করোনার প্রকোপের মধ্যেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু
- গত ১৫ দিনেই আক্রান্ত ৬২৩ জন
- ডেঙ্গু রোগীর ৯৭ শতাংশই রাজধানীর
- ২ জন রোগী মৃত্যু ডেঙ্গু সন্দেহে
- ডোর-টু-ডোর সেবা প্রদানের কথা বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা
দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এ বছরের মোট আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর প্রায় ৬৩ শতাংশই আক্রান্ত হয়েছে এ মাসের ১৫ দিনে। জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি সংখ্যক ভর্তি হয়েছে এ মাসে। করোনার এ সংক্রমণের মধ্যে ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ায় ভোগান্তি এবং ভয়ে আছেন নগরবাসী।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৯৭ শতাংশই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। যারা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসারত ছিলেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২৯৯ জন এবং ঢাকার বাহিরে মাত্র ৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসারত অবস্থায় আছেন। এদের অধিকাংশই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বাসিন্দা।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এবং এডিস মশা ধ্বংসে চিরুনি অভিযান চালালেও ডেঙ্গু রোগী কমছে না বরং বেড়েই চলছে। প্রতিদিন সিটি কর্পোরেশনের অভিযানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির মালিকদের জরিমানা করলেও ডেঙ্গু সংক্রমণে ফেলছে না কোনো প্রভাব।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যদি সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ডোর টু ডোর সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা না হয় এবং অধিক সংখ্যক ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেওয়া না হয় তবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৯৯৫ জন। তাদের মধ্যে জুন মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ছয় মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭২ জন আর জুলাই মাসের এ ১৫ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬২৩ জন ডেঙ্গু রোগী।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ২ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রেরিত হয়েছে। যাদের মধ্যে একজন রাজধানীর ধানমন্ডির স্কয়ার হাসপাতালে এবং একজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসারত অবস্থায় ছিলেন।
এরই মধ্যে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বেসরকারী ও সরকারী হাসপাতালে খোলা হয়েছে ডেঙ্গুর জন্য বিশেষ ওয়ার্ড। এসব ওয়ার্ডে শুধুমাত্র ডেঙ্গু রোগীদেরই চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।
সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে এখন (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) ভর্তি আছে ৩০৩ জন ডেঙ্গু রোগী। যাদের মধ্যে ২৯৯ জনই আছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। বাকি ৪ জনের মধ্যে দুইজন খুলনা বিভাগের, একজন ঢাকা বিভাগের এবং আর একজন ময়মনসিংহ বিভাগের।
ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী ভর্তি রয়েছেন কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি আছেন ৬২ জন ডেঙ্গু রোগী।
এছাড়া আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৭ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ২৩ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৭ জন এবং ২০ জন ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
যাত্রাবাড়ি থেকে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসা এক রোগীর অভিভাবক বলেন, "আমাদের বাড়ির ওপর এবং পাশে বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। হয়তো সেখানে পানি জমে মশা হতে পারে। প্রথমে আমার বড় মেয়ের হয়েছিল সুস্থ হওয়ার পর ছোট মেয়েটির আবার ডেঙ্গু"।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি পুরান ঢাকার লালবাগের এক রোগী টিবিএসকে বলেন, "গায়ে প্রচুর জ্বর আর ব্যথা নিয়ে গত তিনদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বাসার আশপাশে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজ চলায় প্রায়ই পানি জমে থাকে। হয়তো সেখানেই এডিস মশা জন্ম নিয়েছে এবং তা দ্বারাই আমি সংক্রমিত"।
সিটি কর্পোরেশন থেকে মাঝে মাঝে 'ফগিং' করা হয় কিন্তু জমে থাকা পানি আর ডোবা নালা পরিষ্কার করা হয় না বলেও জানান তিনি।
নিউ ইস্কাটনের একটি বাড়ির ম্যানেজার নাসির উদ্দিন লোকজন নিয়ে বাড়ির ছাদ ও এর আশপাশ পরিস্কার করছিলেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "সিটি কর্পোরেশন এসে হুট করে জরিমানা করে দিবে কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মীরা যে নিয়মিত পরিস্কার করে না সেটা দেখবে কে? আশপাশের লেক, উন্নয়নমূলক কাজের খোঁড়াখুড়ি আর ময়লা আবর্জনা জমে সেখানে পানি জমে মশার জন্ম নেয়, যার জন্য আমাদের ভুগতে হয়"।
তবে ২০১৮ ও ১৯ সালের চেয়ে ডেঙ্গু এখন অনেক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, "সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গু এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ডেঙ্গু মোকাবিলায় সকল প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের"।
ডিএসসিসি মেয়র আরও বলেন, "ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এখন নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। আমরা আশাবাদী চলমান চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে পারব এবং জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রকোপ হতে আমরা মুক্ত হতে পারব। আমাদের এই অভিযান চলমান থাকবে"।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশতাক হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সিটি থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার জন্য ডোর টু ডোর সেবা প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল সিটির নেই। এজন্য প্রতিটি এলাকা থেকে লোকজন নিয়ে ভলান্টিয়ার প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। শুধু সিটি কর্পোরেশনের লোকজন কিংবা মেয়র নেমে অভিযান করলেই সংক্রমণ কমানো যাবে না"।
ডেঙ্গুর ভাইরাসে ৪টি ভ্যারিয়েন্ট থাকে। যদি আগের বছরের ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তিত হয়ে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসে তবে দেশে ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করতে পারে উল্লেখ করে এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, "ডেঙ্গুর ৩য় ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তিত হয়ে ৪র্থ কিংবা ১ম অথবা ২য় টা চলে আসলে কয়েক লক্ষ লোক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগের ভ্যারিয়েন্ট থাকলে সেটা মানুষের তেমন ক্ষতি করতে পারে না। আমরা এজন্য গবেষণা অব্যাহত রেখেছি; কয়েকদিনেই ফলাফল পাওয়া যাবে"।
ভারতে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে এবং আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে দেশে প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর মারা গিয়েছিলেন ১৭৯ জন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যদি এখনই জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া না হয় তাহলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আর সেটি করোনা মহামারির কারণে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত হওয়া স্বাস্থ্য খাতকে আরও চাপের মুখে ঠেলে দেবে।
এদিকে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন এ পরামর্শ দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে হয়ে থাকে। এ বছর এক হাজার ৫৮৫ জন রোগীর মধ্যে পাঁচজন ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন।