সাপের জন্য ভালোবাসা!
সাপে কেটেছে মাগুরার আব্দুল জলিলকে (ছদ্মনাম)। মুমূর্ষু অবস্থা তার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মরণদশা দেখে কান্নার রোল উঠেছে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না কেউ।
এমন সময় ঘটনাস্থলে হাজির এক তরুণ। জলিলকে দংশন করা সাপটি দেখলেন তিনি। তারপর নির্দ্বিধায় ধরে ফেললেন জ্যান্ত সাপটিকে। মুমূর্ষু জলিলকে বললেন, 'আপনি তো মারা যাচ্ছেন না। এই যে দেখেন, আমি হাতে নিয়ে ধরছি সাপটা। এটা তো একেবারেই নির্বিষ।'
তরুণের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন জলিল। স্বাভাবিক গলায় বললেন, 'একটু পানি খাব। আমার ভালো লাগছে।'
তার এক ঘণ্টা পর দিব্যি হেঁটে বাজার করতে চলে গেলেন আব্দুল জলিল। তাহলে নির্বিষ সাপের দংশনে তার এমন মরণদশা হয়েছিল কেন? আসলে তিনি সাপের বিষে নয়, প্রচণ্ড আতঙ্কে হার্ট অ্যাটাক করে মরতে বসেছিলেন। কিন্তু যখন জানলেন, তাকে নির্বিষ সাপে কেটেছে, মৃত্যুর ভয় নেই, সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেন।
আর আব্দুল জলিলের মন থেকে অমূলক ভয় দূর করে তাকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করলেন যে তরুণ, তিনি ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন নামক একটা সংগঠনের সদস্য। সাপসহ অন্য যেকোনো বিপদগ্রস্ত বন্যপ্রাণী রক্ষা, উদ্ধার ও অবমুক্ত করার কাজ করছে সংগঠনটি।
শুরুর গল্প
সংগঠনটির নাম প্রথমে জানতে পারি সাপকে কেন্দ্র করে লেখা একটি থ্রিলার বই পড়তে গিয়ে। সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে, এমন সংগঠনও আছে জেনে প্রথমে একটু রোমাঞ্চিত আর অবাকই হয়েছিলাম। 'হিমঘুম' নামের বইটির লেখক বাপ্পী খানকে তাই অনুরোধ করলাম সংগঠনটির উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতে। তিনিও রাজি হয়ে গেলেন একবাক্যে।
কাজেই এক মেঘলা সকালে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উদ্দেশে। কথায় কথায় জানতে পারলাম, বই লেখার জন্যই সাপ-সংক্রান্ত তথ্য জানার দরকার হয়েছিল বাপ্পী ভাইয়ের। খুঁজতে খুঁজতে ২০১৮ সালের দিকে সন্ধান পান ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের। সেই সূত্রে সক্রিয়ভাবেই জড়িয়ে পড়েন সংগঠনটির সঙ্গে। এখন তিনি ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের ক্রিয়েটিভ উইংয়ের প্রধান।
যাহোক, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম জাবিতে। ততক্ষণে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির বেগ একটু কমার পর পৌঁছে গেলাম জাবি ক্যাম্পাসসংলগ্ন ইসলামনগরে, ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউয়ের অফিসে।
অফিসে ঢুকতে আমাদের স্বাগত জানালেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান। তার সঙ্গে পরিচয়পর্ব সেরে অফিসকক্ষের চারপাশে চোখ বোলাতেই একটু চমকে গেলাম। ছোটখাটো একটা চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়েছি যেন। ঘরের একপ্রান্তে মড়ার মতো পড়ে আছে একটি গুইসাপ। মাহফুজুর জানালেন, কয়েকদিন আগে একদল মানুষ প্রাণীটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল; সেখান থেকে তার সংগঠনের সদস্যরা ওটাকে উদ্ধার করে এনেছেন। এখন সেবা-শুশ্রূষা করে সরীসৃপটিকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছেন। কথা বলতে বলতেই গুইসাপটিকে স্যালাইন দিয়ে এলেন মাহফুজুর।
গুইসাপ ছাড়াও একটা খাঁচায় দেখলাম একটি লালমাথা টিয়া টুকটুক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই পাঠশালার পণ্ডিতের মতো চোখ মটকে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আরেক খাঁচায় দেখলাম সপ্তাহ দুয়েকের একটি কাঠবিড়ালির বাচ্চা। অন্য এক খাঁচায় একটি ইন্ডিয়ান রিংনেক (এক জাতের টিয়া)। মেঝেতে একটা পাত্রে খানিকটা পানি, তাতে একজোড়া কাছিম। কাছিমদুটোকে পুষতে পারছিলেন না বলে ওদের দেখভালের দায়িত্ব ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনকে দিয়েছেন এক ব্যক্তি। কাছিম ছাড়া বাকি সবগুলো প্রাণীকেই সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলার পর অবমুক্ত করে দেওয়া হবে।
