গ্যালারির ভেতরেই ঢাকা শহর: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ভার্টিকাল প্যানারমিক প্রদর্শনী
ঢাকা শহরের অদেখা, কম দেখা কিংবা বলা যায় চোখে পড়লেও চোখ এড়িয়ে যাওয়া কিছু দৃশ্যের, মানুষের ছবি ফ্রেমে বন্দি, মুহূর্তগুলো ধারণ করা হয়েছে ১৫ বছর ধরে। আলোকচিত্রীর ১৫ বছর ধরে তোলা ছবির মধ্যে বাছাইকৃত ৪২টি ছবি মানুষের সমান উচ্চতার ফ্রেমে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে গ্যালারিতে। ছবিগুলোর ফ্রেমের ছায়া পড়েছে পেছনের দেয়ালে। দেখে মনে হচ্ছে, ঢাকা শহরের-ই প্রতিবিম্ব পড়েছে দেয়ালে।
এরকম এক প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীরা যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মনে হতেই পারে গ্যালারির ভেতরেই যেন ঢাকা শহর ঢুকে গেছে। অনেক দর্শনার্থীরা নিজেরাই বলছেন এমন কথা। প্রদর্শনীর নাম 'দাঁড়াও ঢাকা'।
রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে 'দুনিয়াদারি আর্কাইভে'র আয়োজনে গত ১৩ মে থেকে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। প্রদর্শিত ছবিগুলো নিয়ে একটি বইও বেরিয়েছে একই শিরোনামে।
আলোকচিত্রী বশির আহমেদ সুজন ২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো তুলেছেন। কোভিড মহামারি চলাকালীন সময়ের কিছু ছবিও আছে। এতো লম্বা সময় ধরে ছবি তুলে এ ধরনের প্রদর্শনী করবেন সেটা অবশ্য আগে ভাবেননি তিনি।
জানালেন, অল্প কিছুদিন আগেই নিজের তোলা প্যানারমিক কিছু ছবি প্রিন্ট করানোর পর ভার্টিকাল প্যানারমিক প্রদর্শনীর কথা মাথায় আসে।
"এতো ছবি তোলা হয়েছে, অনেক ছবির কথা ভুলেও গিয়েছিলাম। ভার্টিকাল প্যানারোমিক ছবি নিয়ে আলাদা আগ্রহ তো ছিলই, তবে হুট করে একদিন ছবিগুলো প্রিন্ট করানোর পর প্রদর্শনীর কথা মাথায় আসে।
একটি ভিন্নভাবে যে দেখার চেষ্টা করেছিলাম, এ পর্যায়ে যে এসে দাঁড়াবে তা আগে বুঝিনি। আমি আমার মন থেকে ঢাকা শহরকে এভাবেই দেখে ছবি তোলা শুরু করেছিলাম।"
ছবির দৃশ্যগুলো যেভাবে দেখেছেন আলোকচিত্রী, অনেকটা সেভাবেই দেখা যাবে গ্যলারিতে, কারণ ছবিগুলো দেয়ালে ঝুলানো নয়। লম্বা ফ্রেমের ছবিগুলো দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় শহরের দালান-কোঠার আবহ এসেছে। এরমধ্যেই দেখা যাচ্ছে সে সব দৃশ্য।
ছবিগুলোর প্রদর্শনীতে এই অনন্য মাত্রা এনেছেন প্রদর্শনীর কিউরেটর ও বইটির সম্পাদক আমিরুল রাজিব ও নাঈম ঊল হাসান।
সুজনের প্রিন্ট করানো ছবিগুলো দেখে কিউরেটর আমিরুল ভিন্ন কিছু দেখতে পান। "বলার ভঙ্গিটা সরল হলেও, অনেক ছোট ছোট গল্প, কথা আছে এরমধ্যে," বলছিলেন তিনি।
এরপর প্রদর্শনী আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তারা। কয়েকজনের টিম গড়েন প্রদর্শনীর জন্য।
"কিউরেটর হিসাবে শিল্পীর কনটেন্টকে নিজে বোঝার চেষ্টা করেছি। শিল্পীর কাজে কিসের প্রভাব আছে, কী ধরনের কাজ তা বুঝেই মনে হলো, ঢাকা শহর নিয়ে প্রদর্শনী তো, ছবিগুলো দেয়ালে না ঝুলিয়ে লম্বা কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন হয়। এই দালান-কোঠা তো ঢাকাকে বদলে দিচ্ছে, সব নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এজন্য ছবিগুলো লম্বা"।
"ভর্তি গ্যালারি দেখে মনে হচ্ছে জনবহুল ঢাকা, আবার খালি হলেই যেন ঈদের ঢাকা। অনেক দর্শকও বলছেন এমনটা"।
আলোকচিত্রী বশির আহমেদ সুজন যখন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন, ঢাকায় এতো সুউচ্চ ভবন ছিল না। বেবিট্যাক্সি, ঠেলাগাড়ি ও রিকশা আর ছিল পাখির ঝাঁক তার ঢাকা নিয়ে প্রিয় স্মৃতি। নিজের চোখের সামনে বদলে যেতে দেখা ঢাকাকে যেভাবে দেখেছেন, দর্শককেও সেভাবেই দেখাতে চেয়েছেন। একই দৃশ্য দর্শনার্থীরা দেখে যাতে নিজের মতো করে ভাবতে পারেন, তাই ছবিগুলোর কোনো বিবরণী দেওয়া হয়নি।
"কিছু আরোপ করতে চাইনি আমি। ঢাকাকে যেভাবে দেখেছি সেভাবেই মানুষকে দেখাতে চেয়েছি।"
২০০৬ সাল থেকে ঢাকার পথে পথে হেঁটে এসব ছবি তুলেছেন সুজন। ২০০৯-১০ সালের দিকে একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণের পর থেকে ঢাকার দৃশ্য নিয়ে প্যানারমিক ছবি তোলার নেশা পেয়ে বসে তাকে। হ্যাসেলব্যান্ড এক্স প্যান ক্যামেরা দিয়ে প্যানারমিক ছবি তোলা শুরু করেন। এরমধ্যে কিছু ছবিই দেখা যাবে এই প্রদর্শনীতে।
ম্যাপ ফটো এজেন্সির সদস্য বশির আহমেদ সুজন। ২৫ বছরের কর্মজীবনে বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে আছে 'বৃত্ত' ম্যাপ ফটোগ্রাফারদের যৌথ প্রযোজনা (২০০৩), অ্যান আননোন ডাস্ক (২০০৭), দ্য ক্রোশেট ভিলেজ (২০১০) ইত্যাদি।
শুধু বাংলাদেশই নয়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ভার্টিকাল প্যানারমিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
এরইমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে প্রদর্শনীটি। প্রথমদিনই এসেছিলেন সাতশোর বেশি দর্শক।
আগামী ২১ মে পর্যন্ত প্রদর্শনী চলবে। সময় বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা। দাঁড়াও ঢাকা বইটিও পাওয়া যাবে প্রদর্শনীতে, শুভেচ্ছামূল্য ৫০০ টাকা।