আলাদা অ্যালুমিনিয়াম শিল্প জোন হলে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা
বাবার হাত ধরে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবসায় আসেন ইকরামুল। সত্তরের দশকে বাবা শহীদ উল্লাহ ব্যবসাটি শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে বাবার সঙ্গে ইকরামুলও ব্যবসার হাল ধরেন। তার দুই ভাই কামরুল হক ও আলমগীর কবীরের সহযোগিতায় তারা এখন ৫টি অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরির মালিক। তাদের উৎপাদিত হাড়ি-পাতিল রপ্তানি হচ্ছে পার্শবর্তী দেশ মিয়ানমারে।
উদ্যোক্তাদের মতে, তৈজসপত্রের বাজারে অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের পাশাপাশি স্টেইনলেস স্টিল, মেলামাইন, সিরামিক, কাচ কিংবা প্লাস্টিক পণ্যের প্রতিযোগিতা চলছে। এরপরও রান্নাঘরে পাতিল, কড়াই, কলসসহ অন্তত ২০ ধরনের অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের চাহিদা রয়েছে। তবে তা দিন দিন কমছে। এছাড়া গ্যাস সঙ্কটসহ নানা কারণে এ শিল্পের এখন নাজুক অবস্থা। তবে আশার কথা হলো, অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের জন্য আলাদা শিল্প জোন তৈরি হলে রপ্তানি বাড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
উদ্যোক্তারা জানান, স্বল্প পুঁজিতে অর্থাৎ ৩-৪ লাখ টাকায় ছোট কারখানা গড়ে তোলার সুযোগ থাকায় ২০০০ সাল পর্যন্ত অনেক উদ্যোক্তা এই খাতে যুক্ত হয়েছিলেন। ২০১০ সালের পর থেকে স্টেইনলেস স্টিল, প্লাস্টিক, সিরামিকসহ গৃহস্থালি পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়তে থাকায় অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্রের ব্যবহার কমতে থাকে।
চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইকরামুল হক বলেন, আমার বাবার হাত ধরে এ ব্যবসায় আসলেও আমরা আরও দুই ভাই মিলে এ ব্যবসার সম্প্রসারণ করেছি। আমাদের ফ্যাক্টরিতে ২০ আইটেমের অ্যালুমিনিয়াম পণ্য তৈরি হয়।
‘‘সরকার যদি কোনো শিল্প এলাকায় এ শিল্পের জন্য আলাদা জোন করে দিতে পারে তবে এ শিল্প রপ্তানিখাতেও ভূমিকা রাখবে’’ যোগ করেন ইকরামুল।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৬ সালে মাত্র দুই লাখ টাকা দিয়ে আমার বাবা ব্যবসাটি শুরু করেন। পরে গড়ে তোলেন মেসার্স শহীদ অ্যালুমিনিয়াম ইন্ডাস্ট্রি। বর্তমানে ফেনীর বিসিক এলাকার ফ্যাক্টরিটি তিনি দেখাশোনা করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে এলাকায় এসব অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা। স্থানীয়দের কাছে এটি অ্যালুমিনিয়াম পাড়া হিসেবেও পরিচিত। মির্জাপুল ব্রিজ পেরিয়ে অ্যালুমিনিয়াম গলিতে প্রবেশমুখে কানে বাজে পাতিলের টুংটাং শব্দ। গলিতে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই রাস্তার পাশে দেখা ভিড সারি সারি অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্রের ছোট ছোট কারখানা।
রাস্তা ও রাস্তার পাশে ছোট ছোট গলিগুলোতে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, কড়াইসহ বহু ধরনের তৈজসপত্র। সদ্য তৈরি করা এসব হাঁড়ি-পাতিল রাখা হয়েছে কারখানার সামনে। মহিলারা কারখানা থেকে তৈরি করা হাড়ি পাতিলগুলো ধুয়ে রাখছে আর শিশুরা তা রাস্তা এবং গলিতে শুকাতে দিচ্ছে।
কথা হয় কারখানায় বানানো হাড়ি পাতিল ধোঁয়ার কাজ করা খতিজা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে কাজ শুরু করি আমরা। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ হাড়ি পাতিল ধুয়ে থাকি। এর বিনিময়ে ১৮০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত পাই।
