গাঙ্গেয় ডলফিন ও চার প্রজাতির মাছের জীবনরহস্য উন্মোচন করল বাংলাদেশ
বিশ্বে প্রথমবারের মতো রুই, কালবাউস ও গাঙ্গেয় ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে দেশে প্রথমবারের মতো কাতলা ও মৃগেল মাছের জীবন রহস্যও উন্মোচিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের একদল গবেষকের দীর্ঘ দুই বছরের প্রচেষ্টায় এসেছে এ সাফল্য।
বিপন্ন প্রজাতীর এই ডলফিন এবং কার্প জাতীয় মাছের জিন শনাক্ত করে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন-এনসিবিআই'র ডেটা ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর মিলেছে অনুমোদনও। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের অধিকার।
মঙ্গলবার পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে হালদা নদীর ৪টি কার্প জাতীয় মাছ ও ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করা হয়।
গবেষণা দলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া। জিনোম সিকোয়েন্স এক্সপার্ট হিসেবে গবেষণায় কারিগরি সহায়তা দেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ সিদ্দিকী। এছাড়াও এ গবেষণা কার্যক্রমে নিউজিল্যান্ড ও চীনের দুই গবেষকসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ভেটেরিনারি ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষার্থী রয়েছেন।
অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ সিদ্দিকী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দুই বছরের গবেষণায় হালদা নদীর ৪টি কার্প জাতীয় মাছ ও মিঠা পানির ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রুই, কালবাউস ও গাঙ্গেয় ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করা গেছে। একইসঙ্গে দেশে প্রথমবারের মতো কাতলা ও মৃগেল মাছের জীবন রহস্য উন্মোচিত হলো, এর আগে চীন মৃগেল ও ভারত কাতলা মাছের জিনোম সিকোয়েন্স করেছে।"
তিনি বলেন, "এই গবেষণায় মোট ৮২ হাজার ৭৮৮টি জিন শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে রুই মাছের ১৬ হাজার ৬০৯টি, কাতলা মাছের ১৬ হাজার ৫৯৭টি, মৃগেল মাছের ১৬ হাজার ৬০৭টি, কালবাউস মাছের ১৬ হাজার ৬২০টি ও মিঠা পানির ডলফিনের ১৬ হাজার ৩৬৫টি জিন শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মিঠা পানির ডলফিনের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থানকে উচ্চকিত করেছে।"
গবেষণা দলে নেতৃত্ব দেওয়া হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেন, "হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অত্যাধুনিক পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস একটি খুবই কার্যকর পদ্ধতি। যার ফলে মাছের শারীরবৃত্তীয় গবেষণা সম্ভবপর হচ্ছে।"
"কার্প জাতীয় মাছ যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও হ্যাচারিতে বড় হওয়া মাছের জেনেটিক পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন তুলনামূলক গবেষণার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু ইতোঃপূর্বে বন্য পরিবেশে বড় হওয়া রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশের কোন পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করা হয়নি। তাই, আমাদের এই গবেষণা হ্যাচারি ও বন্য পরিবেশে বড় হওয়া উক্ত প্রজাতিগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইনব্রিডিং সমস্যাসহ পরিবেশগত পরিবর্তন, অসুস্থতা, রোগের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ 'জৈবিক প্রক্রিয়া' খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে," যোগ করেন ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া।
তিনি জানান, মিঠা পানির ডলফিন বা শুশুক আইইউসিএন এর রেডলিস্ট অনুযায়ী বিপন্ন তালিকার জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইতিহাস ও বিস্তার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ভারতের গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোতে এদের বাসস্থান হওয়ার কথা। ভৌগলিকভাবে হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীর অবস্থান অনুযায়ী গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোর সাথে চট্টগ্রামের এই নদীগুলোর কোন সংযোগ নেই। এমনকি অতীতেও সংযুক্ত থাকার কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীতে এই ডলফিনের আগমন, বিস্তৃতি এবং অবস্থান এতোদিন রহস্যাবৃত ছিলো। আজ ডলফিনের এই প্রজাতির (প্লাটানিস্টা গাঞ্জেটিকা) পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে।
অধ্যাপক ড. এএমএএম জুনায়েদ সিদ্দিকী বলেন, "হালদা নদীর ৪টি কার্প জাতীয় মাছ ও মিঠা পানির ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকুয়েন্সিং হওয়ায় এখন এই নদীর ডলফিন কেন মারা যাচ্ছে, এটি তাদের জিনগত সমস্যা কিনা বা কোন ধরনের দূষণে মারা যাচ্ছে তা জানা যাবে।"