করোনায় চিকিৎসকদের মৃত্যু আবারও বাড়ছে
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের মৃত্যু আবারও বাড়ছে। এপ্রিল মাসের প্রথম ১৬ দিনে মারা গেছেন ১১ জন চিকিৎসক। যেখানে এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬ জন চিকিৎসক। এখন পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪৫ জন চিকিৎসক। তবে এর মধ্যে সরকার ঘোষিত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন মাত্র একজন চিকিৎসক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত সংক্রামক হওয়ায়, হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা (কোভিড সন্দেহভাজন রোগী আলাদা করা বা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা) ও সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহারে গুরুত্ব কমে যাওয়ায় চিকিৎসকের আবারো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যত বাড়বে চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও ততো বাড়বে। কারণ রোগীর নিবিড় সংস্পর্শে আসেন চিকিৎসকেরা'।
ডা. এহতেশামুল হক বলেন, 'এখন পিপিই পরতে অনেক চিকিৎসক গুরুত্ব কম দিচ্ছে। এছাড়া বড় বড় হাসপাতালগুলো ছাড়া অধিকাংশ হাসপাতালে এখনো ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা চালু হয়নি। তাই সার্জারি বা অন্যান্য সাধারণ রোগীদের মাধ্যমেও চিকিৎসকেরা কোভিড পজেটিভ হচ্ছেন। এখন সংক্রমণের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে তাই সব রোগীকে কোভিড রোগী বিবেচনা করে যথেষ্ট সুরক্ষা উপকরণ পরে চিকিৎসকদের চিকিৎসা দিতে হবে'।
এক বছরের ব্যবধানে দেশে এত চিকিৎসকের মৃত্যু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে মন্তব্য করেন ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী।
প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এখন হাসপাতালের ওয়ার্ডে কোভিড রোগীর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। অনেক বেশি ভাইরাল লোডের মধ্যে থাকার কারণে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষিত রাখতে ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভাইরাল লোড কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই ব্যবহারে আরো সতর্ক হতে হবে'।
দেশে করোনায় প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছিল গত বছরের ১৫ এপ্রিল। সেদিন মারা গিয়েছিলেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন আহমদ (৪৭)।
গত বছরের জুন মাসে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসক মারা গেছেন। ২০২০ সালের জুনে মারা গেছেন ৪৫ জন চিকিৎসক। সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে গত ৪ জুন, ওই দিন পাঁচজন চিকিৎসক মারা যান, যা এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার কিছুটা কমে আসে। তবে এ বছরের এপ্রিলে এসে আবার তা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্যমতে, ১৫ এপ্রিলের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সারা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এ পর্যন্ত ২,৯১০ চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ে দেশে ১,৯৯৮ নার্স এবং ৩, ২৯৫ স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছেন মাত্র একজন চিকিৎসক
গত এক বছরে সরকার ঘোষিত ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। মারা যাওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ডা. মঈন উদ্দীনের পরিবার ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।
এছাড়াও কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় সরাসরি জড়িত এমন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রণোদনা হিসেবে পাওয়ার কথা থাকলেও এখনো কেউ সে অর্থ পায়নি।
ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, 'অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্ধ দিয়েছে। কিন্তু তালিকা পাঠাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিলম্বের কারণেই চিকিৎসকেরা প্রণোদনা পাচ্ছে না'।
তিনি আরও বলেন, 'কোভিডের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদনা দেয়াটা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় নয়। ঘোষিত প্রণোদনা না পেলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়লে চিকিৎসায় তার প্রভাব পড়বে। টানা কাজ করতে করতে চিকিৎসকেরা হতাশার কারণে কাজে আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই আমাদের আহ্বান থাকবে চিকিৎসদের উৎসাহিত করতে তাদের যেন ক্ষতিপূরণ ও প্রণোদনার টাকা দ্রুত দেয়া হয়'।