করোনার প্রভাব: কর্মহীন সাত শতাধিক ব্যান্ড শিল্পী, পেশা ছাড়ছেন অনেকে
করোনাভাইরাস বাস্তবতায় সব ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও জনসমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ থাকায় নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ দেশের ব্যান্ড শিল্পীদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্দিন। এই মহামারিকালে বিয়ে, উৎসব, পূজা-পার্বণসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান অনাড়ম্বরভাবে উদযাপন করা হচ্ছে; ফলে ব্যান্ডপার্টি সংশ্লিষ্ট বাদ্যযন্ত্রীদের কাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে।
করোনার কারণে দীর্ঘ আট মাস ধরে তারা সম্পূর্ণ বেকার। এ বছরের দুর্গোৎসবেও কাজ না পেয়ে হতাশ।
করোনাকালে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষকে বিশেষ আর্থিক ত্রাণ সহায়তা দিলেও ব্যান্ডপার্টির বাদ্যযন্ত্রীদের ভাগ্যে তা জোটেনি। এ অবস্থায় খেয়ে না-খেয়ে, ধার-দেনা করে চলছে তাদের সংসার। অভাবের তাড়নায় অনেকেই বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করে এ পেশা ছেড়েছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) অনুসন্ধানে নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ১১০টি ব্যান্ডপার্টির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে এ পেশার সঙ্গে জড়িত প্রায় সাত শতাধিক বাদ্যযন্ত্রী মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
নেত্রকোনা
নেত্রকোনা শহরের সাতপাই, পুকুরিয়া, পূর্বধলা উপজেলার কালডোয়ার, নারায়ণডহর, মোহনগঞ্জ উপজেলার মাঘান, দৌলতপুর বারহাট্টা উপজেলার কাকুরা, আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতি ও রামসিদসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামাঞ্চলে প্রায় শতাধিক ব্যান্ডপার্টি রয়েছে। ছোট-বড় মিলিয়ে একেকটি ব্যান্ডপার্টিতে যন্ত্রীভেদে ছয় থেকে দশজন থাকেন। সে হিসাবে জেলার শতাধিক ব্যান্ডপার্টির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন পাঁচ শতাধকি বাদ্যযন্ত্রী। তাদের অধিকাংশই বংশ পরম্পরায় এই পেশায় এসেছেন। এদের আয়ের ওপর নির্ভর করেন চার হাজারেরও বেশি মানুষ।
জেলা সদরের সাতপাই এলাকার 'ডিজিটাল ব্যান্ডপার্টি'র স্বত্বাধিকারী মোঃ রফিক জানান, 'আমরা সাধারণত যাত্রাপালা, নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠান, ভ্যারাইটি শো, বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের শোভাযাত্রা, র্যালি, নতুন পণ্যের প্রচার, মাজারের মানত আদায়, বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় উৎসব, পূজা-পার্বণ, বিয়েশাদি, হিন্দুদের মঙ্গলাচরণ, শিশুর জন্মের পর মাসিক ব্রত প্রভৃতি আচার-অনুষ্ঠানে যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করে থাকি। কিন্তু করোনায় গত র্মাচ থেকে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে বিধিনিষেধ থাকায় বাদ্যযন্ত্রীরা বেকার হয়ে পড়ছেন।'
শহরের রেলক্রসিং এলাকার ড্রামসেট বাদক সাগর মিয়া বলেন, 'করোনার কারণে ধার-দেনা করে চলছি। এ পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ হাজার টাকারও বেশি ঋণ হয়েছে; এখন বাধ্য হয়ে রিকশা চালাচ্ছি।'
সাগর মিয়ার মতো একই পরিস্থিতিতে পড়ে সাতপাই এলাকার মিন্টু মিয়া, নিধু দাশ, হর কুমার এবং পরিমল দাশও বর্তমানে ইজিবাইক চালাচ্ছেন।
পূর্বধলার কালডোয়ার গ্রামের ক্লারিওনেট বাদক শহীদ মিয়া বলেন, 'প্রতিবছর শারদীয় দুর্গোৎসবে আমরা টানা চার-পাঁচদিনের কাজ পাই। তখন একেকটি দল পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করে। সারা বছর আমরা দুর্গাপূজার অপেক্ষায় থাকি। এ বছর করোনা আমাদের সে আশাকেও ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।'
