আজই মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রথম কোনো মানুষ, ইউরি গ্যাগারিন
'পাইয়েখালি' আমার জানা প্রথম রুশ শব্দ যার অর্থ চলো যাই! মহাশূন্যে প্রথম গমনকারী মানুষ রুশ দেশের মানুষ ইউরি গ্যাগারিন রকেটে চেপে এই শব্দটি চিৎকার করে বলেছিলেন। ইউরি গ্যাগারিন একজন মহানায়ক, ইতিহাসের এক অনন্য মুহূর্তের একমাত্র সাক্ষী। আজ পর্যন্ত পৃথিবী নামের নীল গ্রহে কয়েকশ কোটি মানুষ বাস করেছে, তাদের মধ্যে গ্যাগারিনই প্রথম দেখেছিলেন শূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখতে কেমন লাগে, কতটা ভয়াল সুন্দর শূন্যে ভাসমান আমাদের নীল বাড়ি।
এই মানুষটিকে নিয়ে ব্যপক আগ্রহ সবার সারা বিশ্ব জুড়েই, নিঃসন্দেহে তার এই অর্জনের পেছনে হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ এবং কোটি মানুষের পরোক্ষ অবদান ছিল তারপরও ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তে অবস্থানের কারণে গ্যাগারিন হয়ে উঠেছেন অমর একজন মানুষ। তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র পরিচালক জেমি ডোরান এবং লেখক পায়ার্স বিজোনি'র 'স্টারম্যান, দ্য ট্রুথ বাহাইন্ড দ্য লিজেন্ড অব ইউরি গ্যাগারিন' বইটি ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম, সেটারই একটা আলোচনা লিখেও ফেলিছিলাম ঝটপট।
১৯৩৪র ৯ মার্চ মস্কো থেকে ১৬০ কিলোমিটার পশ্চিমের এক ছোট গ্রাম ক্লুসিনোতে ইউরির জন্ম, বাবা অ্যালেক্সি পেশাগত ভাবে ছিলেন যৌথখামারের একজন কাঠমিস্ত্রী এবং মা আন্না দুগ্ধখামারে কাজ করতেন। সাধারণ সেই কৃষক পরিবারের জীবন আরও কোটি কোটি রাশানের জীবনের মতই চিরতরে পরিবর্তিত হয়ে যায় ১৯৪১ সালে যখন ৩০০০ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কামানের গর্জনে। ছোট্ট ইউরি যুদ্ধের মাঝে বেড়ে উঠতে থাকেন উৎকণ্ঠা এবং জীবনের কালো দিককে সাথী করে।
এর মাঝে রাস্তায় বোতল ভেঙ্গে কাঁচের টুকরো ফেলে জার্মান হানাদার বাহিনীর গাড়ির চাকা ফুটো করার বানোয়াট অভিযোগে বিকৃতরুচির অধিকারী আলবার্ট নামের এক সৈন্য (যাকে গ্রামের বাচ্চারা শয়তান বলে ডাকত) ইউরির পিঠাপিঠি ছোট ভাই বরিসকে চকলেট দেবার ছলে মাটিতে চকলেট ফেলে দেয়, বরিস চকলেট নেবার চেষ্টা করলে বুট দিয়ে তার নিষ্পাপ ক্ষুদে আঙ্গুলগুলো থেতলে দিয়ে সেই শয়তান তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেয়ে এক আপেল গাছের ডালে নিজের স্কার্ফ দিয়ে ফাঁসি দেবার জন্য ঝুলিয়ে রেখে চলে যায়, শিশুটিকে মৃত্যুর মুখে ফেলে। তার আগে সে ঝুলন্ত বরিসের কিছু ছবিও তোলে ক্যামেরা দিয়ে, এরপর গুলি করার জন্য পিস্তল হাতে নিলেও তার দলনেতার আদেশে ফিরে যায় গুলি না করেই। তৎক্ষণাৎ ইউরির বাবা-মা যেয়ে সেই ফাঁস থেকে বরিসকে উদ্ধার করেন। এই ঘটনা এক অমোচনীয় কালো দাগ ফেলে ইউরির মনে।
যুদ্ধের মধ্যে গ্যাগারিন পরিবার তাদের চার সন্তানের মাঝে (ভ্যালেন্তিন, জয়া, ইউরি, বরিস) বড় দুইজনকে চিরতরে হারিয়েই ছিলেন বলে ভেবেছিলেন শেষের একবছর, অবশেষে ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে ভ্যালেন্তিন এবং জয়া ফিরে আসে পরিবারের কাছে জীবন্ত অবস্থায়। জীবন এগিয়ে চলে আপন গতিতে, ইউরি এবং বরিস জীবনের প্রথম পড়া শুরু করে রাশান সৈন্যদের ফেলে যাওয়া সামরিক ম্যানুয়াল থেকে।
ইউরির স্কুলজীবন নিয়ে তার শিক্ষিকা ইয়েলেনা স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন ইউরির মধ্যে সততা ছিল খুব বেশি পরিমাণে, যে কোন দুষ্টুমি করার পরে স্বীকার করে বলতেন- এটা আমি করেছি, আর করব না!
