর প্রথমদিকেই পশুগুলোকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফেলুন। যেমন ধরুন, আপনার খামারে মোট দশটি গরু থাকলে সেখানে তিনটি ১৫ লিটার দুধ প্রদানকারী তিনটি গাভী থাকা উচিত। প্রতিদিন সেখান থেকে যে ৪৫ লিটার দুধ উ ৎপন্ন হবে সেটি লিটারপ্রতি ৫০ টাকায় বিক্রি করে আপনি খরচের একটি অংশ তুলতে পারেন।
- শুধু ইদে পশু বেচার জন্য পশু পালন করবেন না। খেয়াল রাখবেন সারা বছরই যেন আপনার খামার থেকে পশু বিক্রির একটি প্রবাহ বজায় থাকে। ইদে বা কোনো মরসুমে বিক্রি করে অধিক লাভের আশায় পশু গোয়ালে ফেলে রাখা ঠিক নয়।
- আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সঠিক পরিকল্পনায় আগানো। যদি দশ লাখ টাকা আপনার বাজেট হয় তাহলে দু'লাখ টাকা দিয়ে খামার নির্মাণ করুণ, ছ'লাখ টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করুন (এর ভেতর দু'লাখ টাকা রাখুন সুস্থ, সবল গাভী কেনার জন্য), বাকি দু'লাখ পশুর খাদ্যের পেছনে ব্যয় করুন।
এতগুলো পশুর স্বাস্থ্যরক্ষা বা রোগের প্রতিকার-প্রতিরোধের ব্যাপারে বিপ্লবকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, "খামার পরিব্যাপ্ত হওয়ার পরে আমি একজন পশুচিকিৎসককে নিয়োগ দেই যার কাজ প্রতিদিন খামারে এসে পশুগুলোর হেলথ চেক-আপ করা। এছাড়া যেকোনো সময় দরকার হলে তাকে খবর দিলেই তিনি চলে আসেন। আর খামারের কর্মচারীরা সাধারণ কিছু হেলথ-ইস্যুর (যেমন : জ্বর, ডায়রিয়া, পেটব্যামো ইত্যাদি) ব্যাপারে জানেন।"
"এছাড়াও আরো কিছু ব্যাপারে আমাদের নজর রাখতে হয়। সময়মতো টিকা প্রদান সেরকম একটি বিষয়। কৃমির টিকা দিলে পশুগুলোর খাদ্য ও হজমশক্তি বাড়ে। পা ও মুখের রোগগুলোর ব্যাপারে আমাদের আলাদাভাবে সচেতন থাকতে হয়। সময়মতো পা ও মুখের রোগের টিকা না দিলে পশুর সুষম বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সিডিউলে দু'মাস পিছিয়ে যেতে হয়।"
খামার ও পশুপালনে গৃহীত স্থান সংকুলানের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বিপ্লব উত্তর দেন যে তার খামারে দুটো ২২০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ৩৩ ফুট প্রস্থের দুটো চালাঘর আছে। কয়েকটি চালাঘর ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ৫০ ফুট প্রস্থের। মোট ১০ বিঘা জায়গা জুড়ে বিপ্লবের পশুর খামার। আর তৃণভূমির আয়তন ১২ বিঘা।
বিপ্লব তার খামারে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি কোয়ারেন্টাইন চালাঘর স্থাপিত করেছেন। নতুন কোন পশু আনা হলে আগে কয়েক সপ্তাহ সেখানে রাখা হয়। একসাথে ৩০ টি পশুকে এ চালাঘরে রাখা সম্ভব। এ ব্যাপারে বিপ্লবের অভিমত, "নতুন পশুর ভেতর কোনো রোগ বালাই থাকলে সেটি যেন খামারের বাকি পশুগুলোকে আক্রান্ত করতে না পারে তাই এই ব্যবস্থা।"
এতকিছু শুনে কঠিন লাগলেও বিপ্লব নতুন খামারিদের আশ্বস্ত করে বলেন, "যদি ভাবেন যে এতকিছু সামলে ওঠা খুব কঠিন তাহলে ভুল ভাবছেন। আমি দীর্ঘদিন ধরে খুব ভালোভাবে এগুলো সামলে আসছি। আমার কাছে এগুলো খুব কঠিন মনে হয়নি।"
- মূল ফিচারটি পড়ুন: Want to start a new career in farming? Here is how to begin
- ভাষান্তর : মেহেদি হাসান