কর্ণফুলী টানেল: আগামী বছরই সুড়ঙ্গ পথে চলবে গাড়ি
করোনাভাইরাসে বিদেশি জনশক্তির অনুপস্থিতিতে বড় প্রকল্পের কাজে স্থবিরতার মধ্যেই ব্যতিক্রম কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু-লেন টানেল। সরকারের অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকা দেশের প্রথম এ টানেল নির্মাণে কাজ করছেন চীনের প্রায় আড়াইশ ও দেশের ৬০০ কর্মী।
শুরুর দিকের জটিলতা ও স্থবিরতা কাটিয়ে বেশ গতি পেয়েছে প্রকল্পটি। এ গতি অব্যাহত থাকলে আগামী বছর নদীর তলদেশের ৪৩ মিটার নিচ দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রানলয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমনটা উঠে এসেছে।
আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সম্প্রতি প্রকল্পটির এলাকা পরিদর্শন করে এসেছেন। পরিদর্শন শেষে তৈরি করা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তার সন্তোষ্টির ছাপ।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০২০ সালের মধ্যে কাজ শেষ করতে ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ২০১৫ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কারণে কাজে গতি না আসায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনী অনুমোদন পায় ২০১৮ সালে।
সংশোধিত প্রকল্পে টানেল নির্মাণ বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এতে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার অনমনীয় ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)।
সংশোধনের পরপরই প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি এসেছে বলে জানিয়েছে আইএমইডি।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত প্রকল্পে বরাদ্দের ৬১ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কাজ হয়েছে ৫৪.৩৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ৩.৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দুই টিউবের এ টানেলের একটি টিউবের কাজ শেষ হয়েছে। অন্য টিউবের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের শেষের দিকে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ছোট আকারের ১৯ হাজার ৬১৬টি সেগমেন্টের সমন্বয়ে প্রকল্পের টিউবগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। চীনের কারখানায় এ পর্যন্ত ১৯ হাজার ২০৬টি সেগমেন্ট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রকল্প এলাকায় পাঠানো হয়েছে ১৫ হাজার ৭৮৪ সেগমেন্ট। এর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে ৯ হাজার ৭৮৪টি। এ হিসাবে টানেলের অর্ধেক সেগমেন্ট স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির আওতায় চার লেন টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা প্রান্তে ৫৫০ মিটার ও আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটার চার লেন সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে টোল প্লাজা ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় ৩৮২ একর জমির মধ্যে ৩৬২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ২০ একর জমির অধিগ্রহণ কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
আইএমইডি সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বড় প্রকল্পের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজ করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। এখনো দেশি-বিদেশি শ্রমিকরা রাত-দিন পালা করে কাজ করছেন। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে নির্ধারিত সময়েই টানেল নির্মাণের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।'
জানা যায়, দেশের প্রথম টানেল নির্মাণে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চূড়ান্ত করে সেতু বিভাগ। তখন টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৬০০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থায়নের নিশ্চয়তা না থাকায় সে সময় তা ফেরত দেয় পরিকল্পনা কমিশন।
পরে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিসিসিসির প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ২০১৫ সালের জুনে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৭ হাজার ৭৮৪ কোটি ৬ লাখ টাকা। তবে ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে সে বছরের নভেম্বরে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়।
যা বলছে সেতু বিভাগ
সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগ করা কর্ণফুলী নদীর ওপরের তিনটি সেতু যানবাহনের চাপ সামাল দিতে পারছে না। বাড়তি পলি জমার কারণে এ নদীতে আর সেতু নির্মাণও সম্ভব নয়। যানবাহনের চাপ সামাল দিতে সেতুর পরিবর্তে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, টানেল এলাকায় নদীর প্রস্থ ৭০০ মিটার। আর পানির গভীরতা ৯-১১ মিটার। পানির গভীরতার আরও ১৮ থেকে ৪৩ মিটার নিচ দিয়ে টানেলটি তৈরি করা হচ্ছে।
সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, নদীর পূর্ব তীরে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে যুক্ত করা, চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা এবং চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রাম শহরকে 'ওয়ান সিটি টু টাউন' মডেলে গড়ে তোলার উদ্দেশে প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছিল।
যে সুফল পাওয়া যাবে
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এ টানেল নির্মাণের ফলে নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি পশ্চিম প্রান্তের চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে।
এর ফলে ভ্রমণের সময় ও খরচ কমে আসবে। পূর্ব প্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্ব প্রান্তে পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে।
সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজিকরণ, আধুনিকায়ন, শিল্পকারখানার বিকাশ সাধন এবং পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে এ টানেল বেকারত্ব দূরীকরণসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করেন তারা।
বিভাগের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে ৪০ কিলোমিটার।
এই টানেলে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলবে।