ম্যান্দা কী? জামালপুরের ‘ম্যান্দা’ এখন ঢাকায়!
বিয়ে, আকিকা, দোয়া-মাহফিল—উপলক্ষ যা-ই হোক, 'ম্যান্দা' ছাড়া যেন সবকিছুই অপরিপূর্ণ। 'ম্যান্দা' নামটি অনেকের কাছে অপরিচিত মনে হলেও উত্তরবঙ্গের মানুষ, বিশেষ করে জামালপুরবাসীর কাছে এ যেন অমৃতসম খাবার। শত বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটিকে কেউ ম্যান্দা, কেউবা মিল্লি, পিঠালি, পিটুলি নামে চেনেন। কিন্তু যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর স্বাদ যে একবার পরখ করেছে, তার কাছে এটা সুস্বাদু খাবার বলেই পরিগণিত হয়েছে।
ঠিক কবে ম্যান্দা খাবারটির প্রচলন শুরু হয় বা কীভাবে এটি এত জনপ্রিয়তা পেল তার সুস্পষ্ট ইতিহাস পাওয়া না গেলেও ধারণা করা যায় বিশেষ প্রক্রিয়ার রন্ধনপ্রণালী খাবারটিতে ভিন্নমাত্রায় বিশেষত্ব এনে দিয়েছে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ির সুলতান বাবুর্চি পেশাজীবনে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ম্যান্দা রান্না করে আসছেন। ম্যান্দা রান্নার হাত তার এতটাই পরিপক্ক যে, জামালপুরের একাধিক অনুষ্ঠানের রান্নার গুরু দায়িত্বভার তার কাঁধেই দেওয়া হয়। জামালপুরের বাইরে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ একাধিক জায়গায় ম্যান্দা রান্নার জন্য তার ডাক পড়েছিল। এত বছরের অভিজ্ঞতায় রান্নার জন্য অনেক সুখ্যাতিও পেয়েছেন তিনি।
অভিজ্ঞ এই বাবুর্চি রান্নার পদ্ধতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, 'প্রথমে হাঁড়িতে সয়াবিন ও সরিষার তেল দিতে হবে। বলে রাখা ভালো, সরিষার তেল ছাড়া কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ম্যান্দার স্বাদ আসবে না।
'তারপর এক এক করে পেঁয়াজ, আদা, রসুন কুচির সাথে সবরকমের মসলা দিয়ে গরুর মাংসকে হাত দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে নিতে হবে। 'বজের গুঁড়া' নামের একধরনের হলুদের গুঁড়ার মতো মসলা, রাধুনিপাতার সস ও মৌরি/মিষ্টি সস ব্যবহার করা হয় রান্নার স্বাদ বাড়িয়ে তুলতে।
'তারপর পরিমাণমতো পানি দিতে হবে এবং মাংস হাঁড়িতে দেওয়ার পর থেকে ১ ঘণ্টা ভালোভাবে কষিয়ে নিতে হবে। তা না হলে মাংসে কাঁচা গন্ধ থেকে যেতে পারে। রান্নার মাঝে নাড়াচাড়া দেওয়ার সময় একটু একটু করে বারবার গরম মসলা মেশাতে হবে। মাংস ভালোভাবে কষিয়ে নেওয়া হয়ে গেলে অল্প অল্প করে চালের গুঁড়া মেশাতে হবে।
'খেয়াল রাখতে হবে চালের গুঁড়া যেন কোনোভাবে দলা বেঁধে না যায়, তাই মেশানোর সময় বারবার নাড়তে হবে। মূলত চালের গুঁড়ার সঠিক ঘনত্বই এই খাবারের স্বাদের মূল কারণ।
'সবশেষে আগে থেকে ভেজে রাখা পেঁয়াজ, রসুন, জিরা দিয়ে বাগাড় দিতে হবে এবং রান্নার শেষে হালকা গরম মসলা মেশাতে হবে ঘ্রাণের জন্য। ব্যস, তারপর সুস্বাদু এই ম্যান্দার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। ৫০ জন লোকের রান্নার জন্য ১০ কেজি মাংসের সাথে ৩/৪ কেজি চালের গুঁড়া প্রয়োজন হয়। কেউ চাইলে অল্প পরিমাণে মাসকালাইয়ের ডালের গুঁড়া মেশাতে পারে।'
স্বাভাবিক ঝালের তুলনায় ম্যান্দা-তে একটু বেশি করেই ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। আগের দিনে মহিষের মাংস ব্যবহার করা হতো ম্যান্দা রান্নায়। বর্তমানে গরুর মাংস দিয়েই বেশিরভাগ সময় রান্না করা হলেও মাঝে মাঝে খাশির মাংস দিয়েও রান্না করা হয়।
এমনকি কিছু কিছু জায়গায় ম্যান্দায় শাক ও চিংড়ি দিয়েও রান্না হয়। এই রান্নার ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে চর্বিযুক্ত মাংস এখানে বেশি ব্যবহার করা হয়। আগে কলাপাতায় ভাতের সাথে ম্যান্দা খেতে দেওয়া হতো, কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন আর কলাপাতার ব্যবহার হয় না।
বিয়ে, মৃত্যুবার্ষিকী, আকিকা, মুসলমানি থেকে বিচার, সভা-সমাবেশ সবকিছুতে অন্যান্য কয়েক রকম পদের আয়োজন থাকলেও জামালপুরের সব অনুষ্ঠানের ম্যান্দা থাকা চাই-ই চাই। তা না হলে খাবারে যেন ঠিকঠাক তৃপ্তি আসে না। ম্যান্দা রান্না অনুষ্ঠানে একরকম উৎসব আমেজ এনে দেয়।
ঢাকায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার মেজবানের পরিচিতি অনেক আছে, কিন্তু ম্যান্দার মতো সুস্বাদু এই খাবারের নাম-ডাক এতো কম বলে অনেকেই এটা সম্পর্কে জানেন না। তাই জামালপুরবাসীর ঐতিহ্যবাহী এই খাবারকে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে ঢাকায় বসবাসরত ড. হাবিবুল্লাহ তালুকদার ও পল্লব মোহাইমেন ব্যক্তি উদ্যোগে ম্যান্দাভোজ নামের ইফতার ও মিলনমেলার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানটির ইফতারের খাবারের মূল আয়োজনে ছিল জামালপুরের বহুল জনপ্রিয় ম্যান্দা খাবারটি। ২৫ এপ্রিল (সোমবার) ৫টায় পল্লীমা সংসদসংলগ্ন এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়। ব্যক্তি উদ্যোগে করা এই অনুষ্ঠানটি ছোট পরিসরে আয়োজন করা হলেও ইতিমধ্যে ভালো সাড়া পেয়েছে।
অনুষ্ঠানটির সহ-উদ্যোক্তা পল্লব মোহাইমেন বলেন, 'আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী এই খাবার সকলের কাছে তুলে ধরতে চাই। ৫/৬ বছর আগেও আমরা একবার ঢাকায় এইরকম আয়োজন করেছিলাম। মূলত ঢাকায় অনেক জামালপুরবাসী আছেন, তাদের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু বিভিন্ন জেলার মানুষ আমাদের অনুষ্ঠানে আসেন ম্যান্দা খেয়ে দেখতে। আমাদের পরিকল্পনা আছে আগামী মাসে আমরা বড় করে মেলার মতো আয়োজন করে অনুষ্ঠানটি করব।'