সাপের আতঙ্ক থেকে শুরু, ভালোবাসায় পরিণতি
ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজুর পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। মাহফুজুর জানালেন প্রাণীদের প্রতি ছোটবেলা থেকেই সহজাত ভালোবাসা ও মমতা ছিল তার। সেই ভালোবাসা থেকেই এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া।
তবে মাহফুজুর কিন্তু ছোটবেলায় সাপকে প্রচণ্ড ভয় পেতেন। এই ভয়ের পেছনে আছে এক ঘটনা।
বাবার চাকরিসূত্রে মাহফুজুর তখন রাজশাহীতে থাকেন। সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছেন। ওই সময় একদিন শুনলেন তাদের এলাকার এক সাপুড়ে মারা গেছেন 'জিন সাপের' কামড়ে। ওই সাপটিকে ধরে নিয়ে এসে মাটির হাঁড়িতে গামছা দিয়ে দু-প্যাঁচ দিয়ে আটকে রেখেছিল সাপুড়ে। তারপরও কোনোভাবে সাপটি হাঁড়ি থেকে বেরিয়ে ওই সাপুড়েকে দংশন করে। তার শরীরে কামড়ের দাগও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ কারণেই স্থানীয়দের মনে বিশ্বাস জন্মে যায় যে, কাজটা জিন সাপের।
এরপর থেকেই সাপকে ভীষণ ভয় পেতে শুরু করেন মাহফুজুর। তবে বয়স বাড়ার পর নানা জায়গায় সাপ দেখতে দেখতে তার সর্প-আতঙ্ক কেটে যেতে থাকে, সেইসঙ্গে প্রকট হতে থাকে তার প্রাণীপ্রেমও।
পরে সাপ সম্পর্কে আরও জানাশোনার পর মাহফুজুর বুঝতে পারেন, রাজশাহীর ওই সাপুড়েকে দংশন করেছিল খুব সম্ভব পাতিকেউটে। এই সাপ মাথা দিয়ে প্রবল চাপ প্রয়োগ করতে পারে। পাতিকেউটেকে কোনো পাতিল বা পাত্রে আটকে ওই পাত্রের মুখ কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলেও এরা কাপড় ছিদ্র করে ফেলতে পারে। এছাড়া পাতিকেউটের দাঁতও অত্যন্ত ছোট ও সূক্ষ্ম। এ কারণে এই সাপে কামড়ালে তার দাগ সচরাচর খালি চোখে খুঁজে পাওয়া যায় না। এজন্যই ওই সাপুড়ের শরীরে কামড়ের দাগ পাওয়া যায়নি।
প্রথম যখন সাপ উদ্ধার করেন, মাহফুজুর তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবার চাকরিসূত্রে থাকতেন বরিশালে। একদিন দেখেন একটা ড্রেনের পাশে একদল মানুষ একটি সাপকে মারছে অকারণেই। তখন তিনি সেটিকে উদ্ধার করেন। যদিও তখন সাপ উদ্ধারের কলাকৌশলের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। একেবারেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ধার করেছিলেন অসহায় প্রাণীটিকে।
বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে
উদ্ধার করা সাপটিকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর বাধার মুখে পড়েন মাহফুজুর। বাবা-মায়ের প্রশ্ন ছিল: এত কিছু থাকতে সাপ কেন? এরপর অভিভাবকেরা অনেক চেষ্টা করেছেন মাহফুজুরের মাথা থেকে সাপের 'ভূত' নামাতে। কিন্তু লাভ হয়নি।
২০১৩ সালে, মাগুরায় থাকাকালে, সক্রিয়ভাবে বন্যপ্রাণী বাঁচানোর প্রচেষ্টা শুরু করেন মাহফুজুর। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও নিজের উৎসাহ ও অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই তিনি সে সময় বেশ কিছু সাপ উদ্ধার করেন।
সে সময় কয়েকজন সাপুড়ের সঙ্গে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেন মাহফুজুর। তাদের সঙ্গে থেকে সাপ ধরার কিছু কায়দা-কানুন শেখেন। এরপর ড. রেজা খান, আলী ইমাম, শরীফ খানদের বিভিন্ন বই পড়ে সাপসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানাশোনা হয় তার।
তারপর মাহফুজুর ভর্তি হন মাগুরা গভর্নমেন্ট কলেজ। ততদিনে বন্ধু মহল ও আত্মীয়রা জেনে গেছে এই তরুণের সর্প ও প্রাণীপ্রেম। কিন্তু আশপাশের মানুষজন বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মাহফুজুরের এই সখ্যের ব্যাপারটা ভালোভাবে নিচ্ছিল না। এমনকি বাবা-মাও তার এ কাজে সমর্থন দিতেন না। তারা তো ভাবতেন, এই ছেলের ওপর 'জিনের আছর' আছে। ২০১৭ সালে ঝিনাইদহে থাকার সময় মাহফুজুরকে কবিরাজের কাছেও নিয়ে যাওয়া হয় তার ওপর থেকে জিনের আছর নামাতে!
