প্রিয় বেলি কেডসের উত্থান ও পতনের কাহিনি
১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল বেলি কেডস।
শিশু ও তরুণদের পছন্দের শীর্ষে ছিল বেলি কেডস। কেনাকাটা করতে গিয়ে মাপমতো কেডস না পেলেই বাচ্চারা জুড়ে দিত কান্না। তাদের থামানোই তখন বাবা-মায়েদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ত। প্রায় সবসময়ই বেলি কেডসের চাহিদা সরবরাহকে ছাড়িয়ে যেত।
বেলি কেডসের দুই প্রতিষ্ঠাতার একজন আব্দুস সাত্তার। উত্তরার বেলি কমপ্লেক্সে নিজ অফিসে বসে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, 'অভিভাবকরা টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, বাচ্চাদের কান্নাকাটি তারা থামাতে পারছেন না।'
চাহিদা মেটাতে বেলি কেডস কোম্পানি আরও মেশিন এনে সরবরাহ বাড়ায়। 'এর পর কিছুটা হলেও বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছি,' বলেন তিনি।
১৯৯০-এর দশকে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পোর্টস শু হয়ে ওঠে বেলি কেডস। ওই সময় বেলি কেডসে বাজার হিস্যা ছিল ৭০ শতাংশ। কিন্তু ২০০০-এর-এর দশকে কোম্পানিটির সেই দাপট মিইয়ে যায়।
শুরুর গল্প
আব্দুস সাত্তারের বয়স এখন ৭০। একসময় তিনি গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করতেন। তার বড় ভাই কাজ করতেন মার্কেটিং ও অন্যান্য বিভাগে। বেলি কেডসের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের জন্য স্যান্ডেলও বিক্রি করেছিল।
বালি কেডসের উত্থান-পতনের পেছনে আছে দুই ভাই আবুল কাশেম ও আব্দুস সাত্তারের গল্প। তবে গল্পের শুরুটা আরও পেছনে, আরেকজন মানুষের হাত ধরে। যার ভবিষ্যদ্বাণী কাজ করেছিল জাদুর মতো। ওই মানুষটা এ দুই ভাইয়ের পিতা কেরামত আলী মিয়া।
তারুণ্যে রেঙ্গুনে গিয়েছিলেন কেরামত আলী মিয়া। সেখানে তিনি জুতার দোকানে কাজ করতেন। পরে তিনি তার এক বন্ধুকে নিয়ে রেঙ্গুনে একটি ছোট কারখানা গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই তিনি বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ফেরার কদিন পরই তিনি ঢাকার নিউ মার্কেটে ৩০০ টাকায় একটি দোকান কিনেন।
কেরামত আলী মিয়া প্রথমে লাগেজ ব্যবসা শুরু করেন। ট্রাভেল ব্যাগ, স্যুটকেস আমদানি করে সেগুলো তিনি বেঙ্গল লেদার নামে নিজের দোকানে বিক্রি করতেন। একই বাজারে কিছু জুতার দোকান ছিল। বেশিরভাগ জুতার দোকানের মালিকই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের—অবাঙালি ও পাঞ্জাবি। তারা পাকিস্তান থেকে ভালো জুতা এনে ভালো লাভে ঢাকায় বিক্রি করতেন।
তবে লাভজনক হলেও, লাগেজ ব্যাগগুলো ভালো মানের ছিল না।
আব্দুস সাত্তার স্মরণ বলেন, 'তাদের ব্যবসায় ভালো লাভ দেখে একদিন বাবা আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমরা জুতার ব্যবসা শুরু করব কি না। তিনি আমাদের বলেছিলেন যে আমরা এই ইন্ডাস্ট্রিতে এরচেয়ে অনেক বেশি লাভ করব।'
আব্দুস সাত্তারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজধানীর লালবাগে। ১৯৬৮ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ওই বছরই বাবার লাগেজ ব্যবসায় যুক্ত হন।
সাত্তার আর তার বড় ভাই জুতার ব্যবসা শুরু করেন ১৯৮৪ সালে।
দুই ভাই প্রথমে থাইল্যান্ড, হংকং ও তাইওয়ান থেকে জুতা আর স্যান্ডেলের কাঁচামাল আমদানি শুরু করেন। এরপর তারা নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের জুতা, স্যান্ডেল ও কেডস আমদানি আরম্ভ করেন। ওই সময় তাদের বাবা মারা যান।
দুই ভাই নিউ এলিফ্যান্ট রোডে একটি শোরুম কেনেন। সুইস ফ্যাশন ব্র্যান্ড ব্যালির নামানুসারে ওই শোরুমটির নাম দেন 'বেলি'।
'তবে আমরা শব্দটি থেকে একটি "এল" অক্ষর বাদ দিয়ে দেই। পশ্চিমা দেশগুলোতে স্পোর্টস শুর জন্য কেডস নামটি বহু বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই আমরা নামের সাথে কেডস শব্দটি জুড়ে দিলাম,' আব্দুস সাত্তার জানান।
কয়েক মাসের মধ্যেই স্পোর্টস শু ব্যবসায় সাফল্য এনে দেয় তাদের নতুন শোরুম। সেইসঙ্গে জানান দেয় এই ব্যবসার সম্ভাবনা, যা তারা আগে কল্পনাও করতে পারেননি। হটকেকের মতো বিক্রি হয় আমদানি করা জুতা। এই বিক্রি তাদের উদ্যোগকে নতুন ধাপে নিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়।
পুরান ঢাকায় আগে থেকেই কিছু জুতা প্রস্তুতকারক স্পোর্টস জুতা তৈরি করত। কিন্তু জুতাগুলো হাতে সেলাই করা হতো বলে ওগুলোর গুণগত মান তত ভালো ছিল না। তাছাড়া এই স্থানীয় জুতাগুলোর হিল ছিল উঁচু, আর ওজন ছিল অনেক। জুতার চেহারায় মসৃণ ভাব ছিল না। অন্যদিকে আমদানি করা জুতাগুলো ছিল হালকা ও ফ্যাশনেবল।
একবার সাত্তার স্থানীয়ভাবে তৈরি একজোড়া চামড়ার জুতা পরে সিঙ্গাপুরে যান। পরে সিঙ্গাপুরে তিনি একজোড়া স্পোর্টস জুতা পরেন। দুই জুতায় তিনি বিশাল তফাত টের পান।
সাত্তার বলেন, 'আমার মনে হয়েছিল আমরা ঠিকমতো জুতা বানাচ্ছি না।'
দুই ভাই যখন দেখলেন তাদের আমদানি করা স্পোর্টস জুতা হটকেকের মতো বিক্রি হচ্ছে, তখন তারা বিদেশ থেকে মেশিন ও কাঁচামাল এনে এই কেডস নিজেরাই তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।
আব্দুস সাত্তার বলেন, 'শোরুম দেয়ার পর আমরা বুঝতে পারি যে দেশে কেডসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।'
ঘণ্টায় ২০ জোড়া জুতা তৈরি করতে সক্ষম একটি মেশিন আনেন তারা। যন্ত্রটি আনতে খরচ হয় প্রায় ৩ লাখ টাকা। গাজীপুরে একটি ছোট টিনশেড কারখানায় মেশিনটি স্থাপন করা হয়।
'প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ঘণ্টায় ২০ জোড়া জুতা মানে বিশাল পরিমাণের জুতা। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল ছিল। পর্যাপ্ত কেডস বানানোর আগেই আমাদের স্টক ফুরিয়ে যায়,' বলেন সাত্তার।
এক বছরের মধ্যে জুতার চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে দুই ভাই পাঁচগুণ উৎপাদনক্ষমতার আরেকটি মেশিন আনতে তাইওয়ানে যান। এই মেশিনটি ঘণ্টায় ১০০ জোড়া ছোটদের জুতা এবং ৭৫ জোড়া প্রাপ্তবয়স্কদের জুতা তৈরি করতে পারত।
চাহিদা বাড়তেই থাকে। এরপর তারা কারখানা করার জন্য মিরপুরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় পাঁচ কাঠার একটি প্লট কেনেন।
সাত্তার বলেন, 'টাকা আসতে থাকে। লাভের পরিমাণ ছিল ৩০-৪০ শতাংশ। এ কারণে আমরা নতুন মেশিন নিয়ে আসি।'
জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালে তাদের মিরপুরের কারখানায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করত। চারতলা কারখানায় প্রতিদিন দেড় হাজার জোড়া জুতা তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করা যেত। কিছুদিন প্রতিদিন আড়াই হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন করার সক্ষমতা অর্জন করেছিল কারখানাটি।
কোম্পানিটির চারজন এজেন্ট ছিল। তারা বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রির দায়িত্ব পালন করত।
মার্কেটিং মন্ত্র
বেলি কেডসের চাহিদা বাড়ার পর কোম্পানিটি আরও বেশিসংখ্যক গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর জন্য টেলিভিশন বিজ্ঞাপন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
সাত্তার জানান, 'আমার বন্ধু আনোয়ার হোসেন এফডিসিতে ছিলেন। তিনিই বলেছিলেন আমাদের উচিত বিজ্ঞাপন তৈরি করা। জিঙ্গেল, সুর, চিত্রনাট্য আর মডেল বাছাই করার জন্য তাদের সাথে কয়েকবার বসি আমরা।'
ওই সময় বসুন্ধরা সবে দেশের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিতে তাদের প্লটের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেছিল। ঈদে বিজ্ঞাপনের এয়ারটাইম পেতে বসুন্ধরা, ইউনিলিভার ও বেলি কেডসের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল।
বিজ্ঞাপন ও স্পোর্টস ইভেন্ট স্পনসর শুরুর পর থেকে বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ওই সময় জাম্প কেডস, রাইডার কেডস, অ্যাকশন কেডসের মতো প্রতিযোগীরা বাজারে প্রবেশ করে।
'কিন্তু তারা আমাদের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেনি, কারণ আমাদের মেশিন কাজ করত অনেক দ্রুত। আমাদের বাজারও শক্তিশালী ছিল,' সাত্তার বলেন, 'আর একটা জিনিস যা আমাকে সবসময় সাহায্য করেছে, তা হলো আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পারতাম।'
ফুটওয়্যার খাতে ট্রেন্ড তৈরিতে তিনি সফল হয়েছেন বলে মনে করেন সাত্তার।
তিনি বলেন, 'বাটা থাকলেও ওরা অতটা আধুনিক ছিল না। একবার বাটার কানাডিয়ান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমার কারখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছেই সেখান থেকে সরাসরি আমাদের মিরপুরের কারখানায় চলে আসেন।
'গ্রাহকদের আধুনিক জুতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পেরেছি বলে আমি খুশি। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল জুতাকে ফ্যাশনেবল, টেকসই এবং আরামদায়ক করা। আমরা বাটার চেয়ে [বিক্রির দিক থেকে] অনেক এগিয়ে ছিলাম। ওয়ি সময় বাটাকে আমি হাতি আর আমাদের মশা মনে করতাম।'
বিদেশে গেলেই সাত্তার মানুষের মুখ দেখার আগে জুতা দেখতেন। তিনি বলেন, 'হংকং বা তাইওয়ানে গেলে আমি তরুণ-তরুণীদের দেখতাম। দেখতাম তারা কোন জুতা পরে, কীভাবে তারা নিজেদের ভারসাম্য রক্ষা করে। জুতা নিয়ে আমি রীতিমতো মোহাবিষ্ট ছিলাম।'
