লিওনার্দো ভিঞ্চির গ্রামে
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রামের নাম মনে হয় ভিঞ্চি। আসলে শুধু গ্রাম কেন, বরং সবচেয়ে বিখ্যাত জনপদের নামই ভিঞ্চি। বিশ্বের আনাচে কানাচে এমন কোন মানুষ আছে ইতালির তুসকানি অঞ্চলের এই একরত্তি গ্রামের নাম জানেন না! কিন্তু এই গোলাপ সুবাসের মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে সুনামের পিছনে কিন্তু পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত সবুজ বনানী পরিবৃত আর পাখির কুজনে ভরা অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারিণী গ্রামটির চেয়ে ট্রিলিয়ন গুণ বেশী কৃতিত্বের অধিকারী মধ্যযুগে এখানে জন্ম নেওয়া এক ব্যক্তির, যার নাম লিওনার্দো, কিন্তু বিশ্ব তাকে চেনে ভিঞ্চি গ্রামের লিওনার্দো বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নামে।
সেই স্মৃতিকাতরতার ধূসর কুয়াশায় মোড়া রঙ ঝলমলে স্কুল জীবনের টুলবেঞ্চির দিনগুলোতে খসখসে পাঠ্য বইয়ের পাতায় জেনেছিলাম চির সূর্যের দেশের ইতালির সোনালী আলোর প্রতিভূ উজ্জল কমলা বন আর জলপাই কুঞ্জ ঘেরা গ্রামাঞ্চলের কথা, কৈশোরের উন্মাতাল দিনগুলোতে সেই মাতাল করা টাটকা ফলের গন্ধ ভরা দমকা বাতাস সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে সোজা এসে সর্বদাই হানা দিত মনের দরজায়।
ভাবতাম এমন গ্রামে বেড়ে ওঠা শিশু বালকটির কথা, যার নাম ছিল লিওনার্দো। যিনি সমস্ত কিছু লিখতেন উলটো করে যাতে কেবলমাত্র আয়নায় পড়া যায়, যিনি সরীসৃপ, কীটপতঙ্গের বাস্তব মডেল থেকে কল্পনার মিশেল দিয়ে ভয়াবহ এক ড্রাগন ভাস্কর্য গড়ে চমকে দিয়েছিলেন বাবাকে। স্কুলের পাঠ্য বইয়ে এমন নানা সত্য ও কল্পনার মিশেল দেয়া কাহিনী ছিল লিওনার্দোকে নিয়ে, আর তার মূল পরিচয় দেয়া ছিল বিশ্বসেরা একজন চিত্রকর হিসেবে, যার সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি মোনালিসা নামের এক চিত্রকর্ম যেখানে এক নারী রহস্যময় মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে সারা বিশ্বের দিকে।
বছর গড়ানোর সাথে সাথে অভিভূত হতে থাকলাম লিওনার্দোর একের পর এক পরিচয় পেয়ে, কি ছিলেন বলার চেয়ে বলা চলে কি ছিলেন না তিনি! বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, চিত্রকর, ভাস্কর, সঙ্গীতজ্ঞ, স্থপতি, গণিতবিদ, যন্ত্র প্রকৌশলী, উদ্ভিদবিদ, প্রাণীবিদ, ভূতাত্ত্বিক, মানবদেহের শল্যবিদ, ম্যাপ আঁকিয়ে, লেখক, নদীর গতি শাসন প্রকৌশলী, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক।
সেই সাথে আরও অনেক জানা-অজানা বিষয়ের পথিকৃৎ পণ্ডিত। মাতৃগর্ভে শিশুর অবস্থানকালীন অবস্থা থেকে শুরু করে জলের নিচে ডুবুরীর শ্বাসযন্ত্র, উড্ডয়নে সক্ষম যন্ত্র এগুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন তিনি । তার আঁকা নকশাঁয় পাওয়া গেছে পৃথিবীর প্রথম হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ইত্যাদির ধারণা! এই অতিমানবিক জীবন নিয়ে বিবিসির তিন খণ্ডের তথ্যচিত্রের শেষে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ভিঞ্চি গ্রামের লিওনার্দোই আমাদের জানামতে বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক।
তাই মনের মধ্যে সর্বদাই আঁকুপাঁকু করত এই মানুষটির জন্মস্থান, তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত স্থান দেখতে, তার সৃষ্টি দেখতে। যখনই সুযোগ মিলেছে, দেখে ধন্য হয়েছি তার অমর চিত্রকর্ম, যন্ত্রের নকশা। ইতালিতে যখনই যাওয়া হয়েছে, মনে পড়েছে ভিঞ্চি নামের পাহাড়চূঁড়োয় অবস্থিত গ্রামটি এই দেশেই! একটু ঘুরপথে গেলেই সেখানে যাবার অপার আনন্দ লাভ করা সম্ভব। একে একে মিলান, রোম, ভেনিস, ভ্যাটিকান এমনকি ফ্লোরেন্স দেখা হয়ে যায় কাল পরিক্রমায় কিন্তু ভিঞ্চি থেকেই যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে! তাই পণ করেই ইতালি গমন হল গত সপ্তাহে, লিওনার্দোর জন্মস্থানটি দেখতেই হবে এ যাত্রা!