কিন্তু কিছুই দমাতে পারেনি মাহফুজুরকে। তত দিনে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে তার। তাদের কাছ থেকেই যথাযথভাবে শেখেন সাপ কীভাবে উদ্ধার করতে হয়, ধরতে হয়।
ওই সময় থেকেই আশপাশের আরও কয়েকজন সমমনা বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে বিপদগ্রস্ত বন্যপ্রাণী উদ্ধারের জন্য ছোট একটা দল গঠন করেন মাহফুজুর। তাদেরকে নিয়ে মাঝেমধ্যে সাপ উদ্ধার করতে যেতেন।
পরে পরিবারকে বোঝানোর পর তারা এখন আর মাহফুজুরের এ কাজে বাধা দেয় না।
উচ্চমাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে মাহফুজুর ভর্তি হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে প্রায়ই সাপ মারা হতে দেখতেন তিনি। এটা বন্ধ করার জন্য আরও বৃহৎ পরিসরে সাপসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী উদ্ধারের কাজ করার কথা ভাবেন এই তরুণ।
অবশেষে ২০১৮ সালে স্নেক রেসকিউ টিম নামে একটি দল গঠন করেন মাহফুজুর। ফেসবুক গ্রুপও খোলেন এ নামে। তারা ঘোষণা দেন, জাবি ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন এলাকায় কোনো সাপ দেখা গেলে যেন তাদের জানানো হয়, তারা সেটিকে উদ্ধার করবেন। এরপর থেকে তাদের কাছে সাপসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী উদ্ধারের জন্য ফোন আসতে থাকে। এখন তাদের কাছে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক ফোনকল আসে বন্যপ্রাণী উদ্ধারের জন্য। পরে সংগঠনের নাম পাল্টে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন রাখা হয়।
আড্ডার এ পর্যায়ে যোগ দিলেন সংগঠনটির প্রচার সম্পাদক ও ফাইন্যান্স উইং ডিরেক্টর সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া। পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে।
আরেকটা পরিচয় আছে অনন্যার। তিনি দেশের প্রথম নারী স্নেক রেসকিউয়ার। অনন্যাসহ মোট ৩ জন নারী স্নেক রেসকিউয়ার আছেন ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনে।
স্কুলজীবন থেকেই প্রাণীদের নিয়ে টুকটাক কাজ করতেন অনন্যা। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন বিভিন্ন সংগঠনে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কাজের সূত্রেই পরিচয় হয় ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজুরের সঙ্গে। এরপর সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জন্য কাজ করার তাগিদে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন সংগঠনটির সঙ্গে।
প্রথম প্রথম যখন উদ্ধারকাজে যেতেন, মাঝেমধ্যেই বাধার মুখে পড়তেন অনন্যা। মেয়ে বলে তার ওপর ভরসা করতে পারত না অনেকে। তাকে গ্যারেজে বসে থাকতে বলত। সে সময় অনন্যার পাশে দাঁড়িয়েছেন তার সহকর্মীরা।
তবে শুধু তিক্ত অভিজ্ঞতাই হয়নি, ভালো অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনন্যার। সাপ উদ্ধার করতে গিয়ে সাহসের জন্য প্রশংসাও পেয়েছেন অনেকের।
বাড়ছে সংগঠনের পরিসর
ধীরে ধীরে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা প্রায় ৫০০, স্নেক রেসকিউয়ারের সংখ্যা ৩০ জন। এখন সারা দেশেই কাজ করছে সংগঠনটি।
