কোভিড-১৯: সংক্রমণ বৃদ্ধিতে নতুন সংকটের শঙ্কা
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শঙ্কায় ফেলেছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনীতিকে। প্রস্তুতি শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার উদ্যোগ থাকলেও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। শঙ্কা তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিয়েও। অন্যদিকে রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ২,৮০৯ জন, যা সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। আইসিইউ বেডের পাশাপাশি অনেক হাসপাতালে সাধারণ বেডের সংকট শুরু হয়ে গেছে। রোগীর চাপ সামলাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো আবার চালু করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
সামগ্রিক পরিস্থিতিকে নতুন সংকট হিসাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সংকট মোকাবেলায় লকডাউন নয় বরং স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর তাদের।
আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের আগের অভিজ্ঞতা বলছে লকডাউনে সুফল পাওয়া যায়না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান অনেক বেড়ে যাওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে। এখন জীবন ও জীবিকার স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চালু রাখতে হবে। মানুষকে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে ও ভ্যাকসিন নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমবে। ইউরোপ ও আমেরিকায় সংক্রমণ বাড়লেও ভ্যাকসিনেশনের কারণে মৃত্যু অনেক কমেছে'।
গত কয়েক মাসে রোগী কম থাকায় কয়েকটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছিলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কোভিড হাসপাতালের বেড কমিয়ে বেশি করে নন-কোভিড রোগীর সেবা দেয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলো তারা। মার্চের শুরুতে বাড়তে থাকা সংক্রমণের কারণে এখন রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৯টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি আছে মাত্র ৫২টি। এর মধ্যে সরকারি ১০টি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি আছে মাত্র ৫টি।
হাসপাতালগুলোতে জেনারেল বেডের সংকট দেখা দিয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য বেড রয়েছে ২৭৫টি, এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ৩৯৩ জন। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৬৩৯টি সাধারণ বেড খালি রয়েছে।
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অদ্যাপক ডা আহমেদুল কবীর টিবিএসকে বলেন, 'রোগীর চাপ সামলাতে আমরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। ধীর সংক্রমণ হারের কারণে আমরা যখন নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন হঠাৎ কোভিড রোগী এত বেড়ে গেলো। এখন যে হারে রোগী বাড়ছে এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যে আমাদের সক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি আসবে। রোগী সামলাতে আমরা আরো বেড বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি'।
কয়েকমাস সংক্রমণ পরিস্থিতি সহনীয় মাত্রায় থাকায় পুনরুদ্ধারের পথে ছিল দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরেছে দেশের প্রায় সব খাত। রপ্তানিও অনেকটা স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে কয়েক মাস ধরে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য-সেবার বাইরে হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং ট্যুরিজম খাতেও গতি ফিরেছিল। তবে করোনা নতুন করে বেড়ে যাওয়ায় আবারো শঙ্কা ভর করছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সহ সভাপতি এম. রেজাউল করিম সরকার রবিন বলেন, 'স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ রেস্তোরাঁ ব্যবসা। সারাদেশে কয়েক লাখ ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। নতুন করে কোভিডের বিস্তৃতি আমাদের শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে'।
তিনি বলেন, 'প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকার পর চালু হলেও এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি সারাদেশের রেস্তোরাঁ ব্যবসা। লোকসান কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে আবার বিপাকে পড়বেন সব রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী'।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'করোনায় আক্রান্তের হার বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা অবশ্যই বাড়ছে। এটি আমাদের রিকভারি আরেকটু কঠিন করেছে। তবে আতঙ্ক যেন না ছড়ায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। কোনো কিছু বন্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক কাজ স্বাভাবিক রেখে মোকাবেলা করতে হবে'।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বরের পর এটিই একদিনে সর্বাধিক মৃত্যুর ঘটনা। বিগত এক বছরে মৃত্যুর এ মিছিলে নাম উঠল ৮ হাজার ৭২০ জনের।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৮০৯ জনের শরীরে শনাক্ত হয় ভাইরাসটি। এ সময়ে সংক্রমণের হার ছিল ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ।
গত ২০ আগস্টের পর সর্বোচ্চ শনাক্ত হল গত ২৪ ঘণ্টায়। এ নিয়ে মোট শনাক্ত সংখ্যা ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৭।
হঠাৎ সংক্রমণ বৃদ্ধির পর অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য সেক্টরের মতই অনিশ্চয়তায় পড়তে শুরু করেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও আদৌও তা খোলা যাবে কিনা এখনো কেউ নিশ্চিত করতে পারছেনা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, 'বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আমরাও খুব উদ্বিগ্ন। তবে এখন পর্যন্ত ত্রিশ তারিখ স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শিগগিরই একটি মিটিং করা হবে, সেখানেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে'।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'রোগী কমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতালে আবার কোভিড রোগী ভর্তির প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া ১০৫০ বেডের ডিএনসিসি মার্কেট হাসপাতালে কোভিড রোগী ভর্তি করা হবে। এছাড়া অন্যান্য হাসপাতালগুলোকে সামর্থ অনুযায়ী কোভিড রোগীদের জন্য সাধারণ ও আইসিইউ বেড বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে'।
ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, 'প্রস্তুতির তো শেষ আছে। সংক্রমণ রোধে মানুষের সচেতনতা জরুরি। সবাইকে মাস্ক পরে স্বাস্থ্য বিধি মানতে হবে না হলে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে যাবে'।