ভ্যালেন্তিনের মনে পড়ে ৬ বছর বয়সী ইউরি যখন তাকে বা বাবাকে কাঠের ছোট মডেল বিমান বানিয়ে দিতে বলত, আর বলত- আমি বিমান চালক হব, দেশের একজন নায়কে পরিণত হব। সেই ক্ষুদে গ্রামের উপর দিয়ে বিমান উড়ত খুবই কম, হয়ত সেই বিরল ঘটনা থেকেই ইউরির মনে আকাশে ওড়ার বাসনা ঠাঁই নিয়েছিল প্রবল ভাবে।
১৬ বছর বয়সে ইউরি নিজের উপার্জন শুরু করার জন্য প্রথমে লেনিনগ্রাদে (বর্তমানে সেইন্ট পিটার্সবার্গ)আসেন, সেখানে খুবেএকটা সুবিধে করতে না পেরে ১৯৫০ সালে মস্কো চলে যান, এক মেটাল কোম্পানির চাকরি পেয়ে। সেখানেই জীবনের প্রথম ইউনিফর্মের গর্বিত মালিক হয়ে পকেটের শেষ রুবলগুলো খরচ করে ইউনিফর্ম সমেত একটি ছবি তুলে পাঠান বাড়িতে।
তার ছাত্র জীবন পুনরায় শুরু হয় স্যারাটোভ টেকনিক্যাল স্কুলে, যেখান থেকে ১৯৫৫ সালে ২১ বছরের ইউরি গ্রাজুয়েশন পূর্ণ করেন। এর আগে ১৯৫১ বসন্তে স্থানীয় ফ্লাইং ক্লাবের দর্শন পেয়ে সেখান বিমান চালনা শেখা শুরু করেন, ট্রেনিং-এ ব্যবহার করা হয়েছিল ওয়াইএকে-১৮ (YAK-18) ধরনের বিমান, প্রথমবারের সংক্ষিপ্ত উড্ডয়নে তারা ১৫০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছেছিল, ইউরির সহজাত দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে প্রশিক্ষক দিমিত্রি মার্টিনভ বলেছিলেন- চমৎকার চালাচ্ছ হে, এইবারই যে প্রথমবার বিমানে উড়ছ মনেই হচ্ছে না! উত্তরে সদা কৌতুকরত ইউরি বলেছিল- আহ, আমি সারাজীবনই বিমান চালাচ্ছি!