শিল্প এবং শিল্পীর নগরী ফ্লোরেন্স থেকে ভিঞ্চি গ্রাম মাত্র ৪২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হলেও সেই রাস্তা তুসকানির আর দশটা গ্রাম্য রাস্তার মতই ঘোরালো প্যাঁচালো, সেই সর্পিল রাস্তার বাঁক-উপবাঁক-তস্যবাঁক পেরিয়ে যেতেই বেলা গড়িয়ে যাবে অনেকখানি।
কোন এক ডিসেম্বরের শীতে ভোর থেকেই তুসকানির আকাশ ম্লান হয়ে আছে ধূসররঙা মেঘে, থেকে থেকেই সেই কপোলের জল ঝরে পড়ছে মর্ত্যবাসীদের উপর, সেই অবস্থাতেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগোনো হল রেন্ট এ কার থেকে ভাড়ার গাড়ি নিয়ে। পথে নেমেই পড়া গেল মহা মুশকিলে, ভুলেই গেছি গাড়ী চালাচ্ছি ইতালিতে, অন্য কোন দেশে নয়, এখানকার স্থানীয়রা ভুলেও রাস্তা বা লেন বদলের সময় কোন রকম সিগন্যাল ব্যবহার করে না! ইচ্ছা হল তো গেল আরেক দিকে এমন আর কি, রাস্তায় যে অন্য লোক আছে, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমন কোন দুর্ভাবনায় ভ্রূক্ষেপই নেই! এদের সাথেই পাল্লা দিয়ে যেতে হবে স্বপ্নগ্রামে। যাদের আন্ডার দ্য তুসকান সান চলচ্চিত্রটি দেখা আছে তারা খুব ভাল করেই জানেন কি ভয়াবহ সুন্দর আর বিপদজনক সেই সরু পাহাড়ি রাস্তাগুলি আর সেখানে দ্রুত বেগে গাড়ী চালানো!
এক ক্ষুদে গ্রামে কফি বিরতিতে নামতেই দেখা গেল ভিঞ্চির নামের মাহাত্ম্য, গোটা এলাকা বা কমিউনের নামই ভিঞ্চি, আর কফির কাপে খোদাই করা তার সুযোগ্য সন্তানের মুখ!
টুসকানির পথে প্রান্তরে এখন শরতের রঙবদলের ঝলমলে ছোঁয়া। পথের শোভার দিকে দৃষ্টিপাত না করে স্টিয়ারিং এক মনে ঘুরানো মহা মুশকিল, এর ফাঁকেই ঘণ্টাখানেক পরে চোখে আসল সবচেয়ে বিখ্যাত জনপদটির চিহ্ন। ইস, কত দিন স্বপ্ন দেখেছি ভিঞ্চি গ্রামে আসব বলে, ঘুরে বেড়াব লিওনার্দোর স্মৃতিচিহ্ন মাখা সবুজ পথে, আজ স্বপ্ন বাস্তব, আজ বড় খুশির দিন।
আকাশ তার অনেক দিনের জমানো বেদনা যেন মাটিকে দিয়ে হালকা হচ্ছে ঝরঝর মুখর জলধারার মাধ্যমে, এমন সময় পৌঁছালাম লিওনার্দো জাদুঘরের সামনে, চারিদিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই বরুণ দেবের গুনাগুনতিহীন সূক্ষ্ম বর্শার আক্রমণের মুখে, পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে, পা না হড়কে এক দমে তেতলায় জাদুঘরের মূল ফটকে সেধিয়ে তবেই খানিকটে স্বস্তি।
যদিও সেই স্বস্তি খানিক পরেই মহা বিরক্তিতে পরিণত হল, জাদুঘরে শিল্পীর কোন চিত্রকর্ম থাকবে এমন বোকাটে আশা করি নি, ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি মানব বিশ্বের সবচেয়ে দুর্মূল্য রোজনামচার (নোট বুক) খানদুয়েক আসল পাতা বা ড্রয়িং এখানে উপস্থিত থাকতে পারে, কিন্তু এও ভাবিনি সেখানে থাকবে কেবল তার নকশাকৃত যন্ত্রের কিছু ক্ষুদে মডেল আর অল্প কিছু ভিডিওচিত্র, আবার বড় বড় করে লেখা ছবি তোলা নিষেধ!
তবে সেখানকার তত্ত্বাবধায়কের কাছে জানা গেল লিওনার্দো জাদুঘরের দুটি অংশ, অন্যটি অদূরেই এক সুউচ্চ টাওয়ারের মাথায়, সেখানের সংগ্রহ অনেক বেশী সমৃদ্ধ। ততক্ষণে টুসকানির বিখ্যাত সূর্য তার আবছা অস্তিত্ব জানান দিয়েছে মেঘদলের পিছন থেকে, টাওয়ারে যাবার পথে এক ছড়ানো পাথুরে চাতালে তাই বেশ উপভোগ করা গেল ভিঞ্চির নিসর্গ,সারি সারি উপত্যকা, প্রতি পাহাড়ের মাথায় জনবসতি, কিছু কিছু স্থাপনা এতই অপার্থিব নির্জনতায় মোড়া, কল্পলোকের প্রেক্ষাপট বলে ভ্রম হয়। টাওয়ারের মাথা থেকেও মিলল মনমাতানো স্নিগ্ধ কিছু দৃশ্যকে মনের পর্দায় বন্দী করার সুবর্ণ সুযোগ, সেই সাথে ক্যামেরার ফ্রেমেও।
জাদুঘরের এই অংশ আসলেই অনেক গোছানো, লিওনার্দোর বিখ্যাত এক ধাতব আবক্ষ ভাস্কর্য, যার ছবি দেখে এসেছি নানা বইতে, তার নোটবুকের পাতার অনুলিপি, সেই সাথে সেখানে উল্লেখিত যন্ত্রের প্রতিলিপি। সবচেয়ে ভাল লাগল তার নকশাকৃত উড্ডয়ন যন্ত্রের মডেল দেখে, যেখানে একজন মানুষ হাতে ডানা বেঁধে, পা দিয়ে অবিরাম প্রপেলার জাতীয় কিছু ঘুরিয়ে উড়তে পারলেও পারে! ওড়া নিয়ে সারা জীবন অবিরাম গবেষণা ও নেশায় মেতে ছিলেন বিজ্ঞানী, এমনটাও জানা যায়, তার জীবনের প্রথম স্মৃতিটুকুই ছিল, দোলনায় শুয়ে শিশু লিওনার্দো, আর একটি বাজ বা চিল জাতীয় পাখি দোলনার ওপর ক্রমাগত পাখা ঝাপটে উড়ছে, এক পর্যায়ে শিশু মুখে পাখির লেজের লম্বা পালকের ছোঁয়া লাগে ( যদিও ফ্রয়েডীয় মতে একে তার মাতৃদুগ্ধ পানের প্রথম সুখস্মৃতি বা মায়ের প্রতি তীব্র আকাঙ্খার কথা বলা হয়েছে)। পরিণত বয়সেও প্রায়ই বাজার থেকে বন্দী কবুতর কিনে ছেড়ে দিতেন উদার উন্মুক্ত আকাশে, অবলোকনে মেতে থাকতেন তাদের উড়াল, নোটবুকের পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলতেন পাখির উড়ন্ত অবস্থায় গতিবিদ্যা নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, লিওনার্দো আবিষ্কৃত যন্ত্রে কি উড়তে সক্ষম হয়ে ছিল কেউ? উত্তর এখনো জানা নেই, কিন্তু চলছে ব্যাপক গবেষণা, আর তার ফলে বেরিয়ে আসছে সুদূর অতীতের ধুম্রজাল ছিঁড়ে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য, এও জানা যাচ্ছে এক ভোজসভায় লিওনার্দো হাজির করেছিলেন তার নতুন আবিষ্কার এক যন্ত্রমানব, যে নিজে থেকেই কিছু নড়াচড়া করতে সক্ষম ছিল, তার মানে কি আমরা বিশ্বের প্রথম রোবটের কথা বলছি?
সেই সাথে দারুণ লাগল তার আবিষ্কৃত পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম ডুবুরীর শ্বাসযন্ত্রের মডেল দেখে, ভেনিসে অবস্থানরত সময়ে একজন সমরযন্ত্রবিদ হিসেবে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনি। নাসার বিশালকায় স্পেস স্টেশনগুলোতে একাধিক বার ব্যবহার করা হয়েছে তার ধারণা ও নকশা, ভেবে থই পাচ্ছি না কেবল যদি সেই সময়ে জ্বালানী তেলের ব্যবহার থাকত, তাহলে উনি কী কী আবিস্কার করতেন!!!
বৃষ্টির অত্যাচার খানিকটে কমে আসায় ভিঞ্চির পথেঘাটে ঘুরঘুর করলাম খানিকক্ষণ, নগর কেন্দ্রে দেখা মিলল এক দারুণ তেজোদীপ্ত পেশল ঘোড়ার ভাস্কর্যের সাথে, ধারণা করা হয় মিলানে অবস্থানের সময় বিশাল একটি ধাতব ঘোড়ার ভাস্কর্য করার নকশা করেছিলেন সেই ভাস্কর, কিছু যুদ্ধের ডামাডোলে সেই স্বপ্ন আর বাস্তব হয় নি, কিন্তু গড়ে ছিলেন কাদার তৈরি প্রতিরূপ। এটি তারই এক ক্ষুদে প্রতিলিপি।
জানা গেল এখানের কোন বাড়িটি মালিক ছিল তার জমিদার পিতার বনেদি পুত্র (তার সৎ ভাই, লিওনার্দো মা ছিলেন কিষাণকন্যা, জমিদারের সাথে প্রণয়ের ফলে কোন সামাজিক সম্পর্ক ছাড়াই ভূমিষ্ঠ হন তিনি), কোন এলাকা তার পারিবারিক সম্পত্তি এমন সব হেজিপেজি ব্যাপার।
তাই গ্রাম বা মফস্বল দর্শন সেরে (আসলে গত পাঁচশ বছরে ভিঞ্চির এমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি রাস্তায় গাড়ী আর ট্র্যাফিক লাইটের আগমন ছাড়া) রওনা হলাম আসল গন্তব্যে, লিওনার্দোর আঁতুড়ঘরে, যার নাম কাসা লিওনার্দো।
ভিঞ্চি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে আঞ্চিয়ানো নামের এক স্থানে প্রাচীন সব জলপাইগাছ পরিবেষ্টিত মধ্যযুগে নির্মিত এক ঘরে মর্ত্যের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটির আগমন ঘটেছিল ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল। ঘরটি আজও সেইভাবেই রাখা আছে, অসংখ্যবার এর ছবি দেখেছি নানা বই, পত্রিকা, গবেষণাপত্রে।
আজ বৃষ্টিস্নাত অবস্থায় উদাত্ত প্রকৃতির মাঝে জলপাই বন ভেদ করে সেই চিরচেনা অবয়ব যখন চোখের সামনে সুন্দর বাস্তবে রূপ নিল, সেই আলোক ভরা তীব্র সুখানুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার হারিয়ে গেল চিরতরে। তখন কেবল উপভোগের পালা, উপলব্ধির পালা। ধন্য তুমি লিওনার্দো, তোমার জন্যই আজ ধন্য ভিঞ্চি, ইতালি, সমগ্র মানবজাতি।