জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের কারণে হালদা এক দুঃখের নদী
১৯৪৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। হাটহাজারীর পূর্ব মাদার্শা গ্রামের বাড়িঘোনা এলাকায় হালদা নদীর একটি বাঁক কাটা নিয়ে স্থানীয় কৃষক ও পুলিশের মধ্যে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৩৮ জন মারা যায়। তবে সেদিন পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসীরাই শুধু হত্যার শিকার হননি। নিজেদের অজান্তে গ্রামবাসীরা হত্যা করেছিলো পৃথিবীর বুকে বিরল বৈশিষ্ট্যের নদী হালদাকেও।
প্রায় শতবছর আগে সর্পিল হালদা পূর্ব মাদার্শা গ্রামকে ঘিরে ৮ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বাঁক নিয়ে বয়ে চলছিলো। কিন্তু ভারি বৃষ্টি হলেই নদীর এই বাঁকের কারণে পানি নামতো মন্থর গতিতে, আর এতেই তলিয়ে যেতো নদীর ভাঁটি অঞ্চলসহ দুই তীরের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি।
এছাড়া তৎকালীন সময়ে যাতায়াতের একমাত্র নদীপথেও পাড়ি দিতে হতো অতিরিক্ত ৮ কিলোমিটার পথ। যদিও আড়াআড়িভাবে এই পথের দূরত্ব মাত্র আধ কিলোমিটার।
এই দুর্ভোগ থেকে নিজেদের বাঁচাতে গ্রামবাসী বাড়িঘোনা বাঁকটি কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাদের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন স্থানীয় জমিদার রামকৃষ্ণ মহাজন। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকেও বৈজ্ঞানিক কারণ দেখিয়ে বাঁক কাটার বিরোধিতা করা হয়।
কিন্তু নদী প্লাবিত কৃষি জমি পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর জনগণ এ সিদ্ধান্ত মানল না। গ্রামবাসী বাঁক কেটে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলে জমিদারের পক্ষে অবস্থান নেয় পাকিস্তান পুলিশ, পুরো এলাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। গ্রামবাসী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাঁক কাটতে শুরু করলে গুলিচালায় পুলিশ। স্থানীয়দের হিসেবে ওইদিন পুলিশের গুলিতে নিহত গ্রামবাসীর সংখ্যা অন্তত ৩৮ জন। সরকারি হিসেবে এ সংখ্যা ১০ জন। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে কাটা নদীর সেই অংশকে নামকরণ করা হয় 'শহীদ খাল'।
১৯০৫ সাল থেকে ২০০২ সালের মধ্যে স্থানীয় মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের সুবিধার জন্য হালদা নদীর ১১টি বাঁক কেটে সোজা করে ফেলেছে। যে কারণে হালদা নদী তার সর্পিল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে আর আট-দশটা নদীর মত এখন অনেকটা সরলপথে প্রবাহিত হচ্ছে। এই বাঁকগুলো কেটে ফেলার কারণে নদীর দৈর্ঘ্য ২৫.২৫ কি.মি কমে গেছে অর্থাৎ ১২৩ কিলোমিটার থেকে ৯৭ দশমিক ৭৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।
এইভাবে বাঁক কাটায় চিরদিনের জন্য নিজের গতিপথ পরিবর্তন করে হালদা। এরপর থেকে হালদায় ডিমের পরিমাণ কমতে থাকে। মৎস্য অধিদফতর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৫ সালে হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০০১ সালে ৪৭,০০০ কেজি, ২০১২ সালে ২১,০০০ কেজি এবং এবার ২০২১ সালে হালদায় ডিম মিলেছে মাত্র ৮,০০০ কেজি!
তবে ক্রমান্বয়ে ডিম দেওয়া কমলেও যে বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত, অনুকূল তাপমাত্রা এবং লবন-পানি কম ছিল সে সময় অনেক ডিম পাওয়ার তথ্য রয়েছে। যেমন ২০০৬ সালে প্রায় ৩৩,০০০ কেজি, ২০১৮ সালে প্রায় ২৩,০০০ কেজি এবং ২০২০ সালে ২৫,৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আঁকাবাঁকা বৈশিষ্টের কারণেই পৃথিবীতে হালদা অনন্য। নদীর এই বাঁক গুলোই কার্প-জাতীয় মাছের প্রধান বসতি। এখানেই ডিম দেয় মা মাছ। মানুষ নিজেদের অজান্তে এসব বাঁক সোজা করে ফেলায় মাছের বিচরণক্ষেত্র কমে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম প্রাকৃতিক মৎসাধার।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য মানবসৃষ্ট ১০ টি কারণের অন্যতম হিসেবে গত একশ বছরে ১১টি বাঁক কেটে দেওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ গবেষণায় 'ফিশ বায়োলজি এনালাইসিস' অংশের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রতি বছরের চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে পূর্ণিমা-অমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে হালদা নদীতে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা 'জো' বলে। এই জো এর সময় প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের ফলে হালদা নদীর বাঁকগুলোতে পানি ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। এ সময় নদীর বাঁকে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হলে ও তাপমাত্রা অনুকূলে ২৫-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ।"
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারনে হালদায় বাড়ছে লবণাক্ততা।
