বর্ষবরণ: স্বাগত নতুন বছরকে!
বহু শতাব্দিব্যাপী বাংলা এবং সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই সময়টায় অর্থাৎ বৈশাখের শুরু বা ইংরেজি এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়েই পুরনো সালকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। এলাকাভেদে বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উপলক্ষে বিভিন্ন মেয়াদে আনন্দোৎসবের আয়োজন হয়।
আমাদের বঙ্গাব্দ চালু হওয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিভিন্ন মত চালু আছে। কারো মতে সম্রাট আকবরের নির্দেশনা অনুযায়ী তার সভাসদ টোডরমল ফসল তোলা, রাজস্ব আদায় ও সৌর বাংলা সন এবং চান্দ্র হিজরি সনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এই সাল চালু করেন।
অন্য এক মত অনুযায়ী, বাংলার রাজা শশাঙ্কর রাজ্যাভিষেকের সময় থেকে এই সাল গণনা শুরু হয়। রাজা শশাঙ্কই প্রথম বাংলার নরপতি যার পতাকাতলে বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে। মনে করা হয়, তার সিংহাসনে আরোহনকে স্মরণীয় করে রাখতে তারও প্রায় পাঁচশত বছর আগে সম্রাট বিক্রমাদিত্যের আমলে প্রবর্তিত বিক্রম সম্বত বর্ষপঞ্জির সাথে মিল রেখে ৫৯৩ খৃষ্টাব্দ থেকে শশাঙ্কের উদ্যোগে বঙ্গাব্দ চালু করা হয়।
আরো একটি মত ইতিহাসে পড়েছি। একসময়ের প্রবল প্রতাপান্বিত তিব্বত সম্রাট স্রং সান গাম্পোর স্মৃতি অমর করতে তার পিতা সম্রাট স্রং সান এই বর্ষপঞ্জি প্রচলন করেন। তারা সেই সময়ে পূর্ব ভারতের বিশাল এলাকায় অধিকার কায়েম করেছিলেন।
প্রবর্তনের ইতিহাস যাই হোক না কেন, এটা অনস্বীকার্য যে আবহমান কাল থেকে এই জনপদে আমরা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব পালন করে আসছি।
চৈত্র সংক্রান্তি, গাজনের মেলা, চড়ক, নীল পূজা, হালখাতা, বৈশাখী মেলা, বর্ষ বিদায় ও আবাহন উপলক্ষ্যে সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আনন্দ বা মঙ্গল শোভাযাত্রা, সবই এই আনন্দ উৎসবের অঙ্গ।
আনন্দ আহরণের কোনো নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সমাজে গ্রহণযোগ্য যেকোনো শালীন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কেউ কোনো উপলক্ষ্য উদযাপন করতে চাইলে অন্য কেউ তাতে বাদ সাধা সভ্য সমাজের উপযুক্ত কাজ নয়।
আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির উপর আঘাত বিশেষ করে পাকিস্তানি আমল থেকেই বাধা এসেছে। বীরের জাত বাঙ্গালি সেগুলো বারবারই রুখে দিয়েছে।
আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার জন্য কেবল নববর্ষ উদযাপনের আলাপে ফিরে আসি। বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টার বিরুদ্ধে ছায়ানট সেই ষাটের দশকে প্রবর্তন করে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবের। ইতিহাস সাক্ষী, মৌলবাদীদের ঘৃণ্য বোমা হামলাও তা থামাতে পারেনি। দিন দিন এই ভোরের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান তার ডালপালা ছড়িয়ে আজ সারা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গেছে।
ঠিক তেমনি বর্ষবরণের অণুষঙ্গ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আনন্দ মিছিল, যা বর্তমানে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র রূপ পয়েছে সেটিও বর্ষবরণের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এই কার্যক্রম এখন জাতিসংঘের ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ও পেয়েছে।
এবারে আসি বর্ষবরণ নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে। আমাদের দেশের দক্ষিণ পূর্ব এলাকায় চট্টগ্রামের পার্বত্য তিন জেলায় চোদ্দ পনেরটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করেন। তাদের মধ্যে দু চারটি খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা (তাদের বৃহত্তম উৎসব বড়দিন) ছাড়া সকলের জন্যই বর্ষবিদায় ও নতুন বর্ষবরণ সর্ববৃহৎ উৎসব। প্রায় সকলেই অন্তত তিন দিনব্যপী এই আনন্দোৎসবে সামিল হন।
প্রতি জাতিসত্বার উৎসবের নাম ভিন্ন। চাকমারা পালন করেন বিজু নামে। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষজন পালন করেন বৈসুক। মারমা সম্প্রদায়ের উৎসবের নাম সাংগ্রাই। ম্রো আদিবাসীরা পালন করেন চাক্রান। তঞ্চঙ্গ্যারা বলেন বিষু এবং অসমীয়রা পালন করেন বিহু।
এসকল আনন্দোৎসব পালিত হয় ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় আমেজেই। পূজা পার্বণ, আগেকার বছরের ব্যর্থতা ও অসাফল্য পিছনে ফেলে আসতে নদী বা জলাশয়ে স্নান, পূর্বপুরুষ ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসানো, অতীতের তিক্ততার কথা ভুলে নতুন দিনের সূচনার অঙ্গীকার, রাত জেগে আনন্দ করে নববর্ষের ভোরে দেবতাকে নিবেদনের জন্য পিঠা ও মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা, নতুন পোশাকে সুসজ্জিত হওয়া, উৎকৃষ্ট খাদ্য ও পানীয়র ব্যবস্থা করা, আত্মীয় ও বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করা, ইত্যাদি হচ্ছে পাহাড়ে নববর্ষে পালনের অনুষঙ্গ।
বহু রকমের তরকারি, শাক, লতাপাতা ইত্যাদি দিয়ে প্রতি বাড়িতে তৈরি হয় পাঁজন বা পাঁচন। কার বাড়িতে কত বেশি সংখ্যক তরকারি ব্যবহৃত হলো তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাটি পঞ্চাশও ছাড়িয়ে যায়।
মারমাদের জলকেলি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। কোথাও কোথাও কুস্তি, তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠা, পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা ইত্যাদিও অনুষ্ঠিত হয়। অনাবিল আনন্দের উৎসব পাহাড়ের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ।
প্রতিটি পাহাড়ি জাতিসত্তা তাদের নিজ নিজ ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজস্ব নামেই আনন্দোৎসবে সামিল হন। অন্য জাতিসত্তা ও বাঙ্গালিদেরও আমন্ত্রণ জানান তাদের আনন্দ ভাগ করে নিতে।
গত শতাব্দীর আশির দশকে বৈসাবি নামটি চালু হয়। পাহাড়ের তুলনামূলকভাবে তিন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিসত্তা ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে এই শব্দটি আমরা চালু করেছি। সাধারণ পাহাড়ি জনগণের কাউকে বললে তিনি বৈসাবি কি তা আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারবেন না বলেই মনে করি। যাহোক, নামে কী বা আসে যায়।
সকল বাঙ্গালি বন্ধুদের জানাই ১৪৩০ বাংলা সনের শুভেচ্ছা ও অজস্র শুভকামনা।
আমাদের পাহাড়ের বন্ধুদের জন্য রইল সাংগ্রাই, বৈসুক, বিজু, বিষু, বিহু, চাক্রান উপলক্ষে নববর্ষের শুভকামনা।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, মহামারি ও যুদ্ধাবস্থা কাটিয়ে যেন আমরা সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারি এটাই কামনা।
শুভ নববর্ষ!