সাত্তার তার ছোট ছেলেকে বিভিন্ন ধরনের জুতা দেখানোর জন্য নানা দেশে নিয়ে যান। আর তিনি কখনও জুতা ও লাগেজ কারখানা পরিদর্শন করতে ভুলতেন না।
'আমার উদ্দেশ্য স্রেফ আনন্দভ্রমণ ছিল না,' সাত্তার বলেন।
তিনি আরও বলেন, তারা ব্যবহার করার আগে 'কেডস' শব্দটি দেশে তেমন পরিচিত ছিল না। মানুষ এটাকে কেবল স্পোর্টস শু হিসেবেই চিনত।
বিভাজন ও অন্তর্ধান
পারিবারিক ব্যবসা ভাগ করে ফেলার কারণ বেলি কেডসকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
আব্দুস সাত্তার বলেন, ১৯৯৬ সালে দুই ভাইয়ের পারিবারিক ব্যবসা ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে বেলি কেডস হারিয়ে যায়।
সন্তানরা বড় হয়ে গিয়েছিল, তারা উচ্চশিক্ষা শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফেরে। তাই তাদের পর সন্তানেরা যেন ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, সেজন্য দুই ভাই পারিবারিক ব্যবসা ভাগ করে ফেলেন।
নিজে কোন ব্যবসা রাখতে চান, তা বড় ভাইকে জানান আব্দুস সাত্তার। তবে তার ভাতিজারা বেশি আগ্রহী থাকায় বেলি কেডস তার বড় ভাই নেন। আর নিজ শাখার অন্যান্য ব্যবসা ও সম্পদ নেন সাত্তার।
তিনি বলেন, 'জুতা [ব্যবসা] তৈরি করতে চাইলে এটা নিয়েই আপনাকে সারাক্ষণ ভাবতে হবে। তা নাহলে কাজটি চ্যালেঞ্জিং। বেলি কেডস আর নেই, এজন্য আমার দুঃখ হয়। আমার মনে হয় ব্যবসাটাকে আমি অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারতাম। এখন কোথাও বেলি নামটা দেখলেই আমার খারাপ লাগে।'
আব্দুস সাত্তার কখনোই বেলি ব্র্যান্ডের নামে জুতা বানাতে পারবেন না বলে একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি মেনে চলেছেন তিনি। আবুল কাশেম আর বেঁচে নেই। বেলি কেডসও বাজার থেকে উঠে গেছে। তবে আবুল কাশেমের তিন ছেলের নেতৃত্বে বেলি গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ প্লাস্টিক, চিংড়ি ও টেক্সটাইল শিল্পে উন্নতি করছে।
আবুল কাশেমের ছেলে ও বেলি গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মো. মাসুদ জামান বলেন, 'বালি কেডস বন্ধ করে দেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল না। তবে আমরা [বেলি কেডসের কার্যক্রম] আবার চালু করব বলে আশা করছি।'
আব্দুস সাত্তার এখন স্টেপ গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের অধীনে স্টেপ নামে আরেকটি জুতা কোম্পানি খুলেছেন। প্রতিষ্ঠানটি ট্রাভেল ব্যাগও তৈরি করে। তার ছেলে শামীম কবির ফুটওয়্যার বিভাগ এবং সাত্তার নিজে অর্নেট নামের ব্র্যান্ডের আওতায় ট্র্যাভেল ব্যাগ সেকশনের নেতৃত্বে আছেন।
তারা যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাভেল ব্যাগ রপ্তানি করছেন।
আব্দুস সাত্তার বাজার থেকে ট্রাভেল ব্যাগ কেনেন। তারপর ব্যাগটি কী কী উপকরণ দিয়ে তৈরি, তা দেখার জন্য ব্যাগটি কাটেন।
'একে বলা হয় আরএনডি—গবেষণা ও উন্নয়ন। আমি ঠিক সেই কাজটি করছি,' বেলি কেডসের মতোই এ উদ্যোগগুলোকেও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চান জানিয়ে বলেন আব্দুস সাত্তার।