উপাচার্যে বিশ্বাস নেই বুয়েট শিক্ষার্থীদের
সময়টা ছিল ২০১৭ সাল। জীবনযুদ্ধের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভর্তি হয়েছিলেন আসাদ উদ্দিন। স্বপ্নের এই পথচলা থেকে যে তিনি সহসাই ছিটকে পড়বেন, সেটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি আসাদ।
প্রথম বর্ষে থাকতেই একদিন আসাদের ডাক পড়লো হলের সিনিয়র শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাদের কক্ষে। র্যাগের নামে সেখানে সারারাত তার ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আসাদ একবারের জন্যেও বুঝতে পারেননি, ঠিক কোন অপরাধে তাকে এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
ভাবনার এই দোলাচলে যখন কাউকেই পাশে পাচ্ছিলেন না, তখন আসাদ ঠিক করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বিচার দেবেন তিনি। তার ওপর চালানো নির্যাতনের জন্য দায়ীদের শাস্তি দাবি করবেন। তবে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘একচোখা’ নীতি আসাদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় আসাদের দেওয়া অভিযোগ তদন্তও করে দেখেনি, দেয়নি তাকে বিচারের ভরসা। ফলে পরবর্তীতে ফের নির্যাতিত ও নিপীড়িত হওয়ার শঙ্কা থেকে নিজের স্বপ্নের বুয়েট ত্যাগ করতে বাধ্য হন আসাদ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, “আমি আমার শিক্ষকদের কাছে সাহায্য এবং ন্যায় বিচার চেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরা আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমার জন্য কিছুই করতে পারবেন না তাঁরা।”
আসাদ বলছেন, বুয়েটের শিক্ষকরা ছাত্রলীগের নেতাদের ভয় পেতেন, তাই অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতো না প্রশাসন।
এক সপ্তাহ আগে ৬ আগস্ট রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ছাত্র আবরার ফাহাদ যখন হলেরই ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে খুন হন তখন হলটির প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল খান। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত বুধবার (৯ আগস্ট) পদত্যাগ করেন তিনি। তিনিও বলছেন, ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে তারা কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেন না কারণ ক্যাম্পাসে তারা (ছাত্রলীগ) ভয়ের রাজত্ব তৈরি করে রেখেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, বছরের শুরুর দিকে ‘কোন কারণ ছাড়াই’ ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হন তিনি। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘র্যাগিং সংস্কৃতির’ অংশ হিসেবেই তার ওপর এই নির্যাতন চালানো হয়।
ওই শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে, মারধরের বিষয়টি তিনি তার হলের প্রাধ্যক্ষকে জানান, তবে প্রাধ্যক্ষ ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নিজের অপারগতার কথা ওই ছাত্রকে জানান।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে ওই শিক্ষার্থী বলেন, “স্যার আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, তিনি আমার এই বিষয়টি নিয়ে ভিসি স্যারের সাথে কথা বলবেন। তবে তিনি বলেন নি। সেকারণে আমরা এই প্রশাসনের কোন মৌখিক আশ্বাস এখন আর বিশ্বাস করতে পারি না।”
গত সপ্তাহে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে দফায় দফায় মারের কারণে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ মারা যান। আবরারের মৃত্যুর পর ক্ষোভে উত্তাল হয়ে পড়ে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে তাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম।
শুক্রবারের এই আলোচনায় সবার উপস্থিতিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি এবং শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন উপাচার্য।
পাশাপাশি আবরার হত্যায় জড়িত ১৯ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার ঘোষণাও দেন তিনি।
এরপর শিক্ষার্থীরা আরও ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
বুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র তিথি নামে এক শিক্ষার্থী জানান, উপাচার্যের কাছ থেকে আসা ‘মৌখিক আশ্বাসের বাণী’ তারা বিশ্বাস করে না। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ‘লিখিত সিদ্ধান্ত’ চান।
টানা ছয়দিনের আন্দোলনে অংশ নেওয়া এই শিক্ষার্থী বলছেন, শুক্রবারের বৈঠকে উপাচার্য যা বলেছেন, সেটাও তারা ‘বিশ্বাস করেন না’।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, “যেহেতু ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো ছাত্রলীগের নির্যাতন এবং উগ্রবাদীতার বিষয়ে এই প্রশাসন কোন ব্যবস্থা এর আগে নেয় নি তাই আমরা তাদের মুখের কথা এখনো বিশ্বাস করছি না।”
বুয়েট সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী বুয়েট ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
শতশত শিক্ষার্থী র্যাগিং এর তিক্ত অভিজ্ঞতা সাথে নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। পক্ষান্তরে, দোষীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘আশীর্বাদ পাচ্ছে’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
সম্প্রতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের র্যাগিং এর তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে পারেন, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক একটি ওয়েবপেইজ খুলেছিলেন। সেখানে ১৬৬টি অভিযোগ জমা পড়ে, যার অধিকাংশই ছিলো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
তবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি) পেইজটি বন্ধ করে দিয়েছে।
এর প্রেক্ষাপটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি নিয়ে উপাচার্যের সাথে বৈঠকে বসেন।
বৈঠকে শিক্ষার্থীরা বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে সরাসরি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
তারা সেখানে দাবি করেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অধ্যাপক মিজানের ছত্রছায়ায় ক্যাম্পাসে সবকিছু করেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের জবাবে অধ্যাপক মিজান বলেন, “আমি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কোন আশ্রয়-প্রশ্রয় দেইনি। আমি শুধুমাত্র ওদের কয়েকটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি।”
তবে ওই মুহুর্তেই তিনি শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দেন যে, এরপর থেকে আর কোন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেবেন না।