মহামারি সত্ত্বেও ২০২২ সালে যে পাঁচটি কারণে আশাবাদী হওয়াই যায়!
মহামারি এক দুঃসহ সময়। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা তাই স্বাভাবিক। এর মধ্যেই বিশ্ব জেনেছে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভেরিয়েন্টকে, আশঙ্কা চলছে এটি হয়তো সংক্রমণ ঢেউ ও মৃত্যু মিছিলের জন্ম দেবে। এতকিছুর পরও বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের নতুন বছর নিয়ে মনোভাব আশ্চর্যরকম ইতিবাচক। সাম্প্রতিক এক বৈশ্বিক জরিপে অংশ নেওয়াদের ওপর ভিত্তি করে এমন কথাই জানা গেছে।
জরিপটি পরিচালনা করে বাজার গবেষণা ও জনমত বিশেষজ্ঞ সংস্থা- ইপসোস। এতে ৩৩টি দেশের ২২ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক অংশ নেন। সেখানে ২০২২ সাল নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত আভাস জানতে চাওয়া হয়।
ক্রমে বেড়ে চলা ভোগ্যপণ্যের দাম এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করলেও; অধিকাংশ মানুষ নতুন বছর আরও ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে জানান।
ইপসোস কর্মকর্তা অ্যান্তোনিয়া লোপেজ বলেন, "মানব ইতিহাসে সুদিনের আশাই চিরস্থায়ী। তাই হয়তো জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশ (৭৭ শতাংশ) ২০২২ সাল বিদায়ী বছর থেকে ভালো হওয়ার আশাবাদ জানিয়েছে।"
জাতীয়তার বিচারে সবচেয়ে ২০২১ সালের চেয়ে নতুন বছরকে আরও শুভ সময় বলে মনে করেছেন চীনের অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী। তাদের ৯৪ শতাংশই এমন মতপ্রকাশ করেন। আর জাপানিদের মধ্যে এই হার ছিল ৫৪ শতাংশ।
২০২০ সালের শেষদিকে যখন জানতে চাওয়া হয়- তখন অধিকাংশ বা ৯০ শতাংশ মানুষ বিদায়ী বছরকে তাদের দেশের জন্য এক দুঃসময় বলে উল্লেখ করেন। এবারও বছর শেষে সে প্রশ্ন রাখা হলে, ৭৭ শতাংশ একই উত্তর দিয়েছেন। ২০২১ সালকে নিজ পরিবারের জন্য খারাপ সময় বলে জানিয়েছেন ৫৬ শতাংশ। ২০২০ সালের ব্যাপারে এমন মত দিয়েছিলেন ৯০ শতাংশ।
তবে নতুন বছরের সংকল্পগ্রহণ এখনও জনপ্রিয়। বিশ্বজুড়ে জরিপে অংশ নেওয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ নতুনবর্ষের জন্য লক্ষ্যস্থির করেছেন। জাপানে এ হার ৪৪ শতাংশ এবং সুইডেনে ২৩ শতাংশ।
এবার নতুন বছর ঘিরে ইতিবাচক মনোভাব বৃদ্ধি বেশ স্পষ্ট। অধিকাংশ মানুষ কেন ২০২২ সালে জীবন সম্পর্কে আশাবাদী তার কিছু কারণই এখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম সূত্রে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
১. কোভিড-১৯ প্রতিরোধের যুদ্ধে অগ্রগতি:
করোনাভাইরাস আশাবাদের কোনো নিশ্চিত কারণ হতে পারে না, এমন ধারণাই স্বাভাবিক। কিন্তু, টিকাদান কর্মসূচির উন্নতি মানুষের মনে ভাইরাসটি সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগমুক্তির আশা জাগিয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়ারা মনে করেন, ২০২২ সালের মধ্যেই বিশ্বের ৮০ শতাংশ মানুষ করোনা টিকার অন্তত এক ডোজ পাবে।
এনিয়ে সবচেয়ে ইতিবাচক ছিলেন লাতিন আমেরিকার বাসিন্দারা। পেরুর ৮১ শতাংশ, ব্রাজিলের ৭৬ শতাংশ এবং চিলির ৬৯ শতাংশ মানুষ ২০২২ সালকে টিকাদানের জন্য একটি সফলতার বছর বলে ধারণা করছেন।
সে তুলনায় বেশি সংশয় প্রকাশ করেন ইউরোপীয়রা। যেমন ফ্রান্সের মাত্র ৪২ শতাংশ মনে করেন ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার এ বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির যথাক্রমে- ৩৮ ও ৩৩ শতাংশ নাগরিক এ মত দেন।
২. জলবায়ু ও পরিবেশ:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরুপ আবহাওয়া ও দুর্যোগের ঘনত্ব বাড়ছে দুনিয়াব্যাপী। প্রতিবছর বাড়ছে ঝড়, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি। ২০২২ সালেও তা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা করেছেন বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষ। চলতি বছর ব্যাপক বন্যার কবলে পড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর বাসিন্দারা এমন মতদানে এগিয়ে রয়েছেন। তবে একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগের প্রতি আস্থাও বেড়েছে।
কার্বন নিঃসরণের অন্যতম উৎস পরিবহন খাত। কম দূষণকারী বা সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত এভিয়েশন জ্বালানির প্রচলন না থাকায় এদিক থেকে এগিয়ে বৈশ্বিক এয়ারলাইন্সগুলো। ২০২২ সালে প্রাক-মহামারি সময় বা ২০১৯ সালের চেয়ে কম মানুষ একারণে বিমানে ভ্রমণ করবে বলে আশা করছেন দুই-পঞ্চমাংশ অংশগ্রহণকারী। ভ্রমণ-অভ্যাস পরিবর্তন নিয়ে সবচেয়ে জোরালো মনোভাব জানিয়েছেন চীনের ৬৮ শতাংশ নাগরিক। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার যথাক্রমে ৬৭ ও ৬৬ শতাংশ এমন মত দেন।
৩. সমাজ:
মহামারিকালে গত দুই বছরে নানান বিপর্যয় দেখেছে বিশ্ববাসী। কমবেশি প্রভাবিত হন সকল শ্রেণি, বর্ণ আর ধর্মের মানুষ। একসাথে, বিপদ মোকাবিলা করায় নতুন বছরে সমাজে সহনশীলতা বাড়ার অনুমান করছেন জরিপে অংশ নেওয়াদের এক-তৃতীয়াংশ।
এই মনোভাব সবচেয়ে জোরালো চীনে, ৮৩ শতাংশ চীনা নাগরিক ২০২২ সালে সহনশীলতা বৃদ্ধির আশা করেন। সে তুলনায় ফ্রান্সের মাত্র মাত্র ৯ শতাংশ নাগরিক এতে বিশ্বাস করেন।
আবার লকডাউনের পালাক্রম শেষে কর্মীরা ধীরে ধীরে অফিস-আদালতে সশরীরে যোগ দেওয়ায় নতুন বছরে নগর কেন্দ্রগুলো আরও প্রাণোচ্ছল হবে বলে আশা করেছেন ৭১ শতাংশ বিশ্ববাসী। যার সাথে ৮৭ শতাংশ চীনা নাগরিক একমত পোষণ করেন। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও কলম্বিয়ায় প্রতি পাঁচ জনের একজনও এমন হওয়ার ধারণাই করছেন।
৪. অর্থনীতি:
বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাপারে আশাবাদও বাড়তে দেখা গেছে। চলতি বছরের তুলনায় ২০২২ সালে পুঁজিবাজার আরও স্থিতিশীল থাকার বিষয়ে প্রত্যাশা করছেন অনেক বেশি মানুষ। সে তুলনায় ২০২১ সালে প্রধান প্রধান পুঁজিবাজার ধসের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ৪০ শতাংশ বিশ্ব নাগরিক।
তবে আয়ের চেয়েও দ্রুতগতিতে নিজ দেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ার অনুমান করছেন তিন-চতুর্থাংশ বৈশ্বিক জনতা। তারপরও ৪২ শতাংশই পুঁজিবাজার ধসের সম্ভাবনা খুবই কম বলে উল্লেখ করেন।
৫. ভিনগ্রহবাসীর আগ্রাসন:
এত এত আশার ভিড়েও অবশ্য ২০২২ নিয়ে দুর্ভাবনার অনেক কিছুই থাকতে পারে। কিন্তু, জরিপের ফলানুযায়ী সে তালিকার শীর্ষে নেই ভিনগ্রহবাসীর আগ্রাসন। বিশ্বের মোট ১৪ শতাংশ মানুষ এমন সম্ভবনা উড়িয়ে দেননি। কিন্তু, ভারতের এক-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারী ভিনগ্রহের আগুন্তুকরা আসলে তাদের স্বাগত জানাবেন বলে জানান।
অন্যদিকে, ৩৯ শতাংশ ব্যক্তি কোনো ভয়াল দুর্যোগ তাদের শহর বা দেশকে আক্রান্ত করবে বলে ধারণা করছেন। ৩৮ শতাংশের উদ্বেগ, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের হ্যাকারগোষ্ঠী তাদের দেশের আইটি ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করবে। বিশ্ববাসীর ৩৪ শতাংশ পরমাণু যুদ্ধের শঙ্কা করছেন। আর ২৭ শতাংশ ভয় পাচ্ছেন লাগামহীন ভয়ংকর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান নিয়ে।
- সূত্র: ডব্লিউই ফোরাম ডটওআরজি