গোল তালাব ও ঢাকার শেষ পুকুরগুলো
'৩০০টি পুকুর ছিল ঢাকায়। খাল ছিল ১০০টির বেশি। নদী ছিল চারটি – বৃদ্ধাগাঙ্গিনী বা বুড়িগঙ্গা, নড়াই, বালু নদী আর পাণ্ডুনদী। ৭৫০ সাল মানে পাল আমলে এগুলো সবই ছিল ঢাকায়। ৪১০ বছর ছিল বুদ্ধিস্ট আমল। তারপর সেনরা রাজত্ব করেছে ৬৯ বছর। তবে তারা কোনো পূর্তকাজ মানে উন্নয়ন কাজে সময় দিতে পারেনি। ক্ষমতা সংহত করতেই গেছে তাদের সময়। তারপর শুরু হয় সুলতানি আমল, পাঠান যুগ হয়ে পৌঁছাই মোগল আমলে। ব্রিটিশ আমলেও কিন্তু পুকুর বা খাল ভরাট নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভীষণই কড়াকড়ি ছিল। কারণ আগুণ নেভানোর উৎস তো ছিল ওগুলোই।
এখনকার ঢাকাকে দেড়-দুইশ বছর আগে বসিয়ে দিন, পুকুর আর খালের ধারে উঁচুউঁচু সব ভবন, ভাবতেই অবাক লাগবে। দেখুন উন্নত দেশগুলোর লোকেরা ওয়াটারফ্রন্ট গড়ে শহরের ইতিউতি। কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, শহর রক্ষার জন্যও প্রয়োজন। আর আমরা পুকুর ভরে ইট-পাথরের জঙ্গল গড়েছি। ঢাকাই বসতির ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। সুপেয় জলের সহজলভ্যতাই ছিল এর কারণ। ঢাকার মাটিতে পানি বিশুদ্ধিকরণ রাসায়নিক যেমন পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামের প্রাচুর্য আছে। তাই ঢাকায় বসতি নেবে মানুষ- ভাবা কঠিন না। জানেন তো মসলিনের জন্য টলটলে সুন্দর পানি দরকার। অনেকের স্মৃতিচারণাতেই পাবেন, ধোয়ার পর মসলিন হয়ে গেল ধপধপে। এছাড়া দেখুন, ঢাবাকা থেকে ঢাকার নামকরণ (ঢাক, ডঙ্কা ইত্যাদি জনশ্রুতি)। ঢাকায় ছিল টিলা আর গজারি মানে শালের বন। ১০-১২ ফুট খুঁড়ে দেখুন ঠিকই পাল আমলের অজস্র স্মৃতিচিহ্ন পাবেন', কথাগুলো বলছিলেন হাশেম সুফী।
একজন হাশেফ সুফী
রায়সাহেব বাজারের স্টার হোটেলে প্রতিদিন তিনবেলা খান হাশেম সুফী। বয়স তার পঁচাত্তর। তিনি পড়েছেন বিজ্ঞান, করেছেন প্রশাসনিক দপ্তরে চাকরি, নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র। তবে তার ধ্যানজ্ঞান ঢাকা। ঢাকার ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের তিনি প্রধান নির্বাহী। ১৯৯৩ সালে তার বইয়ের (হাকীম হাবিবুর রহমান-পাচাস বারাস পাহলে, টীকা ও মতামতসহ তর্জমা) ভূমিকা লিখেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। আব্দুর রাজ্জাক লেখেন, 'তিনি (হাশেম সুফী) সত্যসন্ধানী। আপাত সাধারণ বিষয়েও তিনি মনোযোগী এবং সেগুলোর ভুল সংশোধনে আন্তরিক। আশা করি আগামীতেও তিনি এ ব্যাপারে ধারাবাহিক থাকবেন।'
হৃদযন্ত্রের কিছু গড়বড় ব্যতিরেকে পঁচাত্তর বছর বয়সেও সুফী সাহেব সক্রিয় আছেন। রোকনপুরের (লক্ষীবাজারের কাছে) এক নম্বর বাড়িটি তার। বাড়িতে একলাই থাকেন। দুয়েকবার চুরিও হয়েছে। একবার তো খোয়া গেছে অমূল্য সব পুরোনো মুদ্রা ও নথি। স্টার হোটেলে তার জন্য বাঁধা চেয়ার-টেবিল আছে, খাবার নির্দিষ্ট, সময়ও নির্ধারিত। বিল পরিশোধ করেন দিনেরটা দিনেই। বলছিলেন, 'ঢাকার লোক নম্রতা পেয়েছে বৌদ্ধদের কাছ থেকে আর পাঠানদের কাছ থেকে পেয়েছে উগ্রতা।'
পুকুর নিয়ে এবার
'মাত্রই তিরিশটি পুকুর টিকে আছে এখন ঢাকায়। লিখুন- নবাব বাড়ির গোলতালাব, বংশাল আব্দুল্লা সরকার লেনের পুকুর, নাজিরাবাজার পুবের গলির পুকুর, সিক্কাটুলি পুকুর, গেন্ডারিয়া নামা পাড়া পুকুর, জেলখানার ভিতরের পুকুর, এফএইচ হল পুকুর, জহুরুল হক হল পুকুর, জাদুঘরের পিছনের পুকুর, সায়েন্স ল্যাবের ভিতরের পুকুর, রাজারবাগ পুকুর, লালবাগ কেল্লার ভিতরের পুকুর, পিলখানার ভিতরের পুকুর, বলদা গার্ডন পুকুর, রোজ গার্ডন পুকুর, ঢাকেশ্বরী মন্দির পুকুর, গুলিস্তান পার্ক পুকুর, বৌদ্ধমন্দিরের ভিতরের পুকুর, কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিতরের পুকুর ইত্যাদি। বঙ্গভবনের ভিতরের পুকুরটাকেই কিন্তু বলা হয় মতিঝিল (মোতির পুকুর)। বেশ বড় পুকুর। এটি পুব-পশ্চিমে বর্গাকার। মুঘল আমলের পুকুর। ঢাকায় তিন মালিকানার পুকুর ছিল- ব্যক্তিগত, পঞ্চায়েত আর সরকারি। পঞ্চায়েত পুকুরগুলো ছিল জনকল্যাণের জন্য। এসব পুকুরের বেশিরভাগ মসজিদ সংলগ্ন হতো। এগুলোর কোনোটি গোসল করবার, কোনোটি আবার পানীয় জলের। পানীয় জলের পুকুরে লোকে 'নাইতে' পারত না। এজন্য তদারকী দল ছিল। ব্যক্তিগত অনেক পুকুরও কিছু ওয়াকফ করা হয়েছিল। এরপর বলি, আকার ধরেও তিনরকম পুকুর- উত্তর দক্ষিণে বড়, বড় স্কয়ার, ছোট স্কয়ার। প্রথম ভাগেরগুলো বেশি তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধ আমলে। গোল তালাবও কিন্তু উত্তর দক্ষিণে বড় ছিল, পরে গোল করা হয়েছে। রাজারবাগ পুকুরও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। বৌদ্ধ আমলের পুকুরগুলো বেশ বড় বড়। তবে নকশায় সেরা মোগলদের পুকুর। ওরা সবকিছুতেই সৌন্দর্য পছন্দ করত। ছোট স্কয়ার পুকুরগুলো মূলত ব্রিটিশ আমলের। সব পুকুরের ধারেই তাল আর নারকেল গাছ লাগানো জরুরী ছিল। কারণ এরা মাটি ধরে রাখে। রাজারবাগ পুকুরের ধারে নারকেল গাছ দেখবেন।
আরো কিছু পুকুর কিন্তু খাল বা নদী ব্লক করে তৈরি হয়েছে। রমনা আর ধানমন্ডি লেক তৈরি হয়েছে পাণ্ডু নদী ব্লক করে,' বলছিলেন হাশেম সুফী।
হাশেম সুফীর পুকুর
ফরিদাবাদে আমার নানাবাড়িতে দুইটা পুকুর ছিল। আমি বুড়িগঙ্গাতেও গোসল করেছি। টলটলে পানি ছিল তখন। বুড়িগঙ্গায় আমি ইলিশ মাছ দেখেছি, শুশুক দেখেছি। ফরিদাবাদে আস্তানার পুকুর বলেও একটা পুকুর ছিল। আমার নানাবাড়িতে তখন হয়তো ২০-২৫ জন মানুষ ছিল এখন ১৫০ জন হয়ে যাবে। তাই পুকুর তো ভরাট হবেই। নটরডেম কলেজের পুকুরও পেয়েছি আমি। চৌষট্টি সালের ব্যাচ আমরা। পুকুর ভরাট করেই তো মাঠ হয়েছে। একাত্তর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কাছে ঢাকার সব পুকুরের তালিকা ছিল। আগুন নেভানোর জন্যই তারা তালিকা কাছাকাছি রাখত। এখন মনে হয় ফাইলবন্দি হয়ে গেছে। মতিঝিল আর আজিমপুর কলোনিও ছিল পুকুরে ভরা। আমার খুব মনে পড়ে ধোলাইখালের লালমোহন সাহা স্ট্রিটের পুকুরটির কথা। এটা পুনঃখনন সম্ভব। সরকারি মালিকানার পুকুর। এটা পানিতে টইটম্বুর থাকলে দেখতেও ভালো লাগবে। আবার দেখেন বেইলি রোডের বেইলি পুকুর ঘিরেই কিন্তু নওরতন কলোনী গড়ে উঠেছে। নয়টা বাড়ি আমার চোখে ভাসে। ওই পুকুরটারও সংরক্ষণ সম্ভব। আরে ভাই, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টাপুর ছড়াই তো আর লেখা হবে না পুকুর না থাকলে। নতুন ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিকে কেবল ঝামেলা ভাববে। তাই কিছু পুকুর রাখা দরকার।
বংশালের পুকুরটি নিয়ে
বলা হয়ে থাকে, উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ভুট্টো হাজি পুকুরটি খনন করান। ছয় বিঘা আয়তনের এ পুকুর। এলাকাবাসীর পানি সমস্যা সমাধানে এটি খনন করা হয়ে থাকতে পারে। এটি লম্বায় ৪০০ ফুট আর প্রস্থে ২৫০ ফুট। গভীরতা ২০ ফুট। পুকুরটি চারধারে পাকা বেষ্টনী ও রাস্তা আছে। পুকুরপাড়ের নোটিশবোর্ড পড়ে জানা যায়, একে এক চক্কর দিলে ২৭৫ মিটার পাড়ি দেওয়া হয়। তাই ছয়বার চক্কর দিলে এক মাইল হয়ে যায় আর চারবারে হয় এক কিলোমিটার। জানা যাচ্ছে, প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার লোক এই পুকুরে গোসল করেন। পঞ্চায়েত কমিটি পুকুরটি রক্ষণাবেক্ষণ করে। তবে হাশেম সুফী, পুকুরটির বয়স ১৭০ বা আশি বছর ভাবতে নারাজ। ১৮৫০ সালের দিকে হয়তো এর সংস্কার হয়েছে কিন্তু এর বয়স অনেক বেশি হবে আর তা হতে পারে পাল আমলেরও।
আরো কিছু পুছতাছ
পিলখানার পুকুর কি হাতিদের পানি খাওয়াতে তৈরি হয়েছিল?
হাশেম সুফী: জ্বি না । পুকুর না থাকলে মনে হয় ওখানে পিলখানা হতোই না।
পুকুর ধরে ঢাকার কোনো রাস্তার নাম আছে?
হাশেম সুফী: মনে তো পড়ছে না। কলকাতায় এমন কিছু আছে। তবে ঢাকায় পুকুরপাড় গেইট, পুকুরপাড় জামে মসজিদ এমন ঠিকানা পাবেন।
পুকুর না থাকায় ঢাকার ক্ষতি কি হয়?
হাশেম সুফী: দেখাই যাচ্ছে, পানি জমে যায় রাস্তায়। আর যদি বড় করে আগুন লাগে তবে নেভানোর পানি পাওয়া যাবে না।
ঢাকার পুকুর নিয়ে কোনো বই-পত্র আছে?
হাশেম সুফী: আমি তো দেখিনি।
মুঘলরা তো ছবি আঁকাত। ব্রিটিশরাও চিত্রকলা পছন্দ করত। কোনো পেইন্টিংয়ে পুকুর দেখেছেন?
হাশেম সুফী: না দেখিনি।
ঢাকার পুকুরগুলো ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব রাখতে চান?
হাশেম সুফী: এটা খুবই বোকার মতো হবে। এটা অবাস্তব।
গোল তালাবে লেখক
আমাদের গাঁয়ের বাড়ির পুবদিকে খাল আর উত্তরে ধলেশ্বরী নদী। বাড়ি থেকে উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম বা পুব যেদিকেই পাঁচ মিনিট যাই সেদিকেই পুকুর। সবমিলিয়ে পাঁচটি। একটি কেবল কচুরিতে ভরা, বাকী সবগুলোতেই সাতার কাঁটা যায়। সবগুলোতেই বাঁধানো ঘাট আছে। সাতার আমার শেখা হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলাতেই মামাদের সাথে। ঢাকায় এসে পুকুরের জন্য হাপিত্যেশ ছিলই। গোলতালাব অবশ্য আমাদের সূত্রাপুরের বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু অনেকদিন ছিল জানারই বাইরে। ইসলামপুর পার হয়ে ফলপট্টি শুরু হয় যেখানে সেখানেই নবাববাড়ির পেছনে গোলতালাব মানে গোল পুকুর। গেল রমজান মাসে আমার ছেলে আহনাফকে নিয়ে পরপর দুইদিন গেলাম। প্রথম দিন দেখেই মন ভরে গিয়েছিল। নেমে প্রাণটাও ভরে গেল। তালাবে ঢোকার মুখেই টিকিট ঘর আর কাপড়চোপড় বদলানোর জায়গা। টিকিট ঘরটি মূলত এলাকার প্রবীণদের আড্ডাঘর। তালাবের পুবপাড়ে বিকাল থেকেই ভাজাপোড়ার দোকান বসে।
তালাবে নেমে প্রাণ জুড়ানোর কারণ এর গভীরতা। পুকুর যত গভীর হয়, পানি তত ভালো হয় বলে আমার ধারণা। অনেক লোক গোসল করছে, টিকিট মোটে পাঁচ টাকা। আমি নেমেই আধা পুকুর সাঁতরে নিলাম। বেশ বড় পুকুর। কয়েক জায়গায় মাছ ধরিয়েদের জন্য মাচাঙও বাঁধা আছে। পাঁচ বছর বয়সী আহনাফ নামল না, সে অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলেটেলে বেড়াল সিঁড়িতে। পরের দিন আহনাফের জন্যই আবার গেলাম। তাকে একটি সসার খেলনা কিনে দিয়েছি। উড়ে গিয়ে পানিতে চরকি পড়লে আহনাফের না নেমে উপায় থাকল না, অবশ্য তাকে আমি ধরে রেখেছিলাম, তার দু'জন তালাব-বন্ধুও আশপাশে ছিল। সুফী সাহেবের কথার সূত্র ধরে ভাবি এখন, আহনাফ তার ছেলেকে মানে আমার নাতিকে নিয়ে তালাবে ঝাঁপাতে পারবে তো?