আইসিইউর জন্য হাহাকার: এক রোগীর মৃত্যুর অপেক্ষায় আরেক রোগীর স্বজন!
করোনা চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) পাশাপাশি দুই কক্ষে চিকিৎসাধীন ছিলেন মিরসরাই পৌরসভার কাউন্সিলর রিজিয়া বেগম (৪৬) ও তার বড় বোন নুর নাহার (৫৫)। মাত্র ১৬ ঘন্টার ব্যবধানে মৃত্যু হয় আপন এই দুই বোনের। শুধু রিজিয়া বা নুর নন, জুলাই মাসের গত ২৭ দিনে চট্টগ্রামে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২১৫ জনের।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় জেলার ১০টি রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে ৩৩৮৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৩১০ জনের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। দৈনিক শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর এই সংখ্যা চট্টগ্রাম জেলায় এযাবৎকালের সর্বাধিক। পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ৩৮ দশমিক ৬৫। এ সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৮ জন ব্যক্তি মারা গেছেন যার মধ্যে ১১ জনই গ্রামের বাসিন্দা।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নমুনা পরীক্ষার পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে রোগী শনাক্তের হারও, যা ৩৮ শতাংশের কিছু বেশি। শুধুমাত্র শেষ পাঁচ দিনে ৫৩ করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে।"
করোনায় মারা যাওয়া কাউন্সিলর রিজিয়া বেগমের ছেলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তানভীর হোসেন তপু বলেন, "বড় খালা প্রথমে করোনায় আক্রান্ত হন, পরে মা। মা এবং খালা একই হাসপাতালের আইসিইউতে দুটি কক্ষে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় বড় খালা নুর নাহার মারা যান। পরদিন রোববার সকাল ১০টায় মায়ের মৃত্যু হয়।"
চলতি মাসের শুরু থেকেই চট্টগ্রামে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সেই সাথে বাড়ছে করোনা রোগীদের আইসিইউর জন্য হাহাকার। বর্তমানে চট্টগ্রামে করোনা রোগীর চিকিৎসা হয় এমন সরকারি-বেসরকারি ১০টি হাসপাতালের কোথাও কোন আইসিইউ খালি নেই। ফলে অক্সিজেনের অভাবে স্বজনের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন করোনা রোগীরা।
এক রোগীর মৃত্যুর অপেক্ষায় আরেক রোগীর স্বজন!
চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোর আইসিইউ রুমের বাইরে দেখা মিলছে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। একটি আইসিইউ বেডের জন্য অপেক্ষা করছেন গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন রোগীর স্বজন। উৎসুক চোখগুলো অপেক্ষায় আছে ভেতরের রোগীদের কারও যদি মৃত্যু হয়, তবে যেন সেই বেডটি তার রোগীর জন্য পাওয়া যায়!
সম্প্রতি জ্বর-সর্দি নিয়ে নোয়াখালী থেকে চিকিৎসা নিতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন আব্দুল গণি। চট্টগ্রামে পৌঁছে স্বজনরা প্রথমে তাকে মা-শিশু হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু মা-শিশুতে অক্সিজেন সম্বলিত কোন সিট খালি না থাকায় মধ্যরাতেই নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে; তখন তার অক্সিজেন লেভেল (স্যাচুরেশন) ৪০-৬০ এর মধ্যে উঠানামা করছিলো। আব্দুল গণির স্বজনরা প্রথম দুইদিন জেলা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে অনেক চেষ্টার পরও কোন আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে পারে নি। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর মৃত্যু হলে আব্দুল গণিকে সে বেডটি দেওয়া হয়। তারপরেও শেষ রক্ষা হয়নি, সেই আইসিইউ বেডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আব্দুল গণির মুত্যু হয়।
চট্টগ্রাম মা-শিশু হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমার মা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তাকে মা-শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাই। কিন্তু তার আইসিইউ প্রয়োজন হলেও বেড খালি না থাকায় নিজের কর্মরত হাসপাতালে তাকে রাখতে পারি নি। তাকে আইসিইউর জন্য বিআইটিআইডিতে ভর্তি করাতে হয়েছে। সেই হাসপাতালে তিনি মারা যান।"
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে চট্টগ্রামে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। অন্য জেলা শহরগুলো থেকেও বিভাগীয় এই শহরের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি হচ্ছে। এতে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ'র জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। তবে রোগীরা বেশিরভাগই বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নেওয়ায় নগরের হাসপাতালগুলোতে কিছু সাধারণ শয্যা এখনো খালি আছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতাগুলোতে ১১৪৪ সিটের বিপরীতে ৪৯৪ জন রোগী ভর্তি আছে, বেসরকারি হাসপাতালের ২৭১৮ সিটের বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ৮৫৬ জন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৪৩ টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছে ১১৯টি। কিন্তু সবমিলিয়ে চট্টগ্রামের ১৫৭টি আইসিইউ বেডের কয়টি খালি আছে সে তথ্য তাদের কাছে নেই।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, "এই মুহুর্তে হাসপাতালের কোনো আইসিইউ খালি নেই। কিন্তু বহু রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন। তবুও যারা চলে আসছেন তাদের হাসপাতালের বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের ভর্তি ও রুটিন অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে জরুরি রোগী ভর্তি ও অপারেশন চালু আছে।"
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আবদুর রউফ গতকাল বলেন, "হাসপাতালের আইসিইউতে ১৮টি শয্যার মধ্যে ১৫টিতে রোগী ভর্তি আছে। বাকি ৩টি আইসিইউ শয্যা বর্তমানে নষ্ট।"
চট্টগ্রাম মা-শিশু হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার ডা. মাহমুদা সুলতানা বলেন, "মা-শিশু হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য মোট ১১টি আইসিইউর কোন শয্যাই খালি নেই। এমনকি করোনা রোগীদের সাধারণ বেডের ১০১টি শয্যাও রোগীতে পরিপূর্ণ।"
এছাড়া নগরের হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৬টি আইসিইউ শয্যা ও ১০০টি সাধারণ বেড এবং রেলওয়ে বক্ষব্যাধী হাসপাতালে ৬০টি সাধারণ শয্যার ব্যবস্থা থাকলেও জনবল এবং উপকরণ সংকটে এ দুটি হাসপাতালে রোগী ভর্তির চিত্র খুবই খারাপ।
এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে পার্কভিউ হাসপাতালে ৮টি আইসিইউ ও ৩৭টি সাধারণ শয্যা, ন্যাশনাল হাসপাতালে ৮টি আইসিইউ ও ১৮টি সাধারণ শয্যা, মেট্রেপলিটন হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ ও ২৮টি সাধারণ শয্যা এবং ম্যাক্স হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ ও ৩০টি সাধারণ শয্যা রয়েছে করোনা রোগীর জন্য।
এদিকে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা আছে ২৬টিতে। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে ১৭১টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে আছে ৪৭টি। ৮০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের মধ্যে সরকারিতে রয়েছে ৫৬টি। তবে এই সব আয়োজনই প্রয়োজনের তুলনায় অতি কম বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
গ্রামে পরিস্থিতির দ্রত অবনতি হচ্ছে
চট্টগ্রামে নগরের তুলনায় গ্রামে করোনা আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। সর্বশেষ ২৭ দিনে চট্টগ্রামে মোট ২১৫ ব্যক্তির করোনায় মৃত্যু হয়েছে; যার মধ্যে ১৩৫ জনই জেলার ১৪ উপজেলার (গ্রাম) বাসিন্দা। উপজেলায় মৃত্যুর এ হার ৬২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অথচ চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে মৃত্যুর পরিসংখ্যান অনুযায়ী নগরে মৃত্যুর হার ছিল ৬০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গ্রামে মৃত্যুর এ হার ৩৯ দশমিক শূণ্য ২ শতাংশ।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৫ মাসে চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলার মধ্যে শুধু মাত্র হাটহাজারীতেই মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের। নগরের হালিশহরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় মৃতদের ৫৫ দশমিক ২৯ শতাংশের বয়স ৬১ বছরের ঊর্ধে। ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর হার ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং যুবকদের (২১-৪০ বছর) মধ্যে মৃত্যুর এ হার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, "শহরের বসবাসকারীদের মধ্যে সচেতনতা বেশি। গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানেন কম। এছাড়া চলতি বর্ষায় গ্রামে জমিতে রোপা আমন চাষ করতে উত্তরবঙ্গ থেকে প্রচুর শ্রমিক এসেছে। ধারণা করছি এ কারণেও উপজেলাগুলোতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে।"