স্বৈরাচার, শোভাযাত্রা ও মুখোশ
তেত্রিশ বছর পেরোচ্ছে এবার ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা। যশোর শোভাযাত্রার বয়স অবশ্য এর চেয়ে চার বছর বেশি। সেটা ১৯৮৫ সাল। স্বৈরাচারের কবলে দেশ। ঢাকা চারুকলা থেকে পড়াশোনা শেষ করে নিজের শহর যশোরে ফিরলেন মাহবুব জামাল শামীমসহ আরো কয়েকজন। গড়ে তুললেন চারুপীঠ নামের শিল্পচর্চা প্রতিষ্ঠান।
একুশ দিয়েছিল প্রেরণা
শামীমরা ওই বছরই বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে শোভাযাত্রা করার পরিকল্পণা করে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিই চিন্তার দরজা খুলে দেয়। শেষ চৈত্রের রাতেই শামীমরা কাজে লেগে যান। সারারাত ধরে তৈরি করেন পরী, পাখি আর বাঘের মুখ। নতুন বছরের প্রথম দিনে চারুপীঠের ছেলেমেয়েরা পাঞ্জাবী আর শাড়ি পরে শোভাযাত্রা শুরু করে। ঢোলের তালে নেচে নেচে শহর ঘোরে। এটিই আমাদের দেশে বর্ষবরণের প্রথম শোভাযাত্রা। আগে থেকেই যশোরে সুরধনী, উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বেশ শক্তিশালী ছিল। পরের বছর তারাও যোগ দিল শোভাযাত্রায়, প্রায় সাড়ে তিন হাজার মুখোশ তৈরি হয়েছিল সে বছর। তারপর থেকে ফি বছরই হচ্ছিল যশোরে।
এলো ১৯৮৯ সাল। স্বৈরাচারের সঙ্গী তখন স্বাধীনতা বিরোধীরাও। তুঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও। ঢাকায় চলল নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেল একটু। প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠল গান, কবিতা আর শিল্পকর্ম। কিন্তু শাসকের চোখে তখন রক্ত উঠে গেছে। সব কিছুতেই তার ভয়, সন্দেহ। চারুকলার ছাত্ররা প্রেরণা পেল যশোর থেকে। অবশ্য আগের বছর মানে ১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জয়নুল আবেদিনের জন্মবার্ষিকী পালনকালে শোভাযাত্রার একটা মহড়া হয়ে গিয়েছিল। তাতে মুখোশ, রঙপাত্র ও দশাসই কলম নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন শিল্পাচার্যের ছাত্রছাত্রীরা।
বর্ষবরণ প্রস্তুতিতে সোনারগাঁয়ের লোকশিল্প জাদুঘরের কাঠের হাতিটির মতো করে হাতির কাঠামো বানানো হলো যেটি ছিল ১১ ফুট উচু। হাতির গায়ের চামড়া হিসাবে চট লাগানো হলো। সাইদুল হক জুইস বাঘের একটা মুখোশ বানালেন। আরো তৈরি হয়েছিল ১৪টি ঘোড়া, ৮০০ মুকুট আর মুখোশ আরো ৬০টি। ঢাকিরা শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিল ১০টি ঢাক নিয়ে।
মুখোশ নিয়ে কথা
গ্রিসের জাতীয় পুরাতত্ত্ব জাদুঘরে ৩৭০০ বছরের পুরোনো সোনার মুখোশ রক্ষিত আছে। শুরুতে একে রাজা আগামেমননের ডেথ মাস্ক বলে মনে করা হয়েছিল। অনেক গবেষক দাবি করেন ৪০০০ বছর আগেও মুখোশের চল ছিল বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা আর আফ্রিকায়। জাদু ও ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মুখোশের ব্যবহার ছিল ওই সব অঞ্চলে। ভারতবর্ষে শিবের বন্দনায় মুখোশের ব্যবহার ছিল। মহাদেব, কালী, শিব-পার্বতীর মুখোশের ব্যবহার দেখা যায় ভারতবর্ষে। মানুষের পশু প্রীতি থেকে বাঘ, সিংহ, কুমির, বানর, প্রজাপতি, পাখি, সাপ ইত্যাদির মুখোশ তৈরি হয়েছে। মুখোশ তৈরি হয় সাধারণত কাপড়, কাঠ, কাগজ, শোলা, মাটি দিয়ে।
একজন শিল্পী জুইস
রংপুরে সাইদুল হক জুইসের জন্ম ১৯৬০ সালে। স্নাতক হয়েছেন ১৯৮২ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। এমএফএ শেষ করেন ১৯৮৫ সালে। তাকে বলা হয় মুখোশের মাস্টার। ভাজ করা কাগজ তার কাজের মাধ্যম। পেপার ফোল্ডিংয়ে তিনি সিদ্ধহস্ত। গড়েছেন দশাসই সব মুখোশ। ফ্যান্টাসি কিংডম এবং আরব বসন্ত তার বহুল আলোচিত আর্ট সিরিজ। বিদেশেরও কিছু কার্নিভালে তিনি মুখোশ গড়েছেন। তাঁর শিল্পকর্ম পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজ সচেতন। কখনো তিনি প্রতিবাদী, কখনোবা বিদ্রুপাত্মক। বড় বড় শিল্পকর্ম গড়েন যেন বেশি মানুষ আকৃষ্ট হয়। তবে শিল্পকে ব্যয়বহুল করার তিনি ঘোর বিরোধী। ১৯৯২ সালে তার গড়া মুখোশের প্রথম প্রদর্শনী হয়। ঢাকা আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের পুরো উৎসবস্থল তিনি ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর নকশা করেছেন। ডেনমার্কের কোপেনহেগেন কার্নিভালে তিনি মুখোশ ও বাঁশে গড়া শিল্পকর্ম উপস্থাপন করেন। ২০১০ সালে জার্মানীর কোলন কার্নিভালেও তিনি মুখোশ নিয়ে অংশ নেন।
মুখোশ এখন ডেকোরেটররাও বানাতে পারছে: সাইদুল হক জুইস
কিভাবে মুখোশের প্রতি আকৃষ্ট হলেন?
ছোটবেলা থেকেই মেলায় মেলায় ঘুরতাম। মুড়িমুড়কি কিনতাম। সাদা রসের ভিয়েন দেওয়া হাতি, ঘোড়া খাওয়ার চেয়ে দেখতামই বেশি। তারপর চৈত্র জুড়ে দেখতাম কালী নাচ। বিশেষ করে সংক্রান্তিতে কালীর মুখোশ পরে নাচতে দেখতাম অনেককে। এভাবেই কখন যে মনের মধ্যে বাসা বেধে ফেলেছে মুখোশ তা বুঝতেও পারিনি।
অনেক দেশের মুখোশ নিশ্চয়ই দেখেছেন। কাদের মুখোশ সেরা?
সেরা কারোরটাই বলা ঠিক না। সবারই নিজস্বতা রয়েছে। তবে আফ্রিকান মুখোশ মশহুর। ওদের ওখানে জাদুবিশ্বাসের চর্চা হতো অনেক থেকেই, এখনো হয়। তাই পূজার উপকরণ হিসাবেই মুখোশ লাগে। ভুটান আর শ্রীলংকার কাঠের মুখোশও আকর্ষণীয়। মুখোশের বাহার দেখা যায় চীন আর জাপানেও। সেখানে লোক আচারের অংশ মুখোশ। শিল্পী পিকাসো অফ্রিকার মুখোশের ভক্ত ছিলেন। ওইসব মুখোশ তার কাজে পরিবর্তন এনেছে। পিকাসোর মশহুর ছবি এভিগননেও মুখোশের ব্যবহার দেখবেন। আমাদের কামরুল হাসানও মুখোশ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
শোভাযাত্রায় মুখোশের ব্যবহার হয় প্রচুর, কারণ কি?
মধ্যযুগে লিঙ্গ, শ্রেণী, বর্ণ, গোত্র আড়াল করতেই মুখোশের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কার্নিভাল বা শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা বৈষম্যের স্বীকার হতো না মুখোশের কারণেই। মানে এতে সবাই মিলে আনন্দ করার সুযোগ মিলত। ১৩ শতকে ভেনিস কার্নিভাল দিয়ে এর শুরু। নারীরা কার্নিভালগুলোয় মুখ ও মাথা না ঢেকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেত না। তাই তারা মুখে রঙ মেখে, পরচুলা পরে মানে নানান কায়দা করে শোভাযাত্রায় অংশ নিত।
আমাদের বৈশাখী মুখোশের বৈশিষ্ট্য কি?