কিশোর বয়স থেকে ব্যান্ডপার্টিতে বাঁশি বাজান মোহনগঞ্জের আব্দুর রহমান। এক সময় নিজেই একটি ব্যান্ডপার্টির মালিক হয়েছিলেন। ব্যান্ডপার্টি পরিচালনা করেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের সব খরচ জোগাতেন। করোনা পরিস্থিতিতে আয় না থাকায় বাধ্য হয়ে কম-দামে সব বাদ্যযন্ত্র বেচে দিতে হয়েছে তাকে। রহমান বলেন, 'বেকার অবস্থায় বসে বসে খেয়ে বাদ্যযন্ত্র বেচার টাকাও প্রায় শেষ। আগামী দিনগুলোতে কীভাবে চলব, জানি না।'
নেত্রকোনা ব্যান্ডপার্টি সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ গোস্বামী বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি, করোনা পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসন, শিল্পকলা একাডেমি ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে কিছু আর্থিক প্রণোদনা ও ত্রাণ সহায়তা দিলেও এ ক্ষেত্রে ব্যান্ডপার্টির অধিকাংশ শিল্পীরা উপক্ষিত থেকে গেছেন। বর্তমানে জেলার বাদ্যযন্ত্রীরা মানবেতর জীবন পার করছেন।'
এ পেশায় জড়িতদের প্রতি মানবকি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আহবান জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আবদুর রহমান বলেন, 'ব্যান্ডপার্টির শিল্পীদের কষ্টের কথা শুনেছি। অতি দ্রুতই একটি তালিকা তৈরি করে তাদের সহযোগিতা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
ময়মনসিংহ
কাজকর্ম না থাকায় ময়মনসিংহের ব্যান্ডপার্টির শিল্পীরাও অসহায়, মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ময়মনসিংহের 'ন্যাশনাল ব্যান্ড পার্টি'র আকবর মিয়া জানান, এ জেলায় প্রায় দশটির মতো নামি ব্যান্ডপার্টি রয়েছে। এর বাইরে বিচ্ছিন্নভাবেও বাদ্যযন্ত্র পরিবেশন করেন অনেকে। সব মিলিয়ে প্রায় দুইশ মানুষ ব্যান্ডপার্টির সঙ্গে জড়িত।
ময়মনসিংহ শহরের বাগমারা এলাকার 'সুমন অ্যান্ড হামিদ ব্যান্ডপার্টি'র আব্দুল হামিদ বলেন, 'করোনার কারণে কোনো প্রোগ্রাম পাই না। কাজকর্ম ছাড়া কতদিন এভাবে বসে থাকা যায়? তাই নিরুপায় হয়ে এখন ফুটপাতে লেবু, কলা প্রভৃতি বিক্রি করে কোনোরকমে দিন পার করছি। করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবসান না হলে ১২ সদস্যের পরিবারকে বাঁচাতে বাদ্যযন্ত্র ছেড়ে হয়তো স্থায়ীভাবে দিনমজুরির কাজে নেমে পড়তে হবে।'
'জনতা ব্যান্ডপার্টি'র আব্দুল জলিল জানান, আগে বিভিন্ন র্যালি বা মিছিলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গড়ে তিন হাজার টাকা পাওয়া যেত। আর বিয়ে, পূজাসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পাওয়া যেত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। করোনার কারণে আট মাস ধরে সব কাজ বন্ধ, তাই তিনি জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন।
ময়মনসিংহের চরসিরতা এলাকার বাঁশিবাদক বিপ্লব সরকার জানান, তিনি নির্দিষ্ট কোনো ব্যান্ডপার্টিতে কাজ করেন না। যখন যেখান থেকে ডাক আসে, সেই দলের হয়ে কাজে যান। এখন আর কোথাও থেকে ডাক আসে না। তিনি বলেন, 'লকডাউনের সময় স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা পেলেও এখন কিছুই পাচ্ছি না।'
স্থানীয় 'সুমন ব্যান্ডপার্টি'র আইয়ুব আলী জানান, দুর্গাপূজার সময় তাদের চাহিদা বেশি থাকত। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জন্যে এবার তাও ছিল না। এখন বেশির ভাগ ব্যান্ড শিল্পী নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় দিন পার করছেন।
ময়মনসিংহ জেলা কালচারাল অফিসার আরজু পারভেজ বলেন, 'স্বাভাবিকভাবেই আমার সঙ্গে এই শিল্পীদের যোগাযোগ বেশি। অনেকেই তাদের সমস্যার কথা বলেন। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু পারছি, সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি।'