স্বপ্নের কি কোনো অর্থ আছে? স্বপ্নের মধ্যে পড়ে যাওয়ার অনুভূতি কেন হয়?
আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি। নিয়মিত দেখলেও স্বপ্ন যেন রহস্যের চাদরে মোড়ানো থাকে। এ কারণেই স্বপ্ন মানুষকে এত টানে।
স্বপ্ন নিয়ে আমাদের মনে অজস্র প্রশ্ন আছে। স্বপ্ন কী? আমরা কেন স্বপ্ন দেখি? আমরা কেন ঘুম থেকে উঠেই অধিকাংশ স্বপ্ন ভুলে যাই?
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকায়াট্রি ও বিহেভিয়ায়াল-এর সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড নয়বাওয়ার-এর মতে, স্বপ্ন এক ধরনের মানসিক কার্যকলাপ যা ঘুমের মধ্যে ঘটে।
স্বপ্নের আমরা এমন অবাস্তব দৃশ্য দেখি যা বাস্তব মনে হয়। আর স্বপ্নে বেশিরভাগ সময়ই ঘটনা পরম্পরায় সংগতি বা ধারাবাহিকতা থাকে না।
এই 'তীব্র, আবেগি ঘটনাপ্রবাহ' সাধারণত ঘুমের 'র্যাপিড আই মুভমেন্ট' (আরইএম) পর্যায়ে ঘটে। এই পর্যায়েই স্মৃতি একত্রীকরণ ঘটে থাকে বলে ধারণা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, স্বপ্ন দেখা সম্ভবত আমাদের মস্তিষ্ক থেকে 'কিছু তথ্যের ফাইল' মুছে ফেলার মাধ্যমে ভালো স্মৃতি তৈরির প্রক্রিয়া।
হার্ভার্ডের স্বপ্ন গবেষক ডায়ারড্রে ব্যারেট জানান, আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখনই আমাদের মস্তিষ্কের 'দর্শন ও আবেগ-সংক্রান্ত' এলাকা সবচেয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে ঘুমের মধ্যেও আমাদের মধ্যে আশা ও ভয়ভীতি কাজ করে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক জি. উইলিয়াম ডমহফ বলেন, স্বপ্ন খুব সম্ভব আসে আমাদের গভীর অবচেতন থেকে। এ কারণে স্বপ্নকে আমাদের কাছে এত রহস্যময় লাগে। ডমহফের মতে, স্বপ্ন দেখা প্রায়ই আরইএম ঘুমের সময় ঘটে।
স্বপ্নের কি কোনো অর্থ আছে?
মনোবিজ্ঞানী অ্যালান আইজার বলেন, স্বপ্ন 'অত্যন্ত অর্থবহ' হতে পারে। কারণ আমাদের রোজকার জীবনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েনের উঠে আসে স্বপ্নে।
তবে সব স্বপ্নই অর্থবহ নয় বলে মন্তব্য করেন হার্ভার্ডের গবেষক ব্যারেট। তার মতে, স্বপ্নের অধিকাংশ বিষয়বস্তুই হয় অত্যন্ত তুচ্ছ অথবা বারবার আমরা ঘুরেফিরে একই স্বপ্ন দেখি। আমরা জেগে থাকতে যা যা ভাবি, ওইসব ভাবনাই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। সেদিক থেকে ভাবলে স্বপ্ন সবসময় অর্থবহ না-ও হতে পারে।
ডমহফ বলেন, স্বপ্ন অর্থবহ হলেও প্রতীকী নয়। প্রতীক ব্যবহারের জন্য মস্তিষ্ক যতটুকু খাটাতে হয়, স্বপ্নে মস্তিষ্ককে ততটুকু খাটানো সম্ভব নয়।
বারবার কেন একই স্বপ্ন দেখি আমরা?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা বারবার একই বিষয় নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি। সে কারণে ওসব বিষয়ে বারবার স্বপ্ন দেখি। অনেক থেরাপিস্টের ধারণা, সাধারণত আমাদের দীর্ঘদিনের আচরণগত সমস্যাগুলোই স্বপ্নে উঠে আসে বারবার।
তবে কিছু স্বপ্ন বারবার দেখলেও আমাদের মোট স্বপ্নে পুনরাবৃত্তি হওয়া স্বপ্নের সংখ্যা বেশ কম।
আরেকটা স্বপ্ন আমরা অনেকেই বারবার দেখি—বহু ওপর থেকে পড়ে যাওয়া। আমরা অবশ্য মাটিতে পড়ে যাই না, তার আগেই ধড়মড় করে জেগে উঠি প্রতিবার।
পড়ে যাওয়ার এই স্বপ্ন দেখা ও ধড়মড় করে জেগে ওঠা স্বপ্নের বাইরেও ঘটতে পারে। অনেকসময় তন্দ্রায় আমাদের চোখ লেগে এলে এই অনুভূতি হয়। সম্ভবত এটা হয় অন্তঃকুহর থেকে মস্তিস্কে 'মোশন সিগন্যাল' পাঠানোর ফলে।
দুঃস্বপ্ন নিয়ে আতঙ্কে আছেন? কী করবেন?
আমরা দুঃস্বপ্ন কেন দেখি, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। নয়বাওয়ার বলেন, ডিপ্রেশনসহ বেশ কিছু রোগের ওষুধ খেলে স্বপ্ন বেশি জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে।
তাছাড়া পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসের মতো কিছু কারণেও আমরা ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্নের জন্য যদি আপনার জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে আরম্ভ করে, তাহলে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ করার সবচেয়ে গবেষণাভিত্তিক চিকিৎসা হলো 'ইমেজারি রিহার্সাল থেরাপি' বা আইআরটি। এই থেরাপি অনুসারে, আমরা যেসব দুঃস্বপ্ন দেখি সেগুলোর জন্য নতুন স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলা হয়। তারপর শুতে যাওয়ার আগে নতুন স্ক্রিপ্ট অনুসারে রোগী সমস্ত দৃশ্য কল্পনা করে নেওয়ার চেষ্টা করে।
আরেকটা কৌশল হলো আমরা স্বপ্নে যা দেখতে চাই, তা নিয়ে একমনে ভাবতে ভাবতে ঘুমানোর চেষ্টা করা। এই পদ্ধতি আমাদের দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করতে পারে।
তবে কিছু কিছু দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে মন আমাদের কোনো খারাপ বিষয় নিয়ে সংকেত দেওয়ার চেষ্টা করে। এই দুঃস্বপ্নগুলো আমাদের উপকারেই আসে।
স্বপ্নে দৌড়ানো বা চিৎকারের চেষ্টা করেও কেন তা পারি না আমরা?
আরইএম ঘুমের সময় শরীরের ঐচ্ছিক কঙ্কাল পেশিগুলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। এটা আমাদের জন্য ভালো ও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এসব পেশি অচল না হলে আমরা স্বপ্নের মধ্যে যেসব কাজ করি, ঘুমের মধ্যে হাত-পা নেড়ে ওসব কাজ করার চেষ্টা করতাম।
স্বপ্নের মধ্যে চেষ্টা করেও দৌড়াতে না পারা, কিংবা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে না পারার কারণ সম্ভবত এই পেশিগুলোর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাওয়া।
মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার পর আমরা নড়তে বা কিছু দেখতে পারি না। এর কারণ কী?
স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার পর নড়তে বা কিছু দেখতে না পারা একটা সাধারণ ঘটনা। অনেকেই এতে ঘাবড়ে যান। তবে এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
এটা হয় আরইপ ঘুমের প্রভাবে। এই প্রভাব কাটতে বেশিরভাগ সময়ই এক মিনিটে বেশি লাগে না। তবে এই বাপার ঘন ঘন ঘটলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমাদের পেশি যখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত থাকে, তখন
স্বপ্ন কেন ভুলে যাই?
যেসব মানুষ স্বপ্ন দেখার সময় জেগে থাকে, অর্থাৎ অর্ধজাগরণের মধ্যে যারা স্বপ্ন দেখে, তারা জেগে ওঠার পর স্বপ্ন বেশি মনে রাখতে পারে।
যেসব মানুষ কম ঘুমায়, তাদের স্বপ্নও কমই মনে থাকে। কারণ, তারা আরইএম ঘুমের পেছনে সময় কম খরচ করে।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট