উপকূলীয় ভূমিক্ষয় যেকারণে বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চ বিপদ সংকেত
কদবানু যেখানে থাকেন, সেখানে গাড়ি করে যাওয়ার কোন পথ নেই...
তিনটি সরু বাঁশের সাঁকোয় ভারসাম্য রক্ষার কসরত শেষে পৌঁছাতে হয় সরু পথে, এখানেই কদবানুর অস্থায়ী কুঁড়েঘর। ঘরটি এতই সংকীর্ণ যে, কদবানু যখন উঠে দাঁড়ান- ছাদ ঠেকে যায় মাথায়। তবু এইতো তাঁর মাথাগোঁজার একমাত্র ঠাঁই।
ছাদের নিচের একাটি তাকে রেখেছেন সামান্য যা সম্বল আজো আছে; থালা, বাটি, চামচ আর জীর্ণ কিছু কাপড়। প্রতিদিন এই তাক থেকে থেকে জিনিষপত্র নামিয়ে ব্যবহার শেষে তা আবার সস্থানে তুলে রাখেন।
'এভাবে আমরা কতদিন আছি? পাঁচ না ছয় বছর?' ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন মধ্যবয়স্কা এ নারী।
চিরকাল এখানে সত্যিই বাস ছিল না তাঁর, জলবায়ু শরণার্থী নাহলে এই দুর্দশায় থাকার কথাও নয়।
উপকূলীয় পটুয়াখালী জেলার লালুয়া ইউনিয়নের যে স্থানে আজ বাস করছেন, বিয়ের পর থাকতেন এখান থেকে ৪০ মাইল দূরে। কিন্তু, সে ভূমি আজ সাগরের গ্রাসে হারিয়েছে। উপকূলীয় ভুমিক্ষয়ের শিকার কদবানু, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছেন সেকারণেই।
তাকটি ধরে দাঁড়িয়ে কদবানু বলেন, 'আমার যে কোন জমি নেই, তাইতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে ঘর বাঁধি। কিন্তু, ইতোমধ্যেই ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে এমন জমিনেই যেতে হয়। তাছাড়া, কেউ কী আমাকে নিজের জমিতে ঘর বাঁধতে দেবে?'
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডসোয়েল: প্রিপেয়ারিং ফর ইন্টারনাল ক্লাইমেট মাইগ্রেশন' শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ায় তিন কোটি ৫৭ লাখ মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়। যা এ অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার এক দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু, প্রতিবেদনটি আরও বলেছে, অভ্যন্তরীণ জলবায়ু শরণার্থীদের ৩০ শতাংশই হবে বাংলাদেশের।
চলতি বছর বা ২০২১ সালের গ্রাউন্ডসোয়েল প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব আরও করুণ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে, এবারের প্রতিবেদনে আরও বেশি বা ৩৭ শতাংশ বাংলাদেশির অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হওয়ার ভয়ানক তথ্য যুক্ত হয়েছে।
তাই কদবানু একাই জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্দশায় আছেন, আর বাকিরা রক্ষা পাবেন এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। জাতিসংঘ মহাসচিব নিজেই বলেছেন সে কথা। চলতি বছরের আগস্টে প্রকাশিত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যানেল (আইপিসিসি)- এর ল্যান্ডমার্ক প্রতিবেদনকে আন্তোনিও গুতেরেস 'মানবজাতির জন্য কোড রেড' বা অন্তিম বিপদ সংকেত বলে মন্তব্য করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ, ইতোমধ্যেই আমাদের ব্যবসা থেকে শুরু করে পর্যটন, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রায় সব খাতে এ দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাবগুলো অনুভূত হচ্ছে।
কুয়াকাটার উপকূলীয় ভূমিক্ষয়:
মাত্র এক বছর আগেও কুয়াকাটা সৈকতে কিংস হোটেল নামের একটি পান্থশালা ছিল। পর্যটন মৌসুমে অতিথির ভিড়ে রমরমা ব্যবসা করতো প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু, উপকুলীয় ভূমিক্ষয়ে ভেঙেছে সৈকত, এক সময়ের সেই জনপ্রিয় হোটেলের এখন আর মাত্র দুটি পিলার অবশিষ্ট আছে, বাকিগুলো হারিয়েছে সমুদ্র গর্ভে।
তবে হোটেলটির ম্যানেজার শওকত ইসলাম গত বছরই খুব শিগগির কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কা করেছিলেন, তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণীই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। গত মে'তে শক্তিশালী সাইক্লোন ইয়াশ আঘাত হানার পরই তিনি কুয়াকাটা ছেড়ে চলে আসেন।
কিংস হোটেলের মালিক এ বি এম শহিদুল ইসলাম জানান, উপকূলীয় ভূমিক্ষয়ে তাঁর ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। 'এরমধ্যেই হোটেলটি আমি বেশ কয়েক বার নতুন করে নির্মাণ করেছি। প্রতিবছর আমাকে মেরামত কাজ করতে হয়, কিন্তু কোন সমাধান হয়নি। এখন কেনা জমিটুকুও হারিয়েছি,' বলছিলেন শহিদুল।
ভাঙন রোধে কুয়াকাটায় একটি বাঁধ নির্মাণ করা হবে, তবে শহিদুল ইসলাম মনে করেন, জিরো পয়েন্টে জরুরিভাবে আরেকটি অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করা হলে কুয়াকাটাকে কোনভাবেই রক্ষা করা যাবে না।
শহিদুলের সাথে একমত পোষণ করে স্থানীয় হোটেল মালিক সমিতির মহাসচিব মোতালেব শরীফ বলেন, ' একটি বাঁধ দিয়ে কুয়াকাটাকে রক্ষা করা যাবে না। শুধু চলতি বছরেই আমরা শত ফুট ভূমি উপকূলীয় ভাঙনে বিলীন হতে দেখেছি। এভাবে চলতে থাকলে আর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে কুয়াকাটার চিহ্ন মাত্র থাকবে না।'
তিনি বলেন, 'এরমধ্যেই পর্যটকরা কুয়াকাটায় আসার আগ্রহ হারিয়েছেন। ভাঙন রোধে দেওয়া জিও ব্যাগগুলি দেখতে ভীষণ কদাকার হওয়ায় দৃষ্টি-নান্দনিকতা নেই আর। এখন কেউই সৈকতে হেঁটে আনন্দ পান না। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ চেষ্টা এখানে ভুলভাবে ও অত্যন্ত ধীর গতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু, ভাঙনের গতি দিন দিন বাড়ছেই।'
'এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই পর্যটকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, আমাদের ব্যবসা সংকুচিত করেছে।'
লোনাপানির অনুপ্রবেশ, উপকূলীয় ভাঙন সৃষ্ট দুরাবস্থা:
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতেও প্রভাব কোন অংশেই কম পড়েনি। চলতি বছরের এপ্রিলে বরিশালে ডায়রিয়া মারাত্নক আকার ধারণ করে। সাধারণত বন্যা বা ভারি বৃষ্টিপাতের পর ডায়রিয়ার এমন প্রকোপ দেখা দিলেও, ওই সময়ে বনা বা বৃষ্টির আধিক্য কোনটাই ছিল না।
লালুয়া ইউনিয়নের সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডা. সগীর হোসেন ব্যাখ্যা করে বলেন, 'প্রথমে আমরা সমস্যা ধরতেই পারছিলাম না। কয়দিন পর লক্ষ্য করলাম কোন কারণ ছাড়াই রাবদা নদীর লবণাক্ততা বেড়েছে। স্থানীয়রা মিঠা পানির জন্য এ নদীর ওপর নির্ভরশীল হওয়ায়, তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।'
গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রাও দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়েছে।
গ্রাউন্ডসোয়েল রিপোর্টের দ্বিতীয় পর্বে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াল বাড়বে। এজন্যই ঋতু চক্রে আমরা ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। গ্রীষ্মকাল আরও উষ্ণ ও দীর্ঘ হয়ে উঠেছে; শীতকালও উষ্ণ হচ্ছে, অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেড়েছে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময়।
বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের - এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'অস্থির ও অনিয়মিত আবহাওয়া পরিস্থিতি রোগব্যাধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।'
পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি মানুষের মধ্যে নানান ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতার সৃষ্টি করে, ইতোমধ্যেই উপকূলীয় কিছু উপজেলায় তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এনিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে দাকোপ ও মংলা এলাকায় নিজের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ রহমান রানা।
'পাঁচ বছর আগেও এ অঞ্চলে এত বেশি বিকলাঙ্গ মানুষ ছিল না। আমার পর্যবেক্ষণ অনুসারে এখন এসব এলাকায় প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। এই অবস্থায় গর্ভবতী মা ও সদ্যজাত শিশুরা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।'
উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমনিতেই অনুপস্থিত প্রায়, শিক্ষার মতো আরেকটি মৌলিক সুবিধার উদ্যোগও এখানে তেমন চোখে পড়ে না। তাছাড়া, প্রতিবার কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানার পর, স্কুল ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিত্যাক্ত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। স্কুল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মিলে কার্যকর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। উপকূলের খুব সীমিত সংখ্যক বিদ্যালয় দেখে আসলে তা সচল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে মনে হয়।
ভয়াবহ বন্যা বা ভাঙনের কারণেও অধিকাংশ সময়ে এসব অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়। ফলে ছাত্র ঝরে পড়ার সংখ্যাও বেড়েছে।
'২০১৮ সালেও আমার স্কুলে আড়াইশ জন শিক্ষার্থী ছিল। এখন সে সংখ্যা কমে ১৮০ জনে নেমেছে। পর পর দুইবার স্কুলের স্থান পরিবর্তনের পর অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। ভাঙন আবারো নতুন স্কুলের কাছে চলে এসেছে, নতুন বিদ্যালয়টিও বিলীন হবে।'
'আগামী বছর বা তার পরের বছর স্কুলের বর্তমান জমি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এরপর কোথায় স্কুল সরিয়ে নেব, নিলেও কতজন ছাত্র থাকবে- আমি তার কিছুই জানি না'- অনিশ্চিত সুরে বলছিলেন ঝাঁপা ব্রজবিহারী ইউনাইটেড হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বজেন্দ্রনাথ রাপতান।
ঝাঁপা স্কুলটি একেবারে তীরের কিনারে অবস্থিত হলেও বেশকিছু ছাত্র এখনও সেখানে পাঠগ্রহণে অংশ নিচ্ছে।
সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের গাবুরা মিজানিয়া দাখিল মাদ্রাসা গত এক বছর ধরে বন্ধ। কোন জোয়ার বা বন্যা ছাড়াই এটি এখন যখন-তখন প্লাবিত হয়ে পড়ে। ফলে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী ও ১০ জন শিক্ষক নিয়ে অনিশ্চিত সময় পার করছেন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান। মাদ্রাসার জমি থেকে কবে পানি সরবে জানা নেই তাঁর।
কদবানু, শহিদুল, খলিলুর ও বজেন্দ্রনাথ এমন মাত্র চার জন বাংলাদেশির উদাহরণ জলবায়ু বিপর্যয়ের ভয়াল পরিণতি যাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কেউ একটু খুঁজলেই দেশজুড়ে এমন লাখ লাখ মানুষের সন্ধান পাবেন। শুধু সত্য অনুসন্ধানের দৃষ্টি ও আগ্রহ থাকাই সেজন্য যথেষ্ট।