কাওয়ালি এবং ঢাকার কাওয়ালের খোঁজে…
পুরো ঘর জুড়ে মানুষ। মাথায় বড় টুপি, পরনে পাঞ্জাবি, হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে বসে আছেন একদল ব্যক্তি। উর্দু-ফারসী শব্দের মিশেলে সমস্বরে খোদা-রাসুলের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে যাচ্ছেন তারা। এরকম কোনো চিত্র আমাদেরকে চিরপরিচিত কাওয়ালি সংগীতের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কাওয়ালি এক প্রকার ইসলামিক আধ্যাত্মিক গান। কাওয়ালি যারা পরিবেশন করেন বাংলাতে তাদের কাওয়াল বলা হয়। গানের বিভিন্ন ধাপে কাওয়ালগণ স্রষ্টার প্রতি ভক্তি, প্রশংসা ইত্যাদি বর্ণনা করে থাকেন। কাওয়ালের দলে একজন মূলত গান করেন। দলের অন্যরা ধুয়া (তাল দেয়া) ধরেন। উপমহাদেশের এই সংগীতের বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে আমাদের ঢাকাসহ সারাদেশে এর বিস্তৃতির গল্প।
ইতিহাস
কাওয়ালি শব্দটি আরবি 'কওল' থেকে এসেছে। কওল-এর আভিধানিক অর্থ বলা। মূলত, এখানে রাসুল (সাঃ) সম্পর্কিত কথাবার্তাকেই নির্দেশ করা হয়েছে। এদিক থেকে কাওয়ালের অর্থ দাঁড়ায়, যিনি কথাগুলো (রাসুল স. সম্পর্কিত) বারবার উচ্চারণ করেন। কাওয়ালি সুফিদের গান। বহুকাল আগে সুফী-সাধকগণ খোদার প্রেমে মশগুল হয়ে বিশেষ কোনো নামের জিকির করতেন। অর্থাৎ, একই শব্দ বা বাক্য পুনরাবৃত্ত করতেন। সুরের মাধ্যমে এই পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাকে কাওয়ালি বলা হতো। অষ্টম শতাব্দীতে পারস্যের বিভিন্ন সুফি আস্তানায় এধরণের গানের আসর বসতো। একে মাহফিল-ই-সামা নামেও অবহিত করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, ৯০০ খ্রিস্টাব্দে সুফি মতবাদ ও দর্শন বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। দার্শনিক কথাবার্তার সমন্বয়ে রচিত হওয়া এসব গানের আয়োজন তৎকালীন সুফিবাদ চর্চার অন্যতম মাধ্যম ছিল। কবি আবু হামিদ আল গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিস্টাব্দ) এসব গান রচনার জন্য পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত গজলের অন্যতম স্রষ্টা তিনি।
ভারতে সুফিবাদের মধ্যে চার ধরনের ধারা লক্ষ্যণীয়। এগুলো হল- চিশতীয়া, নিজামিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া এবং নকশেবন্দীয়া। চারধারার মধ্যে চিশতীয়া ধারার অনুসারীগণের মাধ্যমেই বেশিরভাগ কাওয়ালির প্রচার এবং প্রসার লাভ করে। চিতশীয়া ধারার প্রবর্তক হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রা.) নিজেও এই ধর্মীয় গানের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। হযরতের বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন কুতুবুদ্দদিন বখতিয়ার কাকী (রহ.) এবং দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়া (র.) প্রমুখ। বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত আছে যে, কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী (র.) সামা সংগীতে টানা কয়েকদিন মশগুল থাকতেন। এরপর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (র.) দরবারেও কাওয়ালির আসর বসতো। নিজামুদ্দীন আউলিয়ার (র.) প্রিয় শিষ্য হযরত আমির খসরু (র.) কাওয়ালি গানকে রীতিসিদ্ধ করেন। অর্থাৎ, কাওয়ালিকে একটি নিয়মের মধ্যে এনে প্রচার করেন তিনি। এজন্য তাকে কাওয়ালীর জনক বলা হয়। সুফিবাদ চর্চার পাশাপাশি তিনি একাধারে কবি, গায়ক এবং একজন যোদ্ধাও ছিলেন। তার উপাধি ছিল 'তুত-ই-হিন্দ' বা হিন্দের তোতা পাখি।