হাড়ি-পাতিল আনা নেয়ার কাজ করা দিদার বলেন, ধোঁয়া হাড়ি পাতিল শুকাতে দেওয়া এবং আনা নেয়ার জন্য আমরা প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত পাই।
রপ্তানি হচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি পাতিল
অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি হাড়ি, পাতিল ও অন্যান্য সামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। প্রতিবছর প্রায় ১২ কোটি টাকা রপ্তানি করে চট্টগ্রাম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিকরা। প্রতি মাসে গড়ে এক কোটি টাকা পণ্য রপ্তানি করা হয়। পার্শবর্তীদেশ মিয়ানমার ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে রপ্তানি হয় এসব অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী।
আবাসিকে গিলে খাচ্ছে মুরাদপুরের অ্যালুমিনিয়াম শিল্প
‘খলিল মেটাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে প্রথম অ্যালুমিনিয়াম কারখানা গড়ে তোলে। এরপর ‘দাদাভাই’, ‘বাংলাদেশ অ্যালুমিনিয়াম’, ‘হক’ এবং ‘ভূইয়া অ্যালুমিনিয়ামের’ হাত ধরে শুরু হয় এ শিল্পের। ওই সময় গড়ে ওঠে কিছু কারখানাও। ১৯৮৯ সালে ৩৩ জন সদস্য নিয়ে শুরু হয় অ্যালুমিনিয়াম শিল্প মালিক সমিতির। বর্তমানে উৎপাদনমুখী কারখানা আছে ৮০টি। প্রায় ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে এ শিল্পে। তাছাড়া চারিদিকে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠার কারণে অনেকে কারখানা সরিয়ে নিচ্ছেন অন্যত্রও। যারা আগে কারখানা ভাড়া দিয়েছে তারা সে জায়গায় এখন বহুতল ভবন গড়তে চায়। ফলে আলাদা জোন ছাড়া এ শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
সমিতির নেতারা বলেন, ২০১০ সালে চট্টগ্রামে এই খাতের কারখানার সংখ্যা ছিল ১৪২টি। তখন দিনে ২০ থেকে ২২ হাজার কেজি তৈজসপত্র উৎপাদন হতো। সাত বছরের ব্যবধানে এখন কারখানা কমে দাঁড়িয়েছে ১২০টিতে। তৈজসপত্র উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬ হাজার কেজি। এই হিসাবে বছরে ৬০ লাখ কেজি হাঁড়ি-পাতিল, কলসিসহ তৈজসপত্র উৎপাদন হয়। সংখ্যার হিসাবে বছরে ১৮০ কোটি টাকার অন্তত ২ কোটি পিস ছোট-বড় হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, কড়াই, সসপ্যান, বড় হাড়ি উৎপাদন হচ্ছে চট্টগ্রামে। আগে দেশের মোট চাহিদার অধিকাংশ এখান থেকে সরবরাহ করা হতো।
পণ্য উৎপাদনে যত সমস্যা
মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন নামে এক কারখানা মালিক বলেন, গ্যাসের মাধ্যমে অ্যালুমিনিয়াম ইনগট (কাঁচামাল) চুল্লিতে গলিয়ে পাত তৈরি করা হয়। চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসের সংকট রয়েছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় অ্যালুমিনিয়াম পাত তৈরিতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আবার এই খাতে নতুন শ্রমিকও যোগ হচ্ছে না। শ্রমিকের অভাবে কোনো কোনো দিন কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চট্টগ্রামে কারখানা টিকেয়ে রাখতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমার তিনটি কারখানা ছিল, এখন আছে মাত্র একটি।
স্প্রিনিয়ার মেশিন থেকে হাড়ি তৈরি করার কারিগর মোহাম্মদ মাহফুজ বলেন, ১৯ বছর ধরে এ কাজ করছি। আগে উৎপাদন বেশি হলেও এখন কিছুটা কমে গেছে। আবার নতুন কারিগর এ শিল্পে না আসার কারণে আমাদেরও উপর চাপও বাড়ছে।