মার্শাল ল মানি না: দক্ষিণ কোরিয়ার সৈনিকের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে আলোচনায় যে নারী
দক্ষিণ কোরিয়া এক অস্থির রাত পার করেছে। অনেকে ধারণা করছেন, এটি এখন পর্যন্ত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এ ঘটনায় নজর কাড়েন এক নারী যিনি সেনা সদস্যদের মুখোমুখি হয়ে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। খবর বিবিসির।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন অর্থাৎ মার্শাল ল জারি করায় তা প্রত্যাহারের দাবিতে মাঠে নামেন দেশটির বিরোধী দলীয় নেতাসহ সাধারণ মানুষ। গত মঙ্গলবার রাতে আইন প্রত্যাহারে ভোটের দাবিতে জড়ো হতে শুরু করেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বিরোধী দলের সদস্যরা। এসময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে এক সৈনিকের অস্ত্র টেনে ধরেন বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মুখপাত্র আহন গুই-রিয়ং (৩৫)। ওই ঘটনার ভিডিও তখনই অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আহন গুই-রিয়ং বলেন, "আমি কিছু ভাবিনি। আমি শুধু জানতাম যে আমাদের এটি থামাতেই হবে।"
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট দেশজুড়ে সামরিক আইন জারি করলে জাতীয় পরিষদে অবস্থান নেয় সামরিক বাহিনী। এ সামরিক আইনের ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবিতেই সেখানে রওনা হন আহন।
দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণ প্রজন্মের অনেকের মতো 'মার্শাল ল' শব্দটি আহনের জন্যও অপরিচিত ছিল। এটি সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল।
প্রথমবার এ ঘোষণা শোনার পর আহন বলেন, "এক ধরনের আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছিল।"
সামরিক আইন ঘোষণা করলে রাজনৈতিক কার্যক্রম, যেমন সমাবেশ ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, ধর্মঘট ও শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় এবং গণমাধ্যম ও প্রকাশনার কার্যক্রম সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আইন অমান্যকারীদের ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার বা আটক করা হতে পারে।
সামরিক আইন ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরোধী নেতা লি জে-মিয়ং নেতাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে জড়ো হতে এবং ওই ঘোষণা প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান।
স্থানীয় সময় রাত ১১টার কিছুক্ষণ পর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পৌঁছান আহন। সেসময়ের কথা মনে করে, তাদের কেউ যাতে ধরতে না পারে সেজন্য অফিসের বাতি বন্ধ করে, হেলিকপ্টারের হাত থেকে নিজেদের আড়াল করেছেন, সেসব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন আহন।
আহন জানান, তিনি যখন ভবনে পৌঁছান, তখন তার সহকর্মীরাসহ সাধারণ মানুষ এবং সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান করছিল। এ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "তখন আমার মনে দেশের পুরোনো ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।"
আহন ও তার সহকর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, যাতে সেনাবাহিনী প্রধান ভবনে প্রবেশ করতে না পারে।
তারা ভেতর থেকে দরজাগুলো তালাবদ্ধ করে এবং দরজার সামনে আসবাবপত্রসহ ভারী জিনিসপত্র দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। যখন সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে শুরু করে, আহন তখন সামনে এগিয়ে যান।
আহন বলেন, "সত্যি বলতে, শুরুতে আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এমন পরিস্থিতি দেখে মনে হলো, আমি চুপ করে থাকতে পারি না।"
রাত ১টার দিকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সামরিক আইন প্রত্যাহারের পক্ষে একটি প্রস্তাব পাস করে। উপস্থিত ১৯০ জন সদস্য সবাই এটি বাতিলের পক্ষে ভোট দেন। ভোর ৪টা ২৬ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইউন তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
বিশৃঙ্খলা থেমে যাওয়ার পর, আহন কিছুক্ষণ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ভেতরেই ঘুমান।
তিনি বলেন, "সকালে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি থেকে বের হতে আমি আসলে একটু ভয় পাচ্ছিলাম, কারণ আশেপাশে কোনো ট্যাক্সি ছিল না। আর রাতের এমন ঝড়ের পর বাস্তবতায় ফিরে আসা সত্যিই কঠিন ছিল।"
বিবিসির সঙ্গে কথা বলার সময় আহনের পরনে ছিল আগের রাতের ঘটনার ভিডিওতে দেখা সেই একই কালো টার্টলনেক এবং লেদার জ্যাকেট। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি আবেগে ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, "২১শ শতকে এসে কোরিয়ায় এমন কিছু ঘটছে যা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এবং হতাশাজনক।"