এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ: ৬ ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার নেই
সিলেটের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক তরুণী (২০)। এ ঘটনায় শনিবার সকালে মামলা করেছেন তরুণীর স্বামী। তার সামনেই আগের রাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
মামলায় ছাত্রলীগের ছয় কর্মীর নাম উল্লেখ করে ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে মামলা হলেও শনিবার বিকেলে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় সিলেটজুড়ে সমালোচনা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার সকালে এমসি কলেজের সামনে ও নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিকেলে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের বিক্ষোভ করে সংক্ষুব্দ নাগরিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠন।
যেভাবে ঘটনা
শুক্রবার বিকেলে প্রাইভেটকারযোগে নগরীর টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ সুরমা এলাকার এক দম্পতি। সন্ধ্যার দিকে ৫-৬ তরুণ তাদের ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে প্রাইভেটকারসহ তাদের বালুচর এলাকার এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে আসে ওই তরুণেরা। এরপর আটক দম্পতিকে মারধর এবং পরে স্বামীর সামনেই স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়।
পুলিশের কাছে ধর্ষণের শিকার তরুণীর স্বামী জানিয়েছেন, কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ধরে এনে তাদের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে রাখা হয়। সেখানে তাদের দুজনকে মারধর করা হয়। এরপর তাকে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে ওই ৫-৬ জন।
রাতে এই খবর যায় টিলাগড় এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে। তারা প্রথমে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালান। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় সমঝোতার চেষ্টা চলে।
তবে রাত ১০টার দিকে গণমাধ্যম কর্মীরা ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ায় ভেস্তে যায় সমঝোতা ও ধামাচাপার প্রচেষ্টা। রাত সাড়ে ১০টার দিকে কলেজ ছাত্রাবাস থেকে ওই দম্পতিকে উদ্ধার করে আনে পুলিশ। গুরুতর অসুস্থ তরুণীকে ভর্তি করা হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ক্রাইসিসি সাপোর্ট সেন্টারে (ওসিসি)। তবে সমঝোতার নামে সময়ক্ষেপনের সুযোগে পালিয়ে যায় অভিযুক্তরা।
এরপর রাতভর কলেজে ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু দেশি-বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা
শনিবার সকালে ধর্ষিতার স্বামী ৬ ছাত্রলীগ কর্মীর নাম উল্লেখ করে ৯ জনের বিরুদ্ধে শাহপরান থানায় মামলা করেন। মামলার আসামিদের মধ্যে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪ জন এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে থাকেন। বাকি ২ জন বহিরাগত।
শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাইয়ুম বলেন, মামলায় ৬ জনকে সরাসরি জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্য ৩ জনের বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসামিরা হলেন, এমসি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), কলেজ ছাত্রলীগ নেতা এম সাইফুর রহমান (২৮), ছাত্রলীগ নেতা তারেক (২৮), অর্জুন লস্কর (২৫), রবিউল ইসলাম (২৫) ও মাহফুজুর রহমান মাছুম (২৫)।
এছাড়া, রাতে ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ছাত্রলীগ নেতা এম সাইফুর রহমানকে আসামি করে অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করে।
কলেজ বন্ধ, তবু ছাত্রাবাস খোলা কেন
করোনা সংক্রমণের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো বন্ধ রয়েছে এমসি কলেজও। তবে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস বন্ধ থাকলেও এমসি কলেজের ছাত্রাবাস খোলা রাখা হয়েছে এই সময়ে।
এ ব্যাপারে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ বলেন, 'কলেজের গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সুবিধার জন্য ছাত্রাবাস খোলা ছিল। যারা টিউশনি ও ছোটখাট চাকরি করে, তাদের পড়াশোনার খরচ যোগাচ্ছে- তাদের কথা ভেবে আমরা ছাত্রাবাস বন্ধ করিনি। তবে কলেজের ছাত্রাবাস খোলা থাকলেও ক্যান্টিন বন্ধ ছিল। ছাত্রাবাসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা বাইরে খাওয়া-দাওয়া করত।'
ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এ ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে।'
তবে কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই এমসি কলেজ ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের দখলে। ছাত্রদের পাশপাশি অনেক অছাত্রও এখানে আস্তানা গেড়েছে। মাদক সেবন ও ব্যবসা, জুয়ার আসর বসানোসহ নানা অপকর্ম চলে ছাত্রাবাসের ভেতরে। ছাত্রাবাসের ভেতরে অস্ত্রের মজুদ করে রাখারও অভিযোগ রয়েছে।
এই অপকর্ম অব্যাহত রাখতেই বন্ধের সময়েও ছাত্রাবাস ছাড়তে রাজি হয়নি ছাত্রলীগ। কলেজ প্রশাসনও তাদের ছাত্রাবাস ছাড়া করতে পারেনি।
তবে গণধর্ষণকাণ্ডের পর শনিবার ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করে কলেজ প্রশাসন। দুপুর ১২টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ত্যাগ করতে নির্দেশনা দেন তারা। এরপর শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যান।