পরবর্তীতে উরাল নদীর তীরবর্তী ওরেনবুর্গ বিমান চালনা একাডেমিতে ভর্তি হন ইউরি, অন্য অনেক ব্যাপারে সাবলীলতা দেখালেও তার অবতরণ বা ল্যান্ডিং নিখুঁত হচ্ছিল না কখনোই। অবশেষে ইউরি নিজে নিজেই তার সমস্যা চিহ্নিত করে সেটার সমাধান করেন, আর কিছুই না, বিমানের সিটের উপরে একটা বালিশ দিয়ে তার উপরে বসতেন সবসময় যাতে দেখতে কোন সমস্যা না হয়! তারপর থেকে বালিস ছাড়া ইউরি কোন বিমান চালান নি! তার সম্পর্কে প্রশিক্ষকদের মন্তব্য ছিল- ইউরি হয়ত জিনিয়াস না কিন্তু জয়ী হবার মানসিক তাগিদ ছিল ভিতরে সবসময়ই, যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য রোমাঞ্চপ্রিয় মন আর ঝুঁকি নেবার তাগিদ ছিল।
ওরেনবুর্গেই দেখা হয় তার ভ্যালেন্তিনা গরিয়াচেভার সাথে, পরবর্তীতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা।
১৯৫৬ ফেব্রুয়ারিতে ইউরি সার্জেন্টের র্যাঙ্ক পান এবং ১৯৫৭ সালের ২৬ মার্চ প্রথমবারের মত মিগ-১৫ বিমান একাকী চালান। সেই বছরের ৪ অক্টোবর ঘটে যায় ইতিহাস, মহাকাশে প্রবেশ করে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক! ইউরি তখন ব্যস্ত তার পরীক্ষা নিয়ে, এর পরপরই চাকরির সুবাদে বদলি ঘটে সুমেরু বৃত্তের কাছে মারমানস্ক অঞ্চলে। এখানেই ১৯৫৯র ১০ এপ্রিল লেনা নামের এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা হন তিনি।
১৯৫৯ সালের অক্টোবরের সারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত বিমান ঘাটি জুড়ে শুরু হয় এক রহস্যময় দলের আগমন। তারা বিশেষ অজানা কাজের জন্য কিছু পাইলটকে বাছাই করছিলেন। গাগারিন সেই সময়ের কিছু বাছাইকর্মের কথা বলেছিলেন পরে, শুধু চোখের জন্য সাত সাতটা পরীক্ষা পাশ করতে হয়েছিল তাকে, আর বিশেষ ধরনের মানসিক এবং অঙ্ক পরীক্ষায় সবসময় এক কণ্ঠ থাকে ভুল উত্তর দিয়ে যেত, যাকে উপেক্ষা করে মানসিক দৃঢ়তা ও একাগ্রতা দিয়ে তাকে পেতে হত সঠিক উত্তর। নানা প্রশিক্ষণে উৎরে গ্যাগারিন পান নতুন চাকরি, তাকে শুধু বলা হয় অনেক উঁচুতে ওড়ার জন্য কিছু মানুষ বাছাই করা হচ্ছে। যতটা না নতুন চাকরির জন্য, তার চেয়েও বেশি সুমেরু বৃত্তের সেই বিমর্ষ পরিবেশ থেকে সপরিবারে রেহাই পাবার জন্য মহানন্দে নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য আশ্বান্বিত হয়ে উঠেন।
আশা পূরণ হলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ঢুঁড়ে হাজির করা সম্ভাব্য ২২০০ প্রার্থীর মধ্য চূড়ান্ত বাছাই করে নেওয়া হয় ২০ জন কসমোনাটকে, তাদের একজন হিসেবে স্থান পান ২৬ বছর বয়স্ক ইউরি। এখানে তার সাথে পরিচয় হয় বাকিদের, এদের মধ্যে পরবর্তীতে মহাকাশযাত্রায় বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠা জন গেরম্যান তিতভ এবং অ্যালেক্সেই লিওনভও ছিলেন।
ট্রেনিংয়ের অন্যতম কঠিন বিষয় ছিল আবদ্ধ কক্ষে একা থাকা, যাকে বলে আইসোলেসন ট্রেনিং, অনেক সময় দশ দিনের জন্যও। জানা যায় ইউরি তার চেম্বারের সবচেয়ে ক্ষুদে জিনিসটি নিয়েও গান গাইতেন, নানা কিছুতে অণুড্রেরলা পাওয়ার চেষ্টা করতেন, অনেকটা মরুভূমির যাযাবরের মত, যে চারপাশে যা থাকে সেটা নিয়েই গান বানায়!
