সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে হুমকির মুখে সামুদ্রিক প্রাণীরা
বর্তমানে বিশ্বের একটি বড় সমস্যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। এই উষ্ণতা বাড়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে যা বাস্তুসংস্থানের জীবন ধারণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শুধু যে মানুষের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে তা না, এটি সমুদ্রিক প্রাণীদের একটি বড় অংশের জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাছপালার মতো সমুদ্রও পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশকে শীতল রাখতে ভূমিকা রাখে। সমুদ্রের ঢেউ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে তা অতল গভীরে ম্লান করে দেয়। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমুদ্রের তাপ বাড়িয়ে তুলেছে কয়েকগুণ। ফলে সমুদ্রে বাস করা প্রাণীরা অকালে মারা যাচ্ছে। প্রানীদের অস্বাভাবিক এই মৃত্যুতে সমুদ্র যেন এখন মৃত্যুপুরীতে রূপ নিচ্ছে।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের করা কিছু গবেষণায় এই বিষয়টির সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। কম সময়ের মধ্যে একাধিকবার সমুদ্রের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে তা একসময় ব্যাপক ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। ২১ শতকের শুরুর দিকে মানবসৃষ্ট কারণে বৈশ্বিক জলবায়ু বাড়তে থাকলে এই সমস্যা আরও তীব্রতর হতে থাকে।
২০২১ সালের ৫ মে ন্যাচার মেগাজিন একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে সমুদ্রের তাপবৃদ্ধি নিয়ে, যেখানে মূল লাইনটি ছিল, "হঠাত করে সামুদ্রিক পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা বাস্তুসংস্থানকে ওলট-পালট করে দিতে পারে। কখন এমন ভয়াবহ অবস্থা ঘনিয়ে আসবে তার পূর্বাভাস দিতে তড়িঘড়ি করে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা"।
ওই একই প্রবন্ধে তুলে ধরা হয় ১০ বছর আগের সময়ের কথা, যখন অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রের তীরে মাছ মরে ভেসে আসতে শুরু করলো, বিজ্ঞানীরা তখন প্রথম সামুদ্রিক তাপমাত্রা বাড়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু করেন।
পৃথিবী নামক এই গ্রহের তাপমাত্রা দিনকে দিন যেন বেড়েই চলেছে, যা পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন প্রমাণই মিলছে, সমুদ্রের তাপ বেড়ে যাওয়ার জন্যই সামুদ্রিক প্রাণীরা এমন ভয়াবহ ঘটনার শিকার হচ্ছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমুদ্রের তাপও।
ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) এর তথ্য অনুযায়ী পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙে ২০২১ সালের জুলাইতে সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছিল । ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর স্যাটেলাইট সিস্টেম বলছে, গত সাত বছরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ছিল সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত ।
প্রকৃতি থেকে অত্যধিক পরিমাণ কার্বন শোষণ ও বায়ুমন্ডলের ৯০ ভাগ তাপ শুষে নেওয়ার কারণে সমুদ্রের তাপ বেড়ে যাওয়ায় সেখানে বাস করা প্রাণীরা এখন হুমকির মুখে। শুধুমাত্র ২০২১ সালেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কলাম্বিয়া উপকূলে ১০০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী মারা গেছে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে, উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত দেশগুলো একসময় মৎস্যসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল, এখন তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ (বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল সিস্টেম) নব্বইয়ের দশক থেকে এই পর্যন্ত ৫ বার ভয়াবহতার মুখে পরেছে। ১৯০০ সালের পর এই প্রথম ২০২০ সালে সমুদ্রের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। আর্ন্তজাতিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থার (আইপিসিসি) মতে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে।
সমুদ্র নিয়ে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮৭০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বেড়েছে ৫৭ ভাগ তাপ। যারমধ্যে ২০১৪ সালেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ ভাগের বেশি। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে এটি একসময় সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিবে।
২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে 'আইপিসিসি' প্রস্তাব করেছিল তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখতে। কিন্তু ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই আমাদের বাস্তুসংস্থান পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
তাই উন্নত রাষ্ট্র ও বিশ্ব নেতাদের এই সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকে ঠেকাতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে সমুদ্রের তাপমাত্রা আরও ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে। যা সমুদ্রে থাকা সকল প্রাণীর প্রাণ কেড়ে নিয়ে একসময় এদেরকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিবে।
সূত্র: কাউন্টার পাঞ্চ