যে চার ক্ষেত্রে ফ্রিতে কাজ করেও হতে পারেন লাভবান!
আপনি কোনো কাজে খুব ভালো? হতে পারে সেটি লেখালেখি, ছবি আঁকা। আবার হতে পারে হিসাবরক্ষণ কিংবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। কাজ যা-ই হোক, তাতে আপনার দক্ষতা এতটাই যে, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে আপনার সুনাম। সকলেই আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
এ ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ। অল্প বয়স থেকেই যদি কোনো নির্দিষ্ট কাজের ব্যাপারে আপনার খ্যাতি জন্মায়, তবে নিজেকে ওই কাজের 'সুপারস্টার' বলে অনুভব হয়। এ সংক্রান্ত আত্মবিশ্বাস আপনার ভবিষ্যত সাফল্যের পথকেও করে দেয় সুগম।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটা 'ডাউনসাইড'-ও কিন্তু রয়েই যায়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে স্বল্প-পরিচিত বা নিতান্তই অপরিচিত অনেকেই আপনার কাছে আবদার করে তাদের কাজটি করে দিতে। তা-ও নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে। ব্যাপারটি এক পর্যায়ে এতটাই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে যে, শুরুতে যেটিকে মনে হতো 'মধুর সমস্যা', সেটি পরিণত হয় জীবনের অন্যতম বড় সমস্যায়।
তাই তো 'দ্য ডার্ক নাইট'-এ জোকাররূপী হিথ লেজার বলেছিলেন, "ইফ ইউ আর গুড অ্যাট সামথিং, নেভার ডু ইট ফর ফ্রি।"
তবে ফ্রিতে কাজ করার ব্যাপারে সবসময়ই এতটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করাও ঠিক নয়। চারটি ক্ষেত্রে ফ্রিতে কাজ করা বরং আপনার ক্যারিয়ারের জন্যই উপকারী হতে পারে।
১. যে কাজ আপনাকে রিয়েল লাইফ এক্সপেরিয়েন্স দেবে
মনে করুন আপনি ফটোগ্রাফির স্টার্ট-আপ শুরু করবেন। এমনটি আশা করা বোকামি হবে যে শুরুতেই আপনি এজন্য উপযুক্ত সম্মানী পাবেন। তাই আপনার হাতেখড়ি হতে পারে টাকার আশা ছেড়ে দিয়েই ওয়েডিং ফটোগ্রাফি বা মডেলদের শ্যুট করার মাধ্যমে। এর ফলে একটু একটু করে সমৃদ্ধ হবে আপনার পোর্টফোলিও।
একইভাবে, আপনি যদি একজন পাবলিক স্পিকার বা কোচিং সেন্টারের লেকচারার হতে চান, তাহলেও গোড়ার দিকে মাসকয়েক ফ্রিতে কাজ করার মাধ্যমে ধারালো করে নিতে পারেন নিজের দক্ষতা। এরপর যখন আপনি অভিজ্ঞ হয়ে উঠবেন, তখন আপনার সার্ভিসের বিনিময়ে ফি দাবি করতেই পারেন। এবং যত দিন যাবে, সেই ফির পরিমাণও পারেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে।
নিজের জন্য একটি লিমিট তৈরি করে নিতে পারেন যে একটি কাজ আপনি কতবার বিনামূল্যে করবেন। মনে রাখবেন, ওই লিমিট যেন কখনোই পার হয়ে না যায়। যদি ৫০ বার ফ্রিতে কাজ করার পরও আপনি টাকা দাবি করার মতো আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে না পারেন, তাহলে ধরে নেবেন কাজটি আপনার নিছকই শখ বা নেশা; অর্থ উপার্জনের উপযুক্ত পেশা নয়।
একদমই অপরিচিতদের কাছে বিনামূল্যে নিজের সার্ভিস প্রদানের ব্যাপারেও আপনাকে সচেতন হতে হবে। যদি নিজে থেকেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফ্রিতে কাজ করে দিতে চান, তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তারা ধরে নেবে আপনি নিজের কাজে খুব ভালো নন, তাই যেকোনো উপায়ে কাজ পেতে মরিয়া হয়ে আছেন। আপনি যদি নিজে থেকেই জনসম্মুখে ঘোষনা দেন যে আপনার সময় ও পরিশ্রমের কোনো বিনিময় মূল্য নেই, তাহলে আপনি নিজের কাজে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার পরও আপনাকে কেউ কখনো সিরিয়াসলি নেবে না।
২. যে কাজে আপনি সত্যিকারের এক্সপোজার পাবেন
ধরুন, একজন পডকাস্টার ফ্রি কনটেন্টের সন্ধানে রয়েছে। অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান চাইছে ওয়েবিনারের আয়োজন করতে, কিন্তু সেটির পেছনে কোনো টাকা না ঢালতে। এ ধরনের পডকাস্ট বা ওয়েবিনানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেলেন আপনি। আপনাকে জানানো হলো, টাকা পাবেন না তো কী হয়েছে, অনেক এক্সপোজার তো পাবেন!
কিন্তু না, সব এক্সপোজার বা পরিচিতিকেই এক মানদণ্ডে মাপলে হবে না। কোন ধরনের এক্সপোজারের কার্যকারিতা ঠিক কতটুকু, তা বোঝার মতো মানসিক পরিপক্বতা আপনাকে নিজে থেকেই গড়ে তুলতে হবে।
আপনি যদি আপনার বন্ধুকে ফ্রিতে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে দেন, এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে ওই ওয়েবসাইটের নিচে ওয়েবসাইট ক্রিয়েটর হিসেবে আপনার ক্রেডিট দেয়, তাতে আপনি কতটুকু লাভবান হবেন? এটি নির্ভর করছে আপনার বন্ধুর ব্যক্তিগত পরিচিতি ও তার ওয়েবসাইটের ধরনের উপর।
আপনার বন্ধু যদি নেহাতই অপরিচিত কোনো ব্যক্তি হয়, আর ওয়েবসাইটটিও হয় শখের বশে তৈরি করা, তাহলে সে যত বড় ফন্টেই আপনার নাম উল্লেখ করুক না কেন, খুব বেশি লোকের চোখে তা পড়বে না। কিন্তু আপনার বন্ধুর যদি থাকে লাখ লাখ ফলোয়ার, অথবা তার ওয়েবসাইটের কনটেন্ট হয় সম্ভাবনাময়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আপনার কষ্ট সার্থক হবে।
অনেকসময়ই দেখা যায় যে বিনামূল্যে কাজ করিয়ে নেওয়ার সময় এমনকি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কোনো নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি হয়তো আপনাকে দিয়ে পাঁচ মিনিটের একটি ভিডিও বানিয়ে নিল, কিন্তু তারা নিজেরাই সেটি প্রচারের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। তাহলে অত বড় একটি কোম্পানির হয়ে কাজ করার পরও খুব বেশি অডিয়েন্সের কাছে কিন্তু আপনি পৌঁছাতে পারলেন না।
তাই আপনার উচিত হবে কোনো কাজ হাতে নেওয়ার আগেই বারবার প্রশ্ন করে ও ক্রসচেকের মাধ্যমে আপনার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলো দূর করে নেওয়া, যাতে পরে পস্তাতে না হয়।
৩. যে কাজে আপনার ব্যক্তিগত আদর্শের প্রতিফলন থাকবে
যদি এমন কোনো কাজের সুযোগ পাওয়া যায়, যেটিতে জড়ানোর মাধ্যমে আপনি নিজের আদর্শের প্রচার করতে পারবেন, বা নিজের ভালো লাগা থেকে কাজটি করতে পারবেন, তাহলে আপনার উচিত কী পাচ্ছেন সেদিকে ফোকাস না করে ফোকাস করা কী দিতে পারছেন সেদিকে। স্রেফ কাজটি শুরুর আগে এটুকু ভেবেই নিজের মনকে প্রস্তুত করে নেবেন যে কাজটি আপনি স্বেচ্ছায়, ভলান্টিয়ার ওয়ার্ক হিসেবে করছেন; এ কাজের দৃশ্যমান প্রাপ্তি শূন্য হলেও কিছু যায় আসে না।
এ ধরনের কাজে আপনি নিজের কতটুকু সময় বিনিয়োগ করতে পারবেন, অর্থাৎ নিজের অন্যান্য কাজের ফাঁকে কতটুকু সময় এ কাজে ব্যয় করলেও আপনার সমস্যা হবে না বা কাজটিকে বাড়তি চাপ বলে মনে হবে না, সে ব্যাপারেও আগেভাগে চিন্তা করে রাখাই ভালো।
