ক্যারিয়ারে উন্নতির স্বার্থে কীভাবে আদর্শ স্বামী বা স্ত্রী বেছে নেবেন?
একজন উচ্চাভিলাষী, ক্যারিয়ারের সোপান বেয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ব্যক্তির জীবনসঙ্গী কেমন হওয়া উচিত? ঠিক কোন ধরনের নারী বা পুরুষকে তিনি বেছে নেবেন স্ত্রী বা স্বামী হিসেবে?
মানবহৃদয়ের এমন কোনো সুনাম নেই যে সে শীতলভাবে, সব ধরনের আবেগ-অনুভূতিকে পাশ কাটিয়ে এ জাতীয় হিসাবনিকাশ করতে পারবে। তারপরও, চলুন এক মুহূর্তের জন্য, মনে করি সে আসলে এ কাজে সক্ষম। তাহলে সে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির মধ্যে কোন ধরনের বৈশিষ্ট্য খুঁজবে?
তর্কাতীতভাবেই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যটি হবে বিবেচনাবোধ। কেননা বিবেচনাবোধ হলো মানুষের তথাকথিত 'বিগ ফাইভ' পারসোনালিটি ট্রেইট বা ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, যা সহজেই পরিমাপযোগ্য ও স্থিতিশীল (অন্য চারটি হলো বহির্মুখিতা, অকপটতা, নমনীয়তা ও মানসিক স্থিতিশীলতা)।
গবেষক ব্রিটানি সলোমন ও জশুয়া জ্যাকসন ৪,৫০০-র বেশি বিবাহিত ব্যক্তির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, ব্যক্তিত্বের প্রধান পাঁচ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কেবল বিবেচনাবোধই তার জীবনসঙ্গীর চাকরিজীবনের সন্তুষ্টি, উপার্জন ও পদোন্নতির সম্ভাবনার উপর অর্থবহ প্রভাব ফেলেছে। বিবেচনাবোধ বলতে বোঝানো হচ্ছে একজন ব্যক্তির তার সঙ্গীর ভালো-মন্দ, কষ্ট-আনন্দ বিবেচনা করে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা কাজ করার ক্ষমতা।
একজন ব্যক্তি নারীই হোক বা পুরুষ, তিনি যদি বিশ্বস্ত, গোছানো ও পরিশ্রমী স্বভাবের হন, তবে তার পক্ষে সঙ্গীকে খুশি করা বা সম্পর্ক ঠিক রাখা সহজ হয়। কেন? কারণ তিনি ঘরের কাজে বেশি হাত লাগান। শুধু তা-ই নয়, তিনি এমনকি তার সঙ্গীর রোল মডেলেও পরিণত হতে পারেন।
তবে বিবেচনাবোধের প্রমাণ যেভাবেই মিলুক, এর প্রভাব কিন্তু সহজেই পরিমাপ করা সম্ভব। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে নিজের অনুসন্ধান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অ্যান্ড্রু ও'কনেল লেখেন, কোনো ব্যক্তির জীবনসঙ্গী যদি বিবেচনাবোধসম্পন্ন হয়, তবে সেই বিবেচনাবোধের প্রতি এক স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন বা প্রমিত বিচ্যুতি বৃদ্ধির ফলে ওই ব্যক্তির বার্ষিক আয় বাড়ার সম্ভাবনা ৪,০০০ ডলার।
জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে আকাঙ্ক্ষিত দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। অ্যাটাচমেন্ট থিওরি বা সম্পৃক্ততা তত্ত্ব থেকে এসেছে এই বিষয়টি। শুরুতে মনে করা হতো, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কেই বুঝি কেবল নিরাপত্তার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনোবিদরা ক্রমশ বুঝতে পারছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কেও একটি 'সিকিউর বেইজ' অত্যন্ত জরুরি। 'সিকিউর বেইজ' হলো এমন একজন জীবনসঙ্গী—যার উপর নির্ভর করা যায়, যেকোনো দরকারে সাহায্য পাওয়া যায়, আবার যে নতুন নতুন কাজ করার উৎসাহও জোগায়।
কারও ক্যারিয়ার যখন তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ার জোগাড় হবে, একজন 'সিকিউর বেইজ' জীবনসঙ্গী তার প্রতি সহানুভূতি যেমন দেখাবেন, তেমনি তাকে হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতেও উদ্বুদ্ধ করবেন।
