রাগ উদ্রেককারী রসুন-পেঁয়াজ খাবারে নিষিদ্ধ, মাংস চিন্তাতেও ঠাঁই পায় না যে শহরে!
পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি বেনারস। গোড়াপত্তন খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ সালে। বিশ্বের ১২০ কোটি হিন্দুর জন্য অন্যতম পবিত্র শহর এটি।
রোজ মন্দিরের ঘন্টার শব্দ প্রতিধ্বনিত হওয়ার সাথে সাথে হাজার দশেক পূণ্যার্থি শহরের ৮৮টি পাথর ঘাটের সিড়ি বেয়ে নামতে থাকেন গঙ্গায় ডুব দিয়ে তাদের পাপ ধুয়ে নিতে। শোকাহত স্বজনেরা ভিড় করেন বেনারসের দুই শ্মশান ঘাটে, যেখানে কিছুক্ষণ পরপর শব চিতা পুড়তে থাকে। তাদের বিশ্বাস এখানে চিতায় ওঠা মৃতের কানে স্বয়ং ভগবান শিব তারাক মন্ত্র জপে দিয়ে তৎক্ষণাৎ মুক্তির ব্যবস্থা করেন
বেনারসের এই চিরায়ত আধ্যাত্মিক রূপের বাইরেও আছে এক অন্য পরিচয়। নিরামিষ খাবারপ্রেমীদের জন্য বেনারস যেন এক স্বর্গরাজ্য।
বেনারসের অধিকাংশ হিন্দুই শিবভক্ত। নিরামিষভোজী দেবতা শিবের অনুসরণে তারাও সবসময় কঠোর সাত্ত্বিক খাদ্যাভ্যাস চর্চা করেন। সকল ধরনের আমিষ খাবার থেকে দূরে থাকার ব্রত পালন করেন তারা।
বেনারসের লোভনীয় রন্ধনরহস্য এখনো পর্যন্ত নিভৃতেই রয়ে গেছে বিশ্ববাসীর নজর থেকে। বিখ্যাত খাবারের জন্য বিশ্বের ফুড ট্র্যাভেলারদের জনপ্রিয় গন্তব্যের ক্ষেত্রে দিল্লি, কলকাতা বা চেন্নাইয়ের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে বেনারস। তবুও এখানকার ঐতিহ্যবাহী রন্ধনশিল্প ইতোমধ্যেই অনুপ্রাণিত করছে বিশ্বসেরা শেফদের।
ম্যানহাটনে রেস্টুরেন্ট 'জুনুন' পরিচালনার সময় ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রতিবছর মিশেলাইন স্টার পাওয়া শেফ বিকাশ খান্না। বেনারসের মন্দিরে পরিবেশিত বাজরার ময়দায় বানানো প্যানকেক খেয়ে তিনি এত মুগ্ধ হন যে ম্যানহাটনে নিজের রেস্টুরেন্টেও তা বানানোর চেষ্টা করেন।
দুইবার মিশেলাইন স্টার পাওয়া শেফ অতুল কোচ্চার লন্ডনে তার আধুনিক ভারতীয় রেস্টুরেন্টের নাম দিয়েছেন 'বেনারস'। রান্নার বইতে তিনি ছোলার প্যানকেক, ঐতিহ্যবাহী টক-মিষ্টি টমেটো সালাদসহ বেনারসের নানা বিখ্যাত নিরামিষ খবারের উল্লেখ করেছেন। ভারতের সেলিব্রিটি শেফ সঞ্জীব কাপুরও তার বেনারসের খাবারপ্রীতি নিয়ে লিখেছেন। এখানকার চমৎকার নিরামিষী প্রসাদ তার পছন্দের তালিকায় অন্যতম।
৮০ শতাংশ হিন্দু আর ২০ শতাংশ নিরামিষাশীর দেশ ভারতের অধিকাংশ খাবার মেন্যুতে গরুর মাংস না থাকা সাধারণ বিষয়। কিন্তু বেনারসের পরিবেশগত আধ্যাত্মিকতা আর কঠোর সাত্ত্বিক জীবনধারা এর নিরামিষ খাবারের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। সাত্ত্বিক খাবার তালিকা মূলত আয়ুর্বেদিক নীতি মেনে বানানো হয়। হিন্দু ধর্মে নির্দেশিত নিরামিষের বৈশিষ্ট্য কঠোরভাবে মানা হয় এতে। যে কারণে এর রান্নায় রাগ, উদ্বেগ, আগ্রাসন উদ্রেককারী পেঁয়াজ, রসুনও ব্যবহার করা হয় না।
বেনারসের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে শিবপূজার বেদি। তাই সেখানে কেউ গরুর মাংস খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেনা। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের পুরোহিত অভিষেক শুক্লা বলেন, "যারা মৃত্যুর পর মুক্তি কামনা করে তাদের পূর্ণ সাত্ত্বিক হওয়ার বিকল্প নেই। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যেসব প্রাণীকে আমরা খাওয়ার জন্য হত্যা করলাম মৃত্যুর পর আমাদের আত্মাও তাদের মতোই যন্ত্রণায় ভুগবে। খাবার তালিকায় গরু আর পেঁয়াজ-রসুন তামাসিক (সাত্ত্বিকের বিপরীত) বৃদ্ধি করে। যা মানুষের ভালো চিন্তা আর কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।"
ঐতিহ্যগতভাবে অনেক বেনারসী রেস্টুরেন্ট পশ্চিমা ট্যুরিস্ট আর আমিষভোজী হিন্দু তীর্থযাত্রীদের জন্য গরুর মাংস পরিবেশন করত। মূলত বাসা-বাড়িতেই পূর্ণ সাত্ত্বিক খাবার খাওয়া হত। কিন্তু ২০১৯ সালে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার বেনারসের ঐতিহাসিক স্থান ও মন্দিরের ২৫০ মিটারের আশেপাশে গরুর মাংস বিক্রি ও খাওয়া নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে বেনারসের রেস্টুরেন্টগুলো স্থানীয় সাত্ত্বিক খাবারের রেসিপিগুলো কাজে লাগাতে শুরু করে।
"ব্রিজরামা প্যালেস" নামের বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টের প্রধান শেফ মনোজ বার্মা বেনারসের নিরামিষ খাবার নিয়ে বেশ অভিজ্ঞ। তিনি বলেন আমি যখন প্রথমবার এই রেস্টুরেন্টের দায়িত্ব পেলাম তখনই খাবার তালিকায় 'খাট্টা মিঠা কাদ্দু' (টক-মিষ্টি কুমড়া) আর নিমোনার (মশলাদার মটর ভর্তা) মতো নিরামিষ খাবার যোগ করলাম। এ ধরনের খাবার সাধারণত আমাদের অতিথিরা আগে কখনো খেয়ে দেখেনি।"
২০১৯ সালের গরুর মাংসে নিষেধাজ্ঞা বেনারসের নতুন প্রজন্মের শেফদের সৃজনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন মনোজ বার্মা। দেশের অনেক সেলিব্রিটি আর আন্তর্জাতিক অতিথিদের খাবার পরিবেশন করলেও মনোজের জন্য সবচেয়ে বড় সম্মানের দিন ছিল শেফ বিকাশ খান্না যেদিন তার খাবার খেতে আসেন। মিশেলাইন স্টার পাওয়া শেফ বিকাশ তার রান্না খাওয়ার পর পা ছুঁয়ে তাকে সম্মান জানান। জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে মনোজের মনে থাকবে সেই দিনের কথা।
শহরের ক্রমবর্ধমান সাত্ত্বিক খাবারের রেস্টুরেন্টের মধ্যে 'শ্রী শিবায়' অন্যতম। ২০১৯ সালের গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাত্ত্বিক রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৪০টি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০টিতে। রোজ সকালে স্থানীয় বাজারে পাওয়া উপকরণের উপর নির্ভর করে দিনে দুইবার মেন্যু পরিবর্তন হয় 'শ্রী শিবায়' রেস্টুরেন্টে। মেন্যুর অন্যতম আকর্ষণ থাকে নিরামিষী থালি বা প্রসাদ, যেখানে কমপক্ষে ১২ ধরনের নিরামিষ পদ থাকে। এরমধ্যে 'কারি পাকোড়া' (দইয়ের সসের সাথে বেসনে বানানো ভাজা ডাম্পলিং), টমেটোর রসার সাথে রাজমা, পনির অন্যতম পদ।
রেস্টুরেন্ট ছাড়াও বেনারসের 'স্ট্রিট ফুড'-এর আবেদন কোন অংশেই কম নয় ব্যাংকক বা ইস্তাম্বুলের চেয়ে। তবে গণমাধ্যমে এখনো পর্যন্ত তেমন পরিচিতি পায়নি বেনারসের রাস্তার বৈচিত্র্যময় খাবারগুলো। এমনই এক পদ হলো কাশি চাট ভাণ্ডারের স্টলে বিক্রি হওয়া 'টমেটো চাট'।
টক আর মশলাদার টমেটো ভর্তাকে জিরার ফোঁড়ন দেয়া চিনির সিরায় মিশিয়ে উপরে মুচমুচে 'সেভ' (ডুবু তেলে ভাজা বেসনের নুডুলস) দিয়ে পরিবেশন করা হয় এখানে। রান্নার মূল রেসিপিটি ১৯৬৮ সালে উদ্ভাবন করেছিলেন কাশি চাট ভাণ্ডারের মালিক। এই টমেটো চাটের অনবদ্য স্বাদ বেনারসের বাইরে পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
'লাক্সমী চাই ওয়ালা'-র স্টলে টেরাকোটার মাটির কাপে মালাই টোস্টের সাথে পরিবেশন করা ফেনা ওঠা মিষ্টি দুধ চা বেনারসের রাস্তার আরেক আকর্ষণ। গরম কয়লার উপর দুই স্লাইস পাউরুটি সেঁকে তার সাথে টাটকা মালাই আর চিনি ছড়িয়ে বানানো হয় চায়ের মনোরম সঙ্গী এই মালাই টোস্ট।
শহরের রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে 'বাটি চোখা' রেস্টুরেন্টের প্রধান আকর্ষণ হলো 'বাটি'। এই বাটি হলো উত্তর প্রদেশের একটি জনপ্রিয় খাবার। যা ইস্ট ছাড়া ময়দায় বানিয়ে গরুর গোবরের ঘুঁটেতে পোড়ানো এক ধরনের শক্ত রুটি। বাটির সাথে মাটির পাত্রে পরিবেশন করা চোখার সবজিতে থাকে মশলাদার বেগুন, আলু আর টমেটো। এগুলোও ভাজা হয় একই গোবরের ঘুঁটেতে।
গোবরের ঘুঁটের আগুনে ভাঁজার কারণে কিন্তু এখানে খেতে আসা অতিথিরা নাক সিঁটকায় না। বরং বেশিরভাগ অতিথির কাছেই এই 'বাটি চোখা' ভারতের সবচেয়ে মজার খাবার হিসেবে সমাদৃত হয়।
অধিকাংশ ভারতীয়র কাছে বেনারস হলো ভারতের পানের রাজধানী। এখানে রাস্তার পাশের পানের দোকানগুলোতে গোলাপের পাপড়ির জ্যাম, নানা ধরনের বাদাম আর চুন দিয়ে রাজকীয় পান সাজানো হয়। বৈচিত্র্যময় নিরামিষী পদগুলোর শেষে এমন রাজকীয় পান যে কোনো ভোজনরসিকের মনে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ট।
এভাবেই প্রতিবছর আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে আসা লাখ লাখ পর্যটকের পাশাপাশি ভোজনপ্রেমীদের নিরামিষী খাবারের চাহিদাও সমান সাফল্যের সঙ্গে মিটিয়ে চলেছে বেনারস।
- সূত্র: বিবিসি