তিতভ (পরবর্তীতে ইতিহাসের কনিষ্ঠতম নভোচারী, মাত্র ২৫ বছর বয়সে মহাশূন্যে গমন করা সোভিয়েত কসমোনাট, তার পুরো নাম গারম্যান স্টেপানোভিচ তিতভ, যিনি কিনা প্রথম মানুষ হিসেবে মহাশূন্যে ২৪ ঘণ্টার বেশি থেকে ১৭ বার পৃথিবীকে প্রদিক্ষণ করেছিলেন, ঘুমিয়েছিলেন, স্পেস সিকনেসে আক্রান্তও হয়েছিলেন এবং প্রথমবারের মত মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর ছবি তুলেছিলেন)। তার সম্পর্কে মজার তথ্য ছিল, তার শিক্ষক সাহিত্যপ্রেমী বাবা তিতভের নামের প্রথম অংশ নিয়েছিলেন পুশকিনের বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ইশকাপনের বিবি থেকে। আর তিতভকে তার ট্রেনিংমেটরা খুব অদ্ভুত মনে করত কারণ সুযোগ পেলেই উনি জোরে জোরে বা আনমনে নানা কবিতা বা সাহিত্যের উক্তি আওড়াতেন, শুধু সমসাময়িক সাহিত্য নয়, ক্ল্যাসিকাল বইগুলো থেকেও!
আবদ্ধ কক্ষের ট্রেনিংয়ে তিতভ শুধু পুশকিন আবৃত্তি করতেন। আর একবার মিথ্যা বলে লুকিয়ে একটা বই নিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও নিয়মে আছে যে বই নেওয়া যাবে না, কিন্তু তিতভ বলেছিলেন এই বই আমার মুখস্থ, সাথে থাকুক বা না থাকুক, আমি কিন্তু বিড়বিড় করবই প্রতিটি লাইন, তার চেয়ে সাথেই থাক! কিন্তু ডাহা মিথ্যা কথা ছিল সেটি, এটা আসলে একটা নতুন বই ছিল: লাভ হলো তিনি এই ফাঁকে একটা নতুন বই মজা করে পড়ে নিলেন।
সোভিয়েত মহাকাশযুগের পুরোধা ছিলেন যিনি তিনি এক রহস্যে মোড়া ব্যক্তিত্ব, তার নাম জনসমক্ষে নেওয়া প্রায় নিষিদ্ধই ছিল, কোন খবরে তার উপস্থিতি ছিল না, কিন্তু তিনিই ছিলেন মহাকাশ কর্মযজ্ঞের সর্বেসর্বা। তাকে আড়ালে বলা হত দ্য কিং, বস অফ দ্য বসেস, চিফ ডিজাইনার অথবা তার নামের আদ্যাক্ষর এস পি নামে। সের্গেই পাবলোভিচ করোলভ, দ্য ট্রু ম্যান বিহাইন্ড দ্য স্টোরি।
তবে স্ট্যালিনের সময়ে কোন রকম প্রমাণ ছাড়া খামোখা মিথ্যে অভিযোগে করোলভকে ১০ বছরের নির্বাসন দেওয়া হয় (স্ট্যালিন বুদ্ধিমান সৈন্যদের পছন্দ করতেন না বিদ্রোহের ভয়সহ নানা কারণে, করোলেভের উপরয়ালা মার্শাল তুখাচেভস্কিকে এমন সন্দেহের বসে হত্যা করা হয় এবং তাদের অধীনে কর্মরত সবারই শাস্তি হয়)। সাইবেরিয়াতে যার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। পরে কিছু লোকের চেষ্টায় করোলভসহ অনেক নামী বিজ্ঞানী মুক্তি পান যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যদিও মহাশক্তিধর ব্যক্তিটি কোনদিন জনসম্মুখে তার প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের এই হঠকারী অন্যায় নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
নির্বাচিত কসমোনাটদের করোলভ আদর করে লিটল ঈগল বলে ডাকতেন, প্রথম থেকেই গ্যাগারিন এবং লিওনেভকে তার বিশেষ পছন্দ হয়, তবে তিতভের সাথে সখ্য খুব একটা জমে উঠেনি কারণে হিসেবে বলা যেতে পারে এক, বনে যেমন দুই বাঘ থাকে না তেমন দুই প্রবল ব্যক্তিত্বশালী পুরুষ একজন আরেকজনের অধীনে কাজ করতে পারে না। করোলভ তার লিটল ঈগলদের একদিন মহাকাশযানটিও দেখান, অবশ্য সেই কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্র কী কাজে লাগবে তা বুঝতে কেউই সক্ষম হননি।
করোলভের বাছাই প্রক্রিয়ার নানা ঘটনা ঘটাতেন, তিনি যেমন যখন তখন সবার সামনে উদ্ভট অভিযোগ করতেন বজ্রকণ্ঠে, যেমন- ইউরি, তুমি কেন দাঁত বাহির করে হাসছ? অথচ আদপে ইউরি হাসছিলই না, এখন কিভাবে শান্ত ভঙ্গীতে সে বিগ বসের এই অভিযোগের জবাব দেবে এইটা যাচাই করাই ছিল করোলভের মূল উদ্দেশ্য। তিনি সবসময়ই স্বাধীনচেতা, নির্ভীক, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ পছন্দ করতেন, বিশেষ করে যারা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। অবশেষে সেই বিশেষ দিনটি আসে যা পরবর্তীতে প্রথম মহাশূন্যে হাঁটার রেকর্ডের অধিকারী অ্যালেক্সেই লিওনভের সাক্ষ্যে আমরা জানতে পারি যে নভোযান ভস্টকের সামনে যেয়ে তার ভিতরে প্রবেশ করার জন্য তিনি কসমোনাটদের জুতা খুলে ভিতরে যাবার আহ্বান জানান। সবার আগে ইউরি গ্যাগারিন ইয়েস স্যার বলে জুতা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েন, অন্যরা খানিকটা হতচকিত অবস্থায় ছিল, যেখানে রকেটের মধ্যে জুতা পরেই ঢুকতে হবে সেখানে এখন জুতা খোলার দরকার কী এইটাই হয়ত তাদের মনে কাজ করছিল। কিন্তু ইউরির দেখাদেখি বাকি সবাই জুতা খুলে তার অনুগামী হল।
লিওনেভের মতে সেই মুহূর্ত থেকেই ইউরি গ্যাগারিন অলিখিত ভাবে প্রথম মানব হিসেবে মহাশূন্যে যাবার জন্য করোলভের গুড বুকে উঠে যান। গ্যাগারিনকে জুতোর খোলার ব্যাপারে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয়নি কারণ রাশান গ্রামাঞ্চলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশের আগে জুতা খোলাই রীতি!
প্রস্ততি চলতে থাকে। এর খবর বেরিয়ে যায়, ব্রিটিশ কম্যুনিস্ট বিরোধী খবরের কাগজে একাধিক খবর আসে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাশূন্যে মানুষ পাঠিয়েছে, কিন্তু অবতরণের সময় যান্ত্রিক দুর্ঘটনায় তারা সবাই মারা গেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভোস্টকের আটো সিটে আটার জন্য কিছুটা খর্বাকৃতির নভোচারী দরকার ছিল, সেই হিসেবে লিওনেভ রেস থেকে ছিটকে পড়েন। উচ্চতায় ৫ ফিট দেড় ইঞ্চি ইউরি টিকে যান, এবং তিতভও। এই নিয়ে পরে সাক্ষাৎকারে তিতভ বলেছেন অবশ্যই আমিই নির্বাচিত হতে চেয়েছিলাম, কেবলমাত্র প্রথম মানুষ হবার লোভে নয়, সেই সাথে আমি দেখতে চেয়েছিলেম কী আছে ঐ অসীমে।
১৯৬১, ৭ মার্চ ইউরির ২য় কন্যা গালিয়ার জন্ম হয়, তার তিন সপ্তাহ পরেই ইউরিকে জরুরী কাজে বিকানুর রওনা দিতে হয়। সেখানে কসমনাটদের শেখানো হয় স্পেস স্যুট পরা এবং খোলা। বিশেষ ইন্টারভিউয়ের জন্য হাজির হন আরেক মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তি, সোভিয়েত মহাকাশ যাত্রার কসমোনাট প্রসিক্ষণের প্রধান জেনারেল নিকোলাই পেত্রোভিচ কামানিন। তার একটা প্রশ্ন ছিল, যদি সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায় তখন একজন পাইলটের কি তার আসন শূন্যে উৎক্ষিপ্ত করা উচিৎ? এর উত্তরে তিতভ বলেছিলেন- খামোখা এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করে সময় নষ্ট করার মানে হয় না, কন্ট্রোল রুম কোন না কোনভাবে সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে কয়েক মুহূর্তের মাঝে সে তো জানা কথা। আর ইউরি বলেছিলেন- যদি সকল ব্যবস্থা ভেঙ্গেই পড়ে তাহলে আসন ইঞ্জেক্ট আমাকে একটা বাড়তি সুযোগ দিবে।