একাদশ-দ্বাদশ শতকে সুফিরা উপমহাদেশের মুলতান এবং পাঞ্জাবে আসেন। ক্রমেই তারা বিহার, বাংলা এবং দক্ষিণে তাদের বসবাস গড়ে তোলেন। তাদের মাধ্যমেই পারস্যের কবিতাগুলো চিশতীয়া তরিকার সুফি হযরত আমির খসরু (রহ.) এর কাছে চলে আসে। তিনি এসব কবিতার সাথে স্থানীয় ভাবধারা যুক্ত করে কাওয়ালির পূর্ণাঙ্গ রূপদান করেন। আমির খসরু হিন্দি, পূরবী এবং ফারসি ভাষায় তার কাওয়ালি গানগুলো রচনা করেছিলেন। 'খেয়াল' নামক আরেক প্রকার গানেরও স্রস্টা তিনি। জানা যায়, তিনি প্রয়োজন মতো একতারা, তবলা ইত্যাদি বানাতেন। তার পীর নিজামউদ্দিন আউলীয়া (র.) দরবারে প্রায়ই একতারা বাজিয়ে কাওয়ালি করতেন।
বাংলায় কাওয়ালিকে কে বা কারা সূচনা করেছেন তার সম্পর্কে সঠিক কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়না। এদেশে সুফিগণ আসার পরে তারাও কাওয়ালি করতেন। ঐতিহাসিক ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে, চিশতীয়া তরিকার সাধকেরা সামা গানের তালে দাঁড়িয়ে নৃত্য করতেন। একপর্যায়ে তারা ভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তখন তাকে চরম পর্যায় বলে গণ্য করা হতো। সুফী মতানুসারে এ অবস্থার নাম 'ফানা হওয়া'। কাওয়ালির মাধ্যমে খোদার প্রেমে মগ্ন হবার কথা সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতীও বলতেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় বাংলাতেও সুফি সাধকদের দরগা থেকেই কাওয়ালির প্রসার হয়।
ঢাকায় কাওয়ালি সংগীত
ঢাকায় বহু পীরের দরগা শরিফ রয়েছে। ঢাকার নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে বহু সুফির মাজার। বাংলার সুফীগণ অধিকাংশই চিশতিয়া তরীকার অনুসারি। চিশতিয়া দরবারের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল কাওয়ালি। সে হিসাবে এসব মাজারেও কয়েক শতক ধরে কাওয়ালি সংগীত প্রচলিত আছে। আবার, ঢাকার নবাবদের বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিলো কাওয়ালি। শুরুতে নবাবের অনুরোধে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাওয়ালগণ বাংলাতে আসতেন। নবাবরা তখন কাওয়ালির ভক্ত হয়ে যান। ঢাকার লোকজন তখন কাওয়ালি চর্চা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ঢাকার কাওয়ালগণও নবাবদের আসরে কাওয়ালি পরিবেশনের সুযোগ পান। নবাবরা নানা সময় কাওয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এভাবে, ঢাকার সংস্কৃতির ইতিহাসে কাওয়ালি বিশেষ জায়গা দখল করে নেয়।
কাওয়ালির আসরে যেভাবে বসা হয়
কাওয়ালগণ এবং শ্রোতারা একটি বিশেষ নিয়মে মাটিতে কিংবা দরগার মধ্যে বসেন। মূল গায়ককে মোহরি বলা হয়। তিনি মাঝখানে বসেন। তিনি সংশ্লিষ্ট পীরকে সম্মান জানাতে দরগার দিকে মুখ করে বসেন। দলের অন্যান্য সদস্যগণ তার পেছনে বসেন। আর যারা গানের সাথে তাল দেন, তারা মূল গায়কের সামান্য পেছনে বসে থাকেন। সাধারণত মোহরির দুপাশে হারমোনিয়াম, দফ আর মাঞ্জিরা, তবলা ইত্যাদি নিয়ে বাদকগণ বসেন। কোরাস গাওয়ার শিল্পীগণ দুপাশে সারিবদ্ধ হয়ে বসেন। দলে দ্বিতীয় আরেকজন মোহরি থাকেন। তিনি মূল কাওয়ালকে গানের বিভিন্ন পর্বে সহায়তা করেন।
কাওয়ালির বিশেষ ভাবপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয় দলের সকলের সমবেত কন্ঠ আর হাততালি দেয়ার মাধ্যমে। এজন্য কাওয়ালির আসর শুরুর দিকে মোহরি তার পীরের শানে (উদ্দেশ্যে) ভক্তিমূলক কালাম পাঠ করে থাকেন। এসময় দলের অন্যান্যরা নীরবতা পালন করেন। ঢাকার বিখ্যাত নাদিম কাওয়াল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কাওয়ালি শুরুর আগেই রাসুল (স.) প্রতি সম্মানার্থে আমরা হামদ ও নাত পাঠ করে থাকি। তারপর স্বীয় পীরের স্মরণে একটি গান গেয়ে অনুষ্ঠান শুরু করি। ধীরে ধীরে কাওয়ালির ভাব-গাম্ভীর্য আসলে দর্শক-শ্রোতারাও উদ্বেলিত হন'।
ঢাকার কাওয়াল
আদি ঢাকার অধিবাসীরা নবাব আমলে কাওয়ালির আধিপত্য রাখলেও এখন তা নেই বললেই চলে। পুরান ঢাকার আজিমপুর, বকশিবাজার, লালবাগে, মোহাম্মদপুর গজনবি সড়কের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় এবং মিরপুরের কিছু এলাকাতে ঢাকার কাওয়ালদের বসবাস।
মিরপুরের বেনারসি পল্লী নিবাসী নাদিম এহতেশাম রেজা খাঁ-র মতে, তিনিই একমাত্র বংশগত কাওয়াল। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, তার মামাতো ভাই ভারতে, চাচাতো ভাই পাকিস্তানে কাওয়ালির সাথে সম্পৃক্ত আছেন এখনো। তার পিতা এহতেশাম রেজা খাঁ, দাদা কেয়াম রেজা খাঁ, এবং তাদেরও পূর্বপুরুষ নবী রেজা খাঁ, ওয়ালী রেজা খাঁ। তারা প্রত্যেকেই কাওয়াল ছিলেন। নাদিম কাওয়াল জানান, ঢাকার হাইকোর্ট মাজারে খাজা শরফুদ্দিন চিশতী (র.)-এর দরগা, মিরপুরে হজরত শাহ আলী বোগদাদী (র.)-এর দরগাতে তারা এখনো নিয়মিত কাওয়ালি পরিবেশন করে থাকেন।
ঢাকার অন্যতম কাওয়াল হিসাবে পরিচিত হোসেন শাহাবুদ্দিন। থাকেন মোহাম্মদপুরে। দীর্ঘ পাঁচ যুগেরও বেশি সময় ধরে কাওয়ালি এবং এই ধারার গানের সঙ্গে আছেন তিনি। মোহাম্মদপুরে 'নিয়াজি ব্রাদার্স'-এর নিয়াজ হাসানও যুক্ত আছেন কাওয়ালির সাথে।
আজিমপুর কবরস্থানের বিপরীতে সরু গলি ধরে একটু হেটে গেলেই মোবারক শাহ সাহেবের বাড়ি। লোকমুখে ছোট দায়রা শরীফ নামেই অধিক পরিচিত। এখানেই জনপ্রিয় কাওয়াল সামির হোসেনের স্থায়ী নিবাস। তারও পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ কাওয়ালির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। দায়রা শরীফের বর্তমান খাদেমও তিনি।
ঢাকাই কাওয়ালগণ সাধারণত উর্দু ভাষায় রচিত কাওয়ালিই পরিবেশন করে থাকেন। উর্দু ভাষায় রচিত 'ভার দ ঝোলি মেরি ইয়া মোহাম্মদ...', 'দমাদম মাস্ত কালান্দার...', 'অ্যায় মেরে মুর্শিদ, মেরে কামলিওয়ালা', 'আলি কেহ রাহি হ্যায়', ইত্যাদি কাওয়ালি সংগীত এখনো তুমুল জনপ্রিয়। এসব গানের রচয়িতা আমির খসরু, বুল্লে শাহ, সাবরি ব্রাদার্স প্রমুখ ব্যক্তিগণ। এসব সংগীতের কালামে যেন মিশে আছে অপূর্ব খোদাপ্রেম। শাহাবুদ্দিন কাওয়াল, নাদিম কাওয়ালেরা বাংলাতেও কাওয়ালী করেন। কিছু কাওয়ালগণ বাংলা-উর্দু মিলিয়ে গান পরিবেশন করেন।
ঢাকার কমবেশি সকল দরগাতেই কাওয়ালি হয়ে থাকে। আজিমপুরের ছোট দায়রা শরিফে প্রতি শুক্রবার সন্ধার পরে কাওয়ালদের আসর বসে। সামির হোসেন নিজেও এখানে কাওয়ালি পরিবেশন করেন। আরবি রজব মাসের ৬ তারিখে প্রতিটি দরগাতে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর স্মরণে কাওয়ালি উৎসব হয়। পুরান ঢাকার বকশিবাজারের ফকির জহুর আল কাদরি সাহেবের খানকাহ 'আগেরভি শরিফ' এ কাওয়ালির আসর বসে। এছাড়া খানকাহ বা দরগা ব্যতীত ঘরোয়া পরিবেশেও কাওয়ালি পরিবেশন করা হয়।
কাওয়ালির আগের মত জৌলুশ এখন আর নেই। কাওয়ালি মূলত খোদার সাথে বান্দার অন্তর্নিহিত প্রেমকে জাগিয়ে তোলে। এক্ষেত্রে বিশেষ পরিবেশের প্রয়োজন। এখনকার দিনে কাওয়ালরা বিয়ে বাড়ি, মুসলমানি ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে কাওয়ালি পরিবেশন করে থাকেন। যা মূল কাওয়ালির ভাবগত দিকের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন অনেক কাওয়াল। তবুও জৌলুসহীনতার মধ্যদিয়েও পরম্পরায় সংগীতের এই বিশেষ ধারাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলার কাওয়ালরা।