১১৩ জন ডুয়াল-ক্যারিয়ার দম্পতির (যারা একইসঙ্গে সমানভাবে সংসারও সামলান আবার নিজ নিজ ক্যারিয়ারও চালান) ইন্টারভিউ নিয়ে 'কাপলস দ্যাট ওয়ার্ক' বইয়ে 'লাভিং কিক' নামের এই তত্ত্বটি সৃষ্টি করেছেন ইনসিড অধ্যাপক জেনিফার পেট্রিগ্লিয়েরি।
'লাভ' শব্দটি থাকার পরও অনেকের কাছেই হয়তো ব্যাপারটিকে খুব একটা রোমান্টিক মনে হচ্ছে না। কিন্তু নানা শ্রেণি-পেশা-বয়স-জাতীয়তার দম্পতির সঙ্গে কথা বলে পেট্রিগ্লিয়েরি নিশ্চিত হয়েছেন যে এ ধরনের সম্পর্কের ফলে তারা ক্যারিয়ারের যেকোনো চড়াই-উতরাই একসঙ্গে পেরোতে পেরেছেন; নতুন শহরে স্থানান্তর বা সন্তান জন্মের পর সৃষ্ট জটিলতা থেকে পরিত্রাণ, কিংবা মধ্যবয়সে বা অবসর নেওয়ার পর কঠিন সময় পার করতেও পেরেছেন।
অবশ্য পেট্রিগ্লিয়েরি ঠিক এর বিপরীতধর্মী কিছু কথা লিখেও সাবধান করে দিয়েছেন তার পাঠকদের, 'একটি মিউচুয়াল সিকিউর-বেইজ রিলেশনশিপ জীবনকে আরও সহজ ও সোজাসাপটা করে দেয় না। প্যারাডক্সিক্যালি, এটি জীবনকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। জীবনসঙ্গীর মাঝে আমরা যখন সিকিউর বেইজ খুঁজে পাই, আমাদের তখন ঝুঁকি নেওয়া ও নতুন কিছু করার প্রবণতা বেড়ে যায়। এতে হয়তো জীবন নির্ঝঞ্ঝাট থাকে না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এতে জীবন ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে।"
অবশ্য অনেক দম্পতির মধ্যে কেবল একজনই ধারাবাহিকভাবে 'বেইজ'-এর দায়িত্ব পালন করে। এ ধরনের অসম সম্পর্কের অবস্থা অনেকটা 'বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট'-এর মতোই। তাই এরকম বিয়ে ততক্ষণ পর্যন্তই ঠিকঠাক চলে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো একজন তাদের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে। তবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর কোনো একজনের রাগ-ক্ষোভ-অসন্তোষে ফেটে পড়াই স্বাভাবিক।
এদিকে, যদিও সলোমনের গবেষণায় দেখা গেছে যে কোনো একজন জীবনসঙ্গীর সহজেই কোনো ব্যাপারে সম্মত হওয়ার প্রবণতা অন্যজনের উপার্জন বাড়ার ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলে না, তারপরও সহজে কোনো ব্যাপার মানতে চায় না এমন কাউকে বিয়ে করা যথেষ্ট বিপজ্জনক। আপনি হয়তো ভাবছেন, 'আমি কেন এমন কাউকে বিয়ে করব যে অনমনীয়, সহজে কিছু মানতে চায় না?' উত্তরটি হলো: কারণ এ ধরনের মানুষের দৃঢ়চেতা, আত্মবিশ্বাসী ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ মানসিকতার অধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নমনীয় মানুষেরা সাধারণত অনমনীয় মানুষদের চেয়ে কম টাকা আয় করে। সাহিত্যেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। কথায় আছে, 'Nice guys finish last!' বিদ্বজ্জনরা অবশ্য এখনও এর কারণ অনুসন্ধান করে চলেছেন। পুরুষদের বেলায় একটি হাইপোথিসিস হলো—তারা যদি নম্র-ভদ্র, সংবেদনশীল ও পরোপকারী হয়, তবে তা প্রচলিত জেন্ডার নর্মের সঙ্গে খাপ খায় না। তাই এ ধরনের পুরুষ কর্মস্থলে উন্নতি করতে পারে না। তাদেরকে কম বেতনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অথচ নারীরা যদি নমনীয় মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে থাকে, তাতেও তাদেরকে খুব একটা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয় না। অন্তত পুরুষদের মতো অতটা সাংঘাতিক সাজা তো কখনোই নয়!