করোলভ এবং কামানিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন এই দুইজনের উপরে, এবং কামানিনের মতে তিতভ ছিলেন অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী চরিত্রের, ফলে তাকে রাখা হয় ২য় মহাকাশ অভিযানের জন্য যা কিনা ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে আর ইউরিকে নির্বাচিত করা হয় প্রথম মানুষ হিসেবে দুই ঘণ্টারও কম সময়ের প্রথম যাত্রার জন্য।
অবশেষে বিশেষ মিটিং ডেকে জানানো হয় ইউরি গ্যাগারিন হতে যাচ্ছেন প্রথম অভিযানের কমান্ডার এবং তিতভ তার ব্যাকআপ। এই ঘটনায় তিতভের হতাশা পরিষ্কার প্রকাশ পায়, তিনি অকপটে বলেওছেন যে তাকে নির্বাচন করা হবেই এমনটাই ভেবে নিয়েছিলেন সবসময়ই।
অবশ্য নির্বাচনের শেষ চাবিকাঠি নাড়া হয়েছিল আরও অনেক উপর থেকে, সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধার নিকিতা ক্রুশ্চেভ আর ইউরি গাগারিনের মিল ছিল অনেক দিক থেকেই, দুইজনই এসেছেন কৃষক পরিবার থেকে। দুইজনই সদাহাস্যমুখি, কোলাহলমুখর। বিশেষ করে যে সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার কথা ছিল সোভিয়েতদের তাদের একজন কৃষকের ছেলে যে কিনা নিজেও বাবার সাথে কাজ করেছে, তরুণ কালে ফেরীতে মজুর হিসেবে শ্রম দিয়েছেন, সেই লোকই যদি মহাকাশে যায় তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্রে আমরা সবাই-ই সমান এর চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ আর কী হতে পারে?
চূড়ান্ত যাত্রা বর্ণনা করেছেন গাগারিন, তার লেখা পাতলা বই দ্য রোড টু দ্য স্টারস ( বাংলা হয়েছিলে সম্ভবত পৃথিবী পেরিয়ে নামে) বইয়ে।
শুরু হল ১০৮ মিনিটের সেই অবিস্মরণীয় মহাযাত্রার, তার আগে অবশ্য নাসার মত ৪-৩-২-১-০ স্টাইলে কাউন্টডাউন করা হত না রাশিয়ায়, বরং পূর্ব নির্ধারিত সময়ে ১২ এপ্রিল, ১৯৬১, মস্কো সময় সকালে ৯ টা ৬-এ রকেটের উড্ডয়ন শুরু।
ইউরির কথাতেই বলা হয়েছে ঘণ্টায় ২৮,০০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলা মহাকাশযান থেকে রিপোর্টে তিনি জানান সব ঠিক আছে, জানালা দিয়ে মেঘ দেখা যাচ্ছে, সব কিছুই দেখা যাচ্ছে এবং সবকিছুই খুবই মনোমুগ্ধকর। ইউরি ভাবছিলেন পৃথিবীর মানুষ এই যাত্রার কথা জানতে পারলে কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। শিশুকালে যে মা তাকে ঘাড়ে চুমু খেয়ে প্রতিদিন ঘুম পাড়াতেন, মা কি জানেন তিনি মহাকাশে? কারণ মাকে যাত্রার আগে কেবল বলে এসেছিলেন ব্যবসাজনিত কাজে দূরে যেতে হবে। উৎকণ্ঠিত মা প্রশ্ন করেছিলেন, কতদূরে ইউরা? অনেকদূরে মা!
সেইদিনই পরে রেডিওতে তার নাম এবং যাত্রার কাহিনী শুনে সারা পরিবার উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিল, এবং দুই শিশুকন্যা রেখে এমন অর্বাচীন যাত্রায় যাবার জন্য কিছুটা ভর্ৎসনাও করা হল। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে কেউ কিছু জানত না। তার বাবা অ্যালেক্সেই গাগারিন নিজের কাজে বেশ ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন পথে একজন তার ছেলে ইউরি সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করাই তিনি কারণ জানতে চাইলে সেই লোক বলল- তুমি জান না ! রেডিওতে বলল মেজর গাগারিন নামে একজন মহাশূন্যে গেছে!
সাধাসিধে বাবা বললেন- আপনার ভুল হচ্ছে, আমার ছেলে স্রেফ একজন সিনিয়র লেফটেন্যান্ট। তবে সাধুবাদ দিই তাকে যে সত্যি মহাশূন্যে গেছে। তারপরও নিছক কৌতূহল বশে স্থানীয় পার্টি অফিসে যেয়ে দেখেন সেখানকার কর্মকর্তাকে ফোন করে বলা হচ্ছে গ্রামের নথি দেখে নিশ্চিত হবার জন্য যে ইউরি গাগারিনের জন্ম এই গ্রামেই। সেই কর্মকর্তা আবার উল্লসিত কণ্ঠে বলছিল- নথি দেখার কোন দরকার নেই, সেই ছেলের বাবা স্বয়ং আমার সামনে! বলেই বাবা গাগারিনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়েছিল ঊর্ধ্বতন কারো সাথে কথা বলার জন্য।
মহাশূন্য থেকে ১০৮ মিনিট পরে অবতরণ করলেন প্রথম নভোচারী ইউরি, ছোট গ্রাম স্মেলকোভকাতে, ট্রাক ড্রাইভার ইয়াকভ লুসেঙ্কো তাকে দেখলেন প্যারাস্যুটে করে ঝাঁপিয়ে পরতে, সেদিকে তিনি এগোলেন গ্রামবাসীদের সাথে নিয়ে, এবং গাগারিন হাসিমুখে তাদের বললেন- আমি ইউরি অ্যালিক্সিয়েভিচ গাগারিন, মহাকাশের প্রথম মানুষ। এখনই অনেক মানুষ, গাড়ি, ক্যামেরা আসবে এইখানে, তোমার কোথাও যেও না, এই স্মৃতি আমরা বাঁধিয়ে রাখব।
এছাড়াও সেই গ্রামের এক মহিলা এবং তার শিশুকন্যা ইউরিকে আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। ইউরি চিৎকার করে বলেছিল, আমি তোমাদের বন্ধু কমরেড, একজন বন্ধু! মহিলা কোনমতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তুমি কী পৃথিবীর বিইরে থেকে আসছ? এক গাল হেসে ইউরি বলেছিল- ঠিক তাই!
তার আগের বছর গ্যারি পাওয়ার্স নামের এক মার্কিন গুপ্তচরকে রাশিয়ান বাহিনী গুলি করেছিল যার ঘটনা সারা সোভিয়েত ইউনিয়ন জানত, কাজেই সেই গ্রামের অনেকেই প্রথমে ভেবে নিয়েছিল ইউরি আরেক মার্কিন গুপ্তচর। যদিও তার হেলমেটে লেখা সিসিসিপি (CCCP) তাদের সন্দেহ দূর করেছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সারা গ্রাম সামরিক বাহিনীর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলে, আগত মেজর গাসিয়েভকে স্যালুট করে ইউরি বলল- কমরেড মেজর, সোভিয়েত কসমোন্যান্ট সিনিয়র লেফটেন্যান্ট গাগারিন রিপোর্টিং। গাসিয়েভ হেসে বলেছিল- আপনিও এখন মেজর! উড়ন্ত অবস্থাতেই প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে আপনাকে!
সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্ণধার নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে তার ফোনালাপ ছিল নিম্নরূপ:
ক্রুশ্চেভ: তোমার কণ্ঠ শুনতে পেরে খুবই ভাল লাগছে গাগারিন অ্যালেক্সিয়েভিচ।
গ্যাগ্যারিন: নিকিতা সের্গেইভিচ, আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে মহাকাশে প্রথম মানব মিশন সফল হয়েছে।
ক্রুশ্চেভ: বল দেখি ফ্লাইটের সময় কেমন লাগল? মহাশূন্য কেমন? কী কী দেখলে?
গ্যাগ্যারিন: এমনিতে ভালই ছিলাম। অনেক বেশি উঁচু থেকে বিশ্ব দেখলাম। সাগর, পর্বত, বড় শহর, নদী, বন সব দেখা যাচ্ছিল।
নানা রাষ্ট্রীয় কথার মাঝে ক্রুশ্চেভ বারবার তার কৌতূহল প্রকাশ করছিলেন, এবং আনন্দে আতিশয্যে পুঁজিবাদী দেশগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন ওরা পারলে আমাদের টপকে দেখাক। গাগারিন তাকে এমন সুযোগ দেবার জন্য অসংখ্যা ধন্যবাদ দিয়ে জানালেন যে ভবিষ্যতে দেশের জন্য এমন আরও মিশনে তিনি প্রস্তত।
কী সেই মিশন? সম্ভবত চাঁদ। উড্ডয়নের আগে দ্য বস করোলভ চন্দ্রযানের একটি ক্ষুদে মডেল তার হাতে দিয়ে বলেছিল ভবিষ্যতে আসল মডেলই ব্যবহার করতে হতে পারে! ইউরি যে চাঁদ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা জানা যায় একাধিক সূত্রে। তিতভ এত মানুষের ভিড় ঠেলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া ইউরির কাছে কোনমতে যেয়ে কেবল প্রশ্ন করেছিলেন ভরশূন্য অবস্থায় কেমন লাগে? উত্তর ছিল স্বাভাবিক, বিশেষ কিছু নয়।
পরবর্তীতে ডাক্তারি পরীক্ষার পরে ইউরিকে মস্কোর জাঁকালো রাষ্ট্রীয় সভায় হাজির করা হয়, ধোপদুরস্ত নতুন পোশাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তাকে, এবং চরম অস্বস্তির সাথে ইউরি পরে খেয়াল করেন তার জুতোর ফিতা খোলা! যে কোন মুহূর্তে ফিতায় চাপ লেগে উল্টে পড়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি ঘটে পারে সারা জাতির কর্ণধারদের সামনে! পরে ইউরি তার ভাইয়ের কাছে বলেছিলেন স্পেস ফ্লাইটের চেয়েও সেই খোলা জুতোর ফিতে তাকে অনেক বেশি নার্ভাস করে রেখেছিল!
মায়ের সাথে দেখা করে ক্রন্দনরত মাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে ইউরি বলেছিল, আমি আর এমন কাজ করব না মা, প্লিজ কান্না থামাও।
তবে এই জাঁকালো অনুষ্ঠানের মাঝে গুরু করোলভের জন্য অন্য অনুভূতি তৈরি হয় ইউরির মনে, করোলভ ছিলেন রাষ্ট্রীয় সিক্রেট, তার কোন মেডাল পরার অনুমতি ছিল না, প্যারেডে থাকার অনুমতি ছিল না, মিডিয়াতে কথা বলা দূরে থাক।
নোবেল প্রাইজ কমিটি পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ এবং প্রথম মানবকে মহাশূন্যে পাঠানোর পিছনের মূল মানুষটিকে পুরস্কার দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে সোভিয়েত কতৃপক্ষকে চিঠি দিলেও তারা সেটার কোন উত্তর দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি।