অযত্ন-অবহেলায় অনেক গণকবর, বগুড়া মুক্তদিবস আজ
বগুড়া সদর উপজেলায় চিহ্নিত ৫টি গণকবরের মধ্যে তিনটি গণকবরই পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। শহরের রেল স্টেশনের দক্ষিণে যে গণকবরটি রয়েছে সেটি এখন পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের আস্তানায়।
তবে স্থানীয়দের দাবী, তারা স্থানটির পবিত্রতা রক্ষার সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। এ গণকবরে শায়িত আছেন ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল শহীদ তিনভাই আব্দুল সালাম, আব্দুল কাদের ও আব্দুল সাত্তার।
সে সময় হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরা আটক করেছিল শহীদদের ছোট ভাই আব্দুল ওয়াদুদকেও। “আমি বুঝতে পারছিলাম, আজকে হয়তো আমাদের শেষ দিন। চেষ্টা করছিলাম পালানোর। এক পর্যায়ে হাতের দড়ি খুলে আমি পালিয়ে যাই।” বলছিলেন আব্দুল ওয়াদুদ।
“আমি দৌড়ে বগুড়া শহরের দুই কিলোমিটার পশ্চিমে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যাই। সেখানে আমার বাবাকে সব কথা বলি। পরে বাবাসহ এসে ভাইদের আর খুঁজে পাইনি।” বললেন আব্দুল ওয়াদুদ।
“শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় তাদের আটক করেছিল পাকিস্থানী বাহিনী আর তাদের দোসররা। রেলওয়ের কয়েকজন সুইপার ছিল, তারা ওয়াদুদ ও তার বাবা এবং ভাইদের চিনতো। যুদ্ধ শেষ হলে তারাই নিয়ে যায় ওই জায়গায়। বর্ণনা দেয় নৃশংস হত্যাকান্ডের। মোট ১১ জনকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের প্রত্যেককে গলাকেটে হত্যা করে এখানকার অবাঙ্গালীরা। পরে ঐখানে পুতে দেয়।” বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আব্দুল ওয়াদুদ।
গণকবরের পাশেই একটা খাবারের দোকান চালান এন্তাজ আলী। তিনিও জানালেন হত্যাযজ্ঞের কথা। ১০ বছর বয়সেই তিনি দেখেছেন নারকীয় ওই হত্যাকাণ্ড। যুদ্ধের পর অন্যদের সঙ্গে সেই নৃশংসতার প্রমাণ দেখেছিলেন এন্তাজ।
শহরের নারুলীর বদ্ধভুমিটি এখন বাচ্চাদের খেলার মাঠে। পরিচিত ফলকটি ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। বাচ্চারা জানেও না যেখানে তারা খেলে, সেখানে কী রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্রও রাখা হয় বলে অভিযোগ করলেন স্থানীয়রা। শাহাজাহানপুরে বাবুর পুকুর বদ্ধভুমিটি সংরক্ষিত হলেও যত্নের অভাব রয়েছে যথেষ্ট।
বগুড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডার রহুল আমিন জানালেন, আবার নতুন করে গণকবর খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। তাদের দাবি আরো অনেক গণকবরই রয়েছে যেগুলো এখনও চিহ্নিত করা হয়নি।
“আমরা এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট নই। এখনও বগুড়ার প্রকৃত শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা শেষ হয়নি। এটা দ্রুত শেষ করা দরকার। এই কাজ শুরু করার জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছি।” বললেন রুহুল আমিন।
স্থানীয় প্রশাসনও এ বিষয়ে আগ্রহী। তবে, কেবলমাত্র মার্চ ও ডিসেম্বর মাস ছাড়া অন্য সময় গণকবর বা স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কাজ হয় না বলেও স্বীকার করেছেন তারা। “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, গণকবর ওগুলো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বহন করে। এগুলোর ঠিকঠাক যত্ন না নিলে নতুন প্রজন্ম ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে না।” বলছিলেন বগুড়া সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুর রহমান।
“যে গণকবরগুলো অযত্নে আছে আমরা খুব শিগগিরই সেগুলো সংরক্ষণ ও পুনঃসংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছি।” বললেন আজিজুর রহমান।
সদরের রামশহর ও জামিল নগরে গণকবরগুলো চিহ্নিত করা হলেও যত্নে নেই সেসব। প্রাথমিকভাবে ৩৫টি গনকবরের তথ্য পেয়েছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু এরমধ্যে বগুড়া শহরের ফুলবাড়িসহ অনেক এলাকায় গণকবর নিশ্চিহ্ন অনেক হয়েছে নদী ভাঙন আর অবৈধভাবে বালি তোলার কারণে। বগুড়ার সাবেক জেলা প্রশাসক নূরে-আলম সিদ্দিকী নন্দীগ্রাম উপজেলার বামনগ্রাম বধ্যভুমি সংরক্ষণ করলেও অনেক বধ্যভুমি এখন অরক্ষিত আছে, দাবি মুক্তিযোদ্ধা আর গবেষকদের।
“গণহত্যা, বধ্যভুমি ও গণকবর জরিপ বগুড়া” নামে একটি বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, বগুড়ায় ৪৫টি স্থানে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গবেষক আকবর আহম্মেদ এ তথ্য দিয়ে জানান, ওই বইতে ৩৩টি গণকবরের কথা বলা হয়েছে। বগুড়াকে হানাদার মুক্ত করতে চারদিক থেকে এক সাথে আক্রমণ করা হয় ১৩ ডিসেম্বর। পূর্বদিক থেকে আসে ৬ গার্ডবাহিনী, সাথে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোতাবির হোসেন। উত্তরদিক থেকে আসেন ৭.৫৫ ট্যাংক বহরসহ ২/৫ গুর্খা বাহিনী। সাথে ছিলেন সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপুসহ মুক্তিযোদ্ধারা। এছাড়া পশ্চিম দিক থেকে আসে ৫/১১ গুর্খা বাহিনী সাথে ছিলেন মেজর হামিদুল হোসেন তারেক বীর বিক্রম আর দক্ষিণ থেকে আসে ৬৯ আমর্ড বাহিনী সাথে মুক্তিযোদ্ধা সবুরের বাহিনী। এসব তথ্য গবেষণা করে পেয়েছে আকবর আহম্মেদ। বগুড়া হানাদারমুক্ত হয় ১৩ ডিসেম্বর।