কিন্তু ব্রিটানি সলোমন ও তার দলেরই করা আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, অনমনীয় বিবাহিত পুরুষরা একই ধরনের অবিবাহিত পুরুষদের চেয়ে বেশি আয় করে। সলোমন ও তার সহকর্মীরা এর সম্ভাব্য কারণ এভাবে অনুমান করেছেন যে, অনমনীয় বিবাহিত পুরুষদের বেশি আয়ের নেপথ্য কারণ তাদের কর্মস্থলে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়া নয়, বরং এর কারণ হলো তাদেরকে সংসারের কাজ ও সন্তান দেখভালে কম সময় ব্যয় করতে হয় বলে তারা পেশাদার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে বেশি সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করতে পারে।
এবার আসা যাক আয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গে। বেশ অনেকগুলো গবেষণাতেই দেখা গেছে, স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর উপার্জন বেশি এমন বৈবাহিক সম্পর্কগুলো শেষ অবধি ডিভোর্সে গড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।
তবে এ নিয়ে খুব বেশি ভাবার প্রয়োজন নেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সবসময়ই উদযাপনের মতো একটি ব্যাপার। যদি একজন নারীর মনে হয় তার বিয়েটা ঠিকঠাক চলছে না, এবং তার নিজের জীবিকা নির্বাহের মতো অর্থনৈতিক সংস্থান থাকে, তাহলে তার ওই তিক্ত সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাই শ্রেয়।
তাছাড়া গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যেসব বৈবাহিক সম্পর্কে স্ত্রীর আয় স্বামীর চেয়ে বেশি, সেখানে স্বামী যদি গৃহস্থালির সিংহভাগ কাজ নিজেই করে, তাহলে ওই সম্পর্কে সহজে ভাঙন ধরার আশঙ্কা থাকে না। সুতরাং, যেসব স্বামী স্ত্রীর চেয়ে কম আয় করেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী, তারা এ ব্যাপারটি মাথায় রাহতে পারেন!
তবে হ্যাঁ, এসব গবেষণা সামগ্রিকভাবে বেশ চমকপ্রদ মনে হলেও, পৃথকভাবে কোনো ব্যক্তিবিশেষের জীবনে কি আসলেই কার্যকর? কেউ কি চাইলেই তার জীবনসঙ্গীকে নিজের মতো করে 'শুধরে' নিতে পারে? কিংবা বর্তমান সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গিয়ে 'আরও ভালো' কাউকে বেছে নিতে পারে? সম্ভবত নয়। যেমনটা স্কলার বেথ লিভিংস্টন বলেছেন, 'দম্পতিরা সবসময়ই অতটা "যৌক্তিকভাবে" কাজ করে না, যতটা পারিবারিক দর কষাকষির অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয়।'
কিন্তু তারপরও, দৈবক্রমে যাদের জীবনসঙ্গী বিবেচনাবোধসম্পন্ন, নির্ভরযোগ্য, এবং খুব বেশি অনমনীয় নয়, তারা নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করতেই পারেন!
- (ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত)