করোনায় মারা গেছেন পুলিশ কর্মকর্তা বাবা: দাফনের সময় অবুঝ সন্তান বলে, আব্বু অসুস্থ!
বরগুনার বেতাগী উপজেলার প্রত্যন্ত ঝোঁপখালি গ্রাম। বৃহস্পতিবার বিকেলের ঝুম বৃষ্টির পর সন্ধ্যা নামতেই চারদিকে সুনশান নীরবতা। হঠাৎ এই নীরবতা ভেঙ্গে দেয় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। এই অ্যাম্বুলেন্সে কফিনে চিরনিদ্রায় রয়েছেন করোনায় মারা যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল খালেক। সদা হাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী ও আদর্শবান এবং কর্তব্যপরায়ণ ওই পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ ঢাকা থেকে বয়ে এনেছে অ্যাম্বুলেন্সটি।
দেশজুড়ে এমনিতেই করোনাভাইরাস আতঙ্ক। তাই পুলিশ কর্মকর্তা খালেকের বাড়িতে নেই পাড়া প্রতিবেশীর ভীড়। নিকট আত্মীয়-স্বজন ছাড়া নেই অন্য কোনো স্বজনও। শেষবারের মতো দেখার আকুতি জানাচ্ছে না কেউ। কবর খনন থেকে শুরু করে দাফনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে দিনের আলোতেই। দাফনের সব প্রস্তুতি কাছ থেকে দেখেছেনে আব্দুল খালেকের একমাত্র ছেলে সালমান ফারসী।
তবু বাবাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করার ঠিক আগ মুহূর্তেও একমাত্র ছেলের চোখে-মুখে নেই শোকের ছাপ। থাকবেই বা কি করে! ছোট্ট এই সালমান ফারসির বয়স তো কেবল ৬! তাই বাবা হারানোর ব্যথা বোঝার কথা নয় তার। বোঝার কথা নয় চিরতরে বাবার আদর, স্নেহ আর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টিও। তাই তো বাবার কফিনের পাশে বসে থেকেও বারবার বলছে- 'আমার বাবা অসুস্থ! বাবা অসুস্থ।'
আব্দুল খালেকের শ্বশুর মোঃ আব্দুল জলীল খন্দকার বলেন, শবে-বরাতে কয়েকদিন আগ থেকে আমার জামাতা খালেক একটু অসুস্থ ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, বুধবার সন্ধ্যার পর আমাদের সবার সঙ্গে ফোন করে কথা বলেন খালেক। আমাদের সবার কাছে তার সুস্থতার জন্য দোয়া চান। এরপর সকালে তার মৃত্যুর খবর পাই আমরা।
স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আব্দুল খালেকের বাড়ি ঝোঁপখালি হলেও পরিবার নিয়ে তিনি বরিশালে থাকতেন। মূলত ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এজন্য তার বাড়িতে আসা-যাওয়া কম হতো। তারপরও যখন বাড়িতে আসতেন, সবার সঙ্গে দেখা করে খোঁজ-খবর নিতেন। অত্যন্ত বিনয়ী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল আব্দুল খালেকের অকাল প্রয়াণে শোকের ছাড়া নেমে এসেছে তার নিজ এলাকায়। মুর্ছা যাচ্ছেন তার সহকর্মীরাও।
২০০৪ সালে কনস্টেবল পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন আব্দুল খালেক। এরপর সহকারী উপ-পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক এই পুলিশ সদস্যের স্ত্রী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
আব্দুল খালেকের শ্যালক মোঃ মহিউদ্দিন বলেন, আমার বোনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে, মেজ মেয়ে ছষ্ঠ শ্রেণিতে। দুজনই অত্যন্ত মেধাবী। দুজনেই পঞ্চম শ্রেণিতে এ প্লাস পাওয়ার পাশাপাশি বৃত্তি পেয়েছে। একমাত্র ছেলে পড়ে নূরানী বিভাগের প্রথম জামায়াতে।
তিনি আরও বলেন, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বরিশাল ভাড়া বাসায় থাকেন তারা। নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাইটুকুও এখন পর্যন্ত গড়া হয়নি তাদের। এরমধ্যে হঠাৎ আমার ভগ্নিপতির মৃত্যুতে ছোট ছোট তিন শিশু সন্তানসহ অনাগত আরেক সন্তান নিয়ে মহা ঘূর্ণিপাকে আমার বোন। আমার বোনের এই কঠিনতম দুর্দিনে বাংলাদেশ পুলিশের নিরবিচ্ছিন্ন সহায়তা খুব প্রয়োজন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার ভোর রাতে মৃত্যুর পর ওইদিন রাত নয়টার দিকে দাফন সম্পন্ন হয় আব্দুল খালেকের। তার জানাজা নামাজে ইমামতি করেন বরগুনা-২ (পাথরঘাটা-বামনা-বেতাগী) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শওকত হাচানুর রহমান রিমন।
জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করেন বরগুনার পুলিশ সুপার মোঃ মারুফ হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোঃ শাহজাহান হোসেন, বেতাগীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব আহসান, বেতাগী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন তপু এবং মরহুমের স্বজনরা। জানাজা শেষে তার স্বজনরা মৃতদেহ দাফন করেন।
এরপর মরহুমের ছেলে-মেয়ে এবং স্ত্রীসহ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এমপি ও এসপিসহ উপস্থিত পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা মরহুমের স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার পাশাপাশি সকল বিপদ-আপদে সব সময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় বরগুনা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মরহুমের পরিবারকে নগদ অর্থসহ খাদ্যদ্রব্য সহায়তা প্রদান করা হয়।
বরগুনার পুলিশ সুপার মোঃ মারুফ হোসেন পিপিএম বলেন, কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। তারপরও কিছু কিছু মৃত্যু গৌরবের। আব্দুল খালেকের আত্মত্যাগ আমাদের ঋণী করেছে। বরগুনা জেলা পুলিশ তার পরিবারের সঙ্গে আছে। বাংলাদেশ পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদও তাদের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে আব্দুল খালেকের পরিবারের পাশে থাকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শওকত হাচানুর রহমান রিমন বলেন, আব্দুল খালেককে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনতাম। অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তার অকাল প্রয়াণে আমরা ব্যথিত। আমি সব সময় তার পরিবারের পাশে থাকব।