বন বিভাগও এখন প্রায়ই বিপদে পড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধারের জন্য ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের সাহায্য নেয়। কোথাও কোনো বন্যপ্রাণী বিপদে পড়লে সংগঠনটি বন বিভাগকে তা জানায়। বন বিভাগই তখন তাদেরকে ওই প্রাণী উদ্ধারের অনুমতি দেয়। তাছাড়া প্রতিটি উদ্ধারকাজেই বন বিভাগের ওয়ার্ল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের একজন কর্মকর্তা উপস্থিত থেকে পুরো কাজের তত্ত্বাবধান করেন।
এ পর্যন্ত প্রায় ১,৫০০ সাপ উদ্ধার করেছে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন। অজগর থেকে শুরু করে নানা জাতের গোখরা, রাসেলস ভাইপার, দাঁড়াশসহ বহু বিষধর, নির্বিষ ও দুর্লভ প্রজাতির সাপ রয়েছে সে তালিকায়। শুধু সাপ নয়, মাহফুজুররা উদ্ধার করেছেন গুইসাপ, পাখি, কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, শেয়ালের মতো আরও অনেক প্রজাতির পাঁচ শতাধিক বন্যপ্রাণী।
ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন এখন সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসভিত্তিক কার্যক্রম চালায়। সংগঠনটির ফেসবুক গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ১ লাখের বেশি। সেখানে বন্যপ্রাণী নিয়ে সচেতনামূলক আলোচনা করেন সদস্যরা।
আড্ডার একপর্যায়ে হাজির হলেন দুই প্রাণীপ্রেমী নিলয় হাসান ও তাজরিয়ান আলম নেলি। তারা এসেছেন উত্তরা থেকে। ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া প্রথম ব্যাচের রেসকিউয়ারদের একজন নিলয়।
নিলয় জানালেন, প্রাণীদের নিয়ে কাজ করে—এমন সমমনা মানুষের খোঁজ করতে করতেই ফেসবুকে সন্ধান পেয়ে যান ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের গ্রুপের। সেখান থেকে গ্রুপটির অ্যাডমিনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুক্ত হয়ে যান সংগঠনটির সঙ্গে। শিক্ষানবিস রেসকিউয়ার নেলিও সংগঠনটির খোঁজ পেয়েছেন ফেসবুকে। তিনি ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া তৃতীয় ব্যাচের সদস্য।
সংগঠনটির উপদেষ্টা হিসেবে আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল খান, দর্শন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ শওকত হোসেন, বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের পরিচালক জহির আকন প্রমুখ।
আছে বিব্রতকর অভিজ্ঞতাও
সাপ নিয়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে দেশে। এ কারণে বিভিন্ন সময় সাপ উদ্ধার করতে গিয়ে নানা বাধায় পড়েন ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের সদস্যরা, অনেক রকমের বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হন। যেমন, কোথাও কোথাও সাপ উদ্ধারে যাওয়ার পর লোকজন জিজ্ঞেস করে: 'আপনাদের বীণ কোথায়?' তাদের ধারণা, বীণ বাজিয়ে সাপ ধরা হবে বুঝি।
আবার সংগঠনটির নারী সদস্যরা উদ্ধারকাজে গেলেও মাঝেমধ্যে বাধা পান বলে জানালেন অনন্যা। অনেকেই মেয়েদের ফেরত পাঠিয়ে কোনো ছেলে উদ্ধারকারীকে পাঠাতে বলেন। তবে ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন আসছে বলে জানালেন মাহফুজুর ও অনন্যা।
সাপকে অমূলক ভয় নয়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সাপের কামড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।
তাই মাহফুজুরের কাছে প্রশ্ন রাখলাম—এত মানুষ মারা যাচ্ছে সাপের কামড়ে, তারপরও এই প্রাণীকে কেন বাঁচিয়ে রাখা দরকার?
জবাবে মাহফুজুর বললেন, বেশ কয়েকটি কারণেই সাপকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রথম কারণ, বাস্তুতন্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সাপ। পোকামাকড়, ব্যাঙ, ইঁদুরের মতো প্রাণীদের খেয়ে ফসল বাঁচানোতে অবদান রাখে এই সরীসৃপ।
ইঁদুর ফসল খেয়ে ফেলে, আবার বাঁধও কেটে ফেলে অনেকসময়। ফলে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় দেশের। তাছাড়া ইঁদুরের মাধ্যমে রোগজীবাণুও ছড়ায়। ফলে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখে সাপ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য যেমন রক্ষা করে, তেমনি অর্থনৈতিক লোকসান কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে।
চাইলেই হওয়া যায় না স্নেক রেসকিউয়ার
যেকেউ চাইলেই এই সংগঠনের সাপ উদ্ধারকারী হতে পারেন না। সেজন্য তাকে সংগঠনের তত্ত্বাবধানে সাপ-সংক্রান্ত প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়।
যারা প্রথম ধাপে উৎরে যান, তাদেরকে অভিজ্ঞ উদ্ধারকর্মীদের সহযোগী হিসেবে বেশ কিছু দিন কাজ করে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এরপর তারা পূর্ণ উদ্ধারকারী হিসেবে বিবেচিত হন।
মানুষ ও প্রাণীর সহাবস্থানের দর্শন
মাহফুজুর জানালেন, ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের মতাদর্শ হচ্ছে, সব জীবের সমান অধিকার ও মূল্য আছে। মাহফুজুরদের চাওয়া—ভালো থাকুক মানুষ, ভালো থাকুক প্রকৃতির সন্তানেরা।
এ লক্ষ্যে নিয়মিত বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এ কাজ করতে গিয়ে কুড়িয়েছেন অনেক মানুষের ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা।
অনন্যা জানালেন, কিছুদিন আগে রংপুরে এক বৃদ্ধকে বিষধর খৈয়া গোখরা দংশন করে। শরীরে নিউরোটক্সিন ঢোকার ফলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়, তার সবগুলোই প্রকট হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে। ওই ব্যক্তির পরিবার তাকে ওঝার কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের সদস্যরা তাতে বাধা দেন। অনন্যা বলেন, 'আমরা বলেছিলাম, আপনি যদি মারা যান, সেই দায় আমাদের—আপনি ডাক্তারের কাছে যান।'
এরপর ওই ব্যক্তিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তবে চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাঁচানো যায়।
সুস্থ হয়ে পরে ওই ব্যক্তি ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের সদস্যদের কৃতজ্ঞতা জানান।
অনন্যা জানালেন, আরেকবার তারা একটি মুমূর্ষু চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) উদ্ধার করেন। সাপটিকে কাস্তে দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। আঘাতে চন্দ্রবোড়াটির পেট এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়ে শুক্রাশয়, অণ্ডকোষ বেরিয়ে আসে। একজন ভেটেরিনারি শিক্ষার্থী সাপটির শরীরের বেরিয়ে যাওয়া অংশ ফের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া পেট সেলাই করে দেন।
অনন্যা ও অন্যান্য কর্মীরা প্রায় দেড় মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে মুমূর্ষু সাপটিকে সারিয়ে তোলেন। ঘা শুকানোর পর সরীসৃপটিকে উপযুক্ত পরিবেশে অবমুক্ত করে দেওয়া হয়।
এভাবে সাপসহ বহু প্রাণী উদ্ধার ও অবমুক্ত করেছেন মাহফুজুররা। সাপ উদ্ধারের জন্য কোনো জায়গায় যাওয়ার পর তারা প্রথমেই সাপ যেখানে আটকা পড়ে, সেখানকার মানুষজনকে শান্ত থাকার জন্য সাহস জোগান। তাদেরকে বোঝান, সাপটিকে আক্রমণ না করলে সেটি নিজে থেকে কারও কোনো ক্ষতি করবে না।
বন্যপ্রাণী উদ্ধারের পর প্রাণীগুলো যেরকম পরিবেশে থাকে, ঠিক সেরকম পরিবেশেই অবমুক্ত করেন মাহফুজুররা।
অহেতুক বন্যপ্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধের জন্য ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন নানা রকমের জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি চালিয়ে থাকে। প্রাণীরাও যেন মানুষের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সেজন্যও কাজ করছে তারা। যেমন: জলাতঙ্ক যেন না ছড়ায়, সেজন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শতভাগ কুকুরকে টিকা দিয়েছেন সংগঠনটির সদস্যরা। ক্যাম্পাসে কুকুরের সংখ্যা যেন মাত্রা না ছাড়ায়, সেজন্য ৬০ শতাংশ কুকুরকে বন্ধ্যাকরণও করেছেন তারা।
এভাবেই মানুষ ও প্রাণীদের সহাবস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে যেতে চায় ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির হটলাইন নম্বর: ০১৭১৮৪১৪৫১৭। সংস্থাটির সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হতে চাইলে অথবা প্রাণী উদ্ধার কাজে প্রশিক্ষণ নিতে চাইলে যুক্ত হতে পারেন ফেসবুক গ্রুপেও। গ্রুপের লিঙ্ক এখানে।