আয়-রোজগারহীন! এক বিলিওনিয়ারের কাহিনী
তার নাম জেসমিন আক্তার ওরফে জেসমিন প্রধান। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যমতে বয়স ২৩, আর পাসপোর্ট অনুসারে ২৫। নিজের আয়ের কোনো উৎস নেই। অথচ বিভিন্ন ব্যাংকে তার আছে ৪৪টি হিসাব। এক এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেই আছে ৩৪টি এফডিআর। সেসব হিসাবে তাঁর জমা আছে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকারও বেশি।
জেসমিন শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় 'লীলাবালি' নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার নিজ ও প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে ২০১২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত মোট ১৪৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা জমা হয়। পরে এসব হিসাব থেকে ১৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। নগদে তুলে নেওয়ার পর এসব অর্থ কোথায় গেছে তারও কোনো সূত্র নেই।
এত বিপুল পরিমাণ অর্থ জেসমিন কোথা থেকে পান! স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে কৌতূহল জাগে। তবে এখন জানা যাচ্ছে, এই অর্থের উৎস তার ভগ্নীপতি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
২০১২ সালে জেসমিন নাবালিকা থাকাকালেই ইউসিবি ব্যাংকের কর্পোরেট শাখায় তার নামে প্রথম হিসাব খোলা হয়। তারপর আরও ৪৩টি হিসাব খোলা হয়েছে তার নামে, বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন সময়ে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান দলের তথ্য পাওয়া এসব তথ্য যাচাই বাছাই করে কমিশন মনে করছে, বোন সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ সেলিনা ইসলামের ও ভগ্নিপতি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের অবৈধ সম্পদ স্থানান্তর ও রূপান্তর করে বৈধতার জন্য জেসমিনের নামে এসব ব্যাংক হিসাব খোলা হয়।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই ও বিশ্লেষণ করে দুদক দেখেছে, পাপুল, তার স্ত্রী ও তাদের মেয়ের ওয়াফা ইসলামের ব্যাংক হিসাব থেকেও জেসমিন প্রধানের হিসাবগুলোতে টাকা জমা হয়েছে। এরপর সেখান থেকে তা তুলে নেওয়া হয়েছে।
জেসমিনের নামে জমা থাকা ৩৪টি এফডিআরের দুই কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৭ টাকার বৈধ উৎস দুদককে তিনি দেখাতে পারেননি এবং তিনি তা আয়কর নথিতেও প্রদর্শন করেননি।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে দেখা যায়, জেসমিন তাঁর নামে থাকা ২০টি এফডিআরের ১ কোটি টাকা, সেলিনা ইসলামের ২৯৫টি এফডিআরের ২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, পাপুল ইসলামের ২৩ টি এফডিআরের ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং বোনের মেয়ে ওয়াফা ইসলামের নামে থাকা ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা সহ মোট ২৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা দেখিয়ে ২৫ কোটি ২৩ লাখ টাকার ওভারড্রাফট সুবিধা নেন।
দুদক তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন পাপুল ইসলাম। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে জেসমিন ওইসব অর্থের গন্তব্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তাই ওই অর্থ পাচার হয়েছে বলে দুদক মনে করছে।
দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেওয়ার পর কমিশন উল্লেখিত চারজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয়। আজ বুধবার (১১ নভেম্বর) জেসমিন প্রধান, কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল, সেলিনা ইসলাম ও ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে সংস্থাটি।
দুদকের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সুত্র জানিয়েছে, এ মামলার পর কিছুদিনের মধ্যে পাপুল ও তাঁর সহযোগীদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে মামলা হতে পারে। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান শেষ করে এনেছে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহে তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ দিয়ে সম্পদের হিসাব চাওয়া হবে। পাপুল, তার স্ত্রী, কন্যা, শ্যালিকা, সহযোগী কাজী মো. জামশেদ কবির (বাকী বিল্লাহ), ইসমাইল হোসেন খোকন, আলতাফ হোসেন হাওলাদারসহ অন্য অভিযুক্তদের কাছে সম্পদের নোটিশ দেওয়া হবে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, দেশের ভেতরে পাপুলের নামে এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ কোটি টাকার স্থাবর ও প্রায় ৬১ কোটি টাকার অস্থাবরসহ প্রায় ১৫১ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। তিনি মানব পাচারসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে এ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে দুদক।
সেলিনা ইসলামের নামে ১৫৯ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। এই সাংসদ দম্পতির মেয়ে ওয়াফা ইসলাম একজন শিক্ষার্থী হলেও তার নামে ২৪ কোটি ২৯ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। পাপুলের শ্যালিকা জেসমিনের নামে দুই কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৭ টাকা এফডিআর পেয়েছে কমিশন, যার বৈধ কোনো উৎস তিনি দেখাতে পারেননি।
পাপুলের সহযোগী জামশেদ কবিরের প্রায় ১৫ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের তথ্য আছে দুদকের হাতে। ইসমাইল হেসেনের সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি টাকারও বেশি। আলতাফের সম্পদ আড়াই কোটি টাকারও বেশি। এ তিনজন পাপুলের মানব পাচারের সহযোগী বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেও তাদের সম্পদ থাকার বিষয়ে দুদকের হাতে তথ্য আছে।
মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে চলতি বছরের ৬ জুন পাপুলকে কুয়েত সিআইডি গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি এসব কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
পাশপাশি কুয়েতি কর্মকর্তাদের কাছে অবৈধ ভিসা এবং ঘুষ বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়টিও স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন, বলে দেশটির গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে কুয়েতের আদালতে এমপি পাপুল এবং অন্যান্য অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয়েছে। ইতোপূর্বে মানব ও মুদ্রা পাচার, ঘুষ প্রদান এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলার অভিযোগ এনে দায়ের করা এই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার আর্জি করেছিলেন পাপুল। তবে আদালত সেই আর্জি নাকচ করে দেন ।