শুরুটা যখন হয়েছিল তখন ছিল স্বৈরাচারের যুগ। স্বাধীনতাবিরোধীরাও সদম্ভে ঘুরে বেড়াত। তখন আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল শেকড় অনুসন্ধানের, ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের। বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস আমাদের বহু পুরোনো। বৈশাখী মেলার বয়স কয়েকশ বছরের। আমরা শোভাযাত্রার জন্য কাপড় খুঁজতে গিয়েছিলাম ইসলামপুরে। সেখানে কাপড়ের দোকানে তাকভর্তি রঙিন কাপড় দেখে কৌতূহলী হয়েছিলাম। দোকানী বলেছিলেন, এগুলো বৈশাখের পোশাকের কাপড়। জেলায় জেলায় নিয়ে যাবে বেপারীরা। শহরের বৈশাখের ইতিহাস বেশিদিনের নয় কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে লোকের মাঝে বৈশাখ অনেক আগে থেকেই আছে।
আপনি বৈশাখী মুখোশ কি কি করেছেন?
প্রথমবার করেছিলাম বাঘের মুখোশ। তারপর লম্বা বড় পাখি, মহররমের ঘোড়া ইত্যাদি। তখন আমাদের টাকাপয়সার খুব টানাটানি ছিল । তাই কম দামি উপকরণ দিয়েই কাজ করতাম। আরেকটি ব্যাপার নজর রাখতাম, যেন মুখোশ বা পুতুলগুলো ওজনে হালকা হয় মানে বয়ে নেওয়া যায় সহজে। পুতুল বা মুখোশগুলো প্রমাণ সাইজের হতো, এর কারণ হলো লোকে যেন ভালো করে দেখতে পায়। পুতুল ঘোড়ার কথা ধরুন, অনেকের বাড়িতেই আছে, আগে অনেকবারই দেখেছেন, কিন্তু এটা যখন ২০ ফুট বড় হয়ে যায় তখন তার চেহারাই বদলে যায় মানে পুতুলটি তখন ডাকতে থাকে, আমাকে দেখো, আমাকে দেখো। তার আহ্বান এড়ানো তখন কঠিন হয়।
পুতুলের গড়নে দেশে দেশে ফারাক কেমন?
মাটি যদি মূল উপকরণ হয় তবে সাদৃশ্য দেখবেনই। আবার পার্থক্যও দেখবেন সেটা ঐতিহ্যের আর অভিজ্ঞতার। আমাদের এখানে নারীর (দেবী দুর্গা, কালীর কথা ভাবুন) প্রতি সম্মান দেখানোর চল বহু পুরোনো। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল আমাদের। তাই আমাদের নারীমূর্তির এক বিশেষ ধরণ আছে যা অন্য দেশে পাবেন না।
আপনারা কি পুতুলগুলো হুবহু কপি করতেন?
অবশ্যই না। শিল্পী কখনোই হুবহু কপি করে না। পুরোনোকে নতুন করাও শিল্পীর কাজ। গোড়ার দিকে আমরা স্কুলগুলোতেও গিয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের বলতাম তোমরা নিজেরা মুখোশ করে নিয়ে এসো, সেগুলো দিয়েই শোভাযাত্রা সাজাব। পরিকল্পনামতো কাজও হয়েছিল কিছু কিন্তু এখন দেখছি চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও কপি করার ঝোঁক বাড়ছে। এটা মোটেও ভালো কিছু নয়।
বৈশাখ, শোভাযাত্রা, মুখোশ ইত্যাদি দিয়ে ফল কি পেলেন?
আনন্দ পেয়েছি, আনন্দ জোগান দিয়েছি। কার্নিভাল মানে তো আনন্দই। এখন দেখবেন ডেকোরেটররাও মুখোশ বানাচ্ছে, বিক্রিও হচ্ছে নিশ্চয়ই, মানে এর বাজারটাও বড় হয়েছে। এটাও একটা প্রাপ্তি। তারপর আমরা ঢোল বাজিয়ে মৌলবাদীদের মর্মে আঘাত করেছি। প্রাপ্তি কম নয়।
আগামীতে কি করবেন ভাবছেন?
কাজ অনেক জমে আছে। আমি শিল্পের মুক্তিতে বিশ্বাসী। আমি চাই শিল্প বেড়িয়ে আসবে গ্যালারি থেকে, বড়লোকের ড্রইংরুম থেকে। শিল্প তার সৌন্দর্য প্রকাশ করবে এভিনিউতে, স্ট্রিটে। আগামীতে মুখোশের ফ্রি ওয়ার্কশপ করানোর কথা ভাবছি। যেন সবাই শিখতে পারে, ছড়িয়ে দিতে পারে শিল্প।