মনে করুন একটি কাজ আপনি নিজের অন্যান্য কাজের ফাঁকে সময় করে বছরে তিনবার ভালোভাবে করতে পারবেন। তাহলে কাজটিকে ওই তিনবারেই সীমাবদ্ধ রাখুন। চতুর্থবার কাজটি করার জন্য কেউ যদি পীড়াপীড়িও করে, তাহলে ভদ্রভাবে বলুন, "আমি ইতোমধ্যেই এ বছরের মতো যথেষ্টবার কাজটি ফ্রিতে করে ফেলেছি। আর আমার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়।"
৪. যে কাজ দীর্ঘমেয়াদে আপনার সিভিকে ভারি করবে
আপনি হয়তো ভাবছেন, যে কোম্পানি যত বড়, সে কোম্পানিতে কাজ করলে তত বেশি টাকা পাওয়া যায়। একদমই ভুল ধারণা। এমনকি কোনো ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজের বিনিময়ে যথেষ্ট সম্মানী দেয় না, অথবা কোনো টাকাই দেয় না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় টেডের কথা। টেড টকের কথা কে না শুনেছে! টেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারার মতো সম্মানজনক ব্যাপার এই ২০২২ সালে এসে খুব কমই আছে। অথচ জেনে অবাক হবেন, টেডের স্পিকাররা কিন্তু কোনো টাকাই পায় না।
তাহলে টেডে কেন লোকে যায় কথা বলতে? কারণ টেডে অংশ নিতে পারার অর্থ হলো, আপনি জীবনে কোনো ক্ষেত্রে আসলেই 'উল্লেখযোগ্য' কিছু করেছেন, অথবা ভবিষ্যতে তা করার মতো সম্ভাবনা আপনার মধ্যে রয়েছে। ফলে টেডে কথা বলার এই ব্যাপারটি পরবর্তীতে আপনি সারাজীবনই নিজের মূল্য নির্ধারণে কাজে লাগাতে পারবেন।
একইভাবে আপনি যদি একজন লেখক হন এবং দেশের শীর্ষ পত্রিকা থেকে আপনার লেখা প্রকাশের প্রস্তাব আসে, তাহলে ওখানে পর্যাপ্ত সম্মানী না পেলেও রাজি হয়ে যেতে পারেন। কারণ দেশের শীর্ষ পত্রিকায় লেখা প্রকাশের সুবাদে এতদিন লেখক-পাঠক-প্রকাশক পরিমণ্ডলে যারা আপনাকে সিরিয়াসলি নিত না, তারাও আপনাকে আলাদা সম্মান দিতে শুরু করবে। নিজের এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পরবর্তীতে আপনি বড় কোনো প্রকাশকের সামনেও আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের কাজ উপস্থাপন করতে পারবেন, এবং পারবেন নিজের যথাযোগ্য পারিশ্রমিকও আদায় করে নিতে।
নিজের সময়ের মূল্য দিন
দিনশেষে সময়ের চেয়ে বেশি মূল্যবান আর কিছুই হতে পারে না। এবং নিজের সময়ের মূল্য আপনাকে নিজেকেই দিতে হবে। আপনি নিজেই যদি নিজের সময়ের মূল্য অনুধাবন করতে না পারেন, তাহলে অন্য কারোও বয়েই গেছে আপনার সময়ের মূল্য দিতে!
তাই যেকোনো কাজ শুরুর আগে টাকা-পয়সা, মান-সম্মানেরও আগে ভাবুন, "এই কাজটি করা কি আমার সময়ের সদ্ব্যবহার হবে?" যদি উত্তর 'হ্যাঁ' হয়, তাহলে বাদবাকি ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখুন। আর যদি উত্তর হয় 'না', তাহলে ওই কাজ শুরু করে নিজের ছোট্ট জীবনের মহামূল্যবান সময়ের জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না!