বেয়োনেটের কাজ কী? আজও কেন টিকে আছে এই অস্ত্র?
২০০৪ সালে আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল একটি ব্রিটিশ প্লাটুন। সম্মুখ যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে প্লাটুনের সদস্যরা একটি বুদ্ধি আঁটে। বেয়োনেট উঁচিয়ে তারা দৌড় দেয় শত্রুর উদ্দেশ্যে । প্রায় ৮০ মিটার দৌড়ে ব্রিটিশ সেনাদের করা বেয়োনেট আক্রমণের সামনে সেদিন দাঁড়াতে পারেনি তালেবানরা। যেই ব্রিটিশ যোদ্ধার মাথা থেকে এই বেয়োনেট আক্রমণের বুদ্ধি এসেছিল, তাকে পরবর্তীতে সম্মানিত করে যুক্তরাজ্য সরকার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে বেয়োনেট ব্যবহারের সর্বশেষ নজির এটিই। সামরিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ জন স্টোন বলেন, "বেয়োনেটের লড়াই এখন একটি বিরল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বেয়োনেটের আক্রমণে হতাহতের দৃষ্টান্ত খুবই কম, নেই বললেই চলে।"
বেয়োনেট হচ্ছে মূল বন্দুকের সঙ্গে সংযুক্ত বর্শার মতো একটি বাড়তি অংশ। ধারণা করা হয়, ষোল শতকে মাস্কেট বন্দুকে প্রথম ব্যবহৃত হয় বেয়োনেট। সতের শতকে 'সকেট বেয়োনেট' নামের আরেক ধরনের বেয়োনেট আসে, যাকে মাস্কেটের মাথায় সকেটের মতো লাগান হতো। বেয়োনেট প্রযুক্তিতে সর্বশেষ বড় উদ্ভাবন এটিই।
দুই ভাঁজ করা যায় এমন মাস্কেট বন্দুকগুলো থেকে মিনিটে গুলি বের হতো দুই থেকে তিনটি। সেটিও আবার আবহাওয়া সাপেক্ষে। বৃষ্টি বা আর্দ্র আবহাওয়ার ঠিকভাবে কাজ করত না এসব বন্দুক। তাই তখন গুলির বিকল্প ছিল বেয়োনেট।
বন্দুক যত আধুনিক হয়েছে, বেয়োনেটের ব্যবহার ততই কমেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট হতাহতের দুই শতাংশ ছিল বেয়োনেটের শিকার।
ততদিনে মেশিনগানের মতো আধুনিক বন্দুক এসে গেছে। মেশিনগানের গুলি এবং গ্রেনেডের মুখে বেয়োনেট ঠিক করা এবং তা দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করাটা বোকামি ছাড়া কিছু না।
বেয়োনেটের উপর নির্ভর করে কোনো বাহিনীর সমর পরিকল্পনা সাজানোর সর্বশেষ নজিরও বেশ পুরনো- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনী। জাপানকে দেখে মার্কিন যোদ্ধাদেরকেও বেয়োনেটের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে যুদ্ধে বেয়োনেট তেমন ব্যবহার করেনি মার্কিনীরা, তারা ভরসা রেখেছে অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের উপরই।
মার্কিন সেনাবাহিনী সর্বশেষ বেয়োনেট ব্যবহার করেছে কোরিয়া যুদ্ধে।
আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তখন থেকেই বেয়োনেট একরকম ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের এই যুগে, যখন মিনিটে ১০ লাখ গুলি ছুড়তে সক্ষম (এম-১৩৪ মিনিগান) এমন অস্ত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে, তখন বেয়োনেটের প্রাসঙ্গিকতা থাকার কোনো প্রশ্নই উঠে না।
কিন্তু ক্রুজ মিসাইলের এই যুগেও বেয়োনেট রয়ে গেছে। আপাতত অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও সৈন্যদের "মনোবলগত" সরঞ্জাম হিসেবে থেকে যাওয়া এই অস্ত্রের দেখা এখনও মেলে যুদ্ধক্ষেত্রে।
এর পিছনে মনস্তত্ত্বটা এমন- প্লাটুন থেকে যদি কোনো সৈন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেই সৈন্য যেন ভীত হয়ে যুদ্ধ করার আগ্রহ না হারিয়ে ফেলে, তাই তার শেষ সম্বল হিসেবে থাকবে বেয়োনেট।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও কিন্তু বেয়োনেটের ব্যবহার রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত না হলেও মিলিটারি একাডেমিতে এখনও তরুণ ক্যাডেটদের দেওয়া হয় বেয়োনেটের প্রশিক্ষণ। এছাড়া, ক্যান্টনমেন্টগুলোতে প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত বেয়োনেট ফাইটিং প্রতিযোগিতা।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, বেয়োনেটের অনুশীলন একজন সৈনিকের নার্ভকে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য থিতু করে।
জন স্টোন বলেন, "সৈনিকদের স্ট্যামিনা ও রিফ্লেক্স বাড়াতে মূলত বেয়োনেট অনুশীলন করানো হয়। তবে এর অন্যান্য উপকারিতাও আছে। যেমন, আত্মবিশ্বাস এবং আগ্রাসন বাড়ান, ভয়ানক হুমকির মুখেও এগিয়ে চলার সাহস দেওয়া।"
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউনিটের সংহতি, সহযোদ্ধাদের ওপর আস্থা রাখা এবং তাদের জন্য লড়াই করার মনোভাবকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু এরপরও আর্টিলারি, উপর থেকে বোমাবর্ষণ, ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য আক্রমণে প্রায়ই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সৈনিকরা। প্রায়শই একা হয়ে যেতে অনেক সৈনিককে। এরকম পরিস্থিতিতে সেই সৈনিক পালিয়ে যাওয়ার বা লুকিয়ে থাকার চিন্তাও করতে পারেন।
বেয়োনেট বা বেয়োনেটের ছুড়িই তখন সেই যোদ্ধার জন্য একটি অমূল্য অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। আর বেয়োনেটের প্রশিক্ষণ দেয় এই ভয়ানক পরিস্থিতির মুখে এগিয়ে চলার সাহস।