এই বছর লবণ ও তাপমাত্রার কারণে মা মাছ ডিম দিতে পারে নি বা যে ডিম দিয়েছে তা নষ্ট হয়ে গেছে। মে মাসের ২৭ তারিখ মা মাছ ডিম দিয়েছিল সেদিন ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক উচ্চতায় জোয়ারের পানি ঢুকলে বৃদ্ধি পায় লবণ। স্বাভাবিকের ছেড়েও ৭৭ গুণ বেশি বেড়ে যায় লবণাক্ততা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্যানুসারে ২৭ মে হালদার পানিতে লবণ ছিল ৩৬.৯ পিপিটি (পার্টস পার থাউজেন্ড) যেটা স্বাভাবিকভাবে থাকে মাত্র ০.৫ পিপিটি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যানুসারে হালদায় ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ লবণ পাওয়া যায় ৪০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২১ সালের মে মাসে পাওয়া যায় ৪০০০ পিপিএম। তবে ঘূর্ণিঝড়ের সময় এই লবণের পরিমাণ বাড়ে অস্বাভাবিকভাবে যেমন ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় লবণের পরিমাণ পাওয়া যায় ১১,৫৫০ পিপিএম।
লবণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মা মাছের ডিম দেওয়া।
ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন,"হালদায় লবনাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম প্রমাণ হলো নদীতে পাতাল নাগিনি সাপের উপস্থিতি। প্রায়ই জেলেদের জালে ধরা পড়ছে পাতাল নাগিনি। এছাড়া লইল্লা চিংড়িসহ সামুদ্রিক কয়েক প্রজাতির চিংড়ি এখন হালদায় মিলছে।"
তিনি বলেন, "নদীর উজানে তিনটি বাঁধ নদীর এক-তৃতীয়াংশ পানি ধরে রাখছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসা দৈনিক ১৮০ মিলিয়ন লিটার এবং সেচ মৌসুমে হালদা প্যারালাল প্রজেক্টের জন্য ২৫০ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তোলন করছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা হয় না। ফলে মিঠা পানির চাপ কমে যাওয়ায় সহজেই কর্ণফুলি নদী থেকে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে, যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।"
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য সেন্টার ফর পিপলস এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর পরিচালক আব্দুর রহমান রানা বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। এখন মা মাছ ডিম দেওয়ার সময় তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপর। অন্যদিকে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং অধিক তাপমাত্রা ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হবার জন্য দায়ী"।
৩টি বাঁধ আর ১৮টি স্লুইস গেইটের কারণে আসছে না ৩৫% উজানের পানি
খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ী র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে হালদা নামকরণ হয়। পাহাড়ি ছড়া থেকে উৎসারিত হয়ে উত্তর-পূর্ব কোণ দিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলায় প্রবেশ করেছে নদীটি। হালদার প্রধান উপনদী ধুরুং। নদীর দুটি ধারাই খরস্রোতা হওয়ায় উজানের পানি দ্রুতই নেমে আসতো ভাটিতে। এ কারণে নদীর পানির সমস্যা দেখা দেয়। এই নদীর সাথে এসে পড়েছে ১৯টি বড় খাল এবং ১৭ পাহাড়ি ছড়া।
স্থানীয় কৃষকদের পানির কষ্ট লাঘব ও আশপাশের অনুর্বর কৃষিজমি চাষাবাদের আওতায় আনতে ২০১০-১১ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (এলজিআরইডি) ফটিকছড়ির ভুজপুরে হালদা নদীর উপর ৪ দশমিক ৫০ মিটার উচ্চতা এবং ১২ মিলিমিটার প্রস্থের রাবার ড্যাম নির্মাণ করে। কিন্তু বর্তমানে এই রাবার ড্যাম হালদা নদী 'ধ্বংসের' অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর এক বছর পর ভুজপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নদীর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হারুয়ালছড়ি খালে আরও একটি রাবার ড্যাম বানানো হয়। নদীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই খাল। একই সময়ে খরস্রোতা উপনদী ধুরুং এ স্থানান্তর করা হয় কংক্রিট ড্যাম। এই তিনটি ড্যামের কারণে এখন বছরে চার মাস হালদার উজানের অন্তত ৬ কিলোমিটার প্রায় পানিশূন্য অবস্থায় থাকে। এছাড়া হালদার ১৯টি সংযোগ খালে ১৮টি স্লুইস গেইট স্থাপনের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত।
কিন্তু এই সব বাঁধ ও স্লুইস গেইট হালদার প্রায় ৩৫% পানি আটকে রাখে।
নগরের অক্সিজেন থেকে কুলগাঁও এলাকার কারখানা ও আবাসিক বর্জ্য খন্দকিয়া খাল দিয়ে নদীতে পড়ছে। এতে নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতির পাশাপাশি হালদার জীববৈচিত্র্যও ধ্বংসের পথে বলে জানান গবেষকেরা।
ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, "হালদা নদীর ২০ শতাংশ পানি আটকে রাখছে ভুজপুরের রাবার ড্যাম। পাশাপাশি হারুয়ালছড়ি ও ধুরুং খালে ড্যামের মাধ্যমে আরও প্রায় ১৫ শতাংশ পানি ভাটিতে আসতে পারছেনা। বাঁধের কারণে নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে রুই ও কালবাউশের প্রধান খাদ্য বেনথোসের উপস্থিতি শূন্যের কোটায়। ফলে হালদায় মাছে সমতা নেই এখন। নদীতে কালবাউশের উপস্থিতি মাত্র ৩ শতাংশ। রুই ৬ শতাংশ, মৃগেল ২০ শতাংশ ও কাতাল ৭০ শতাংশ।"
ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, "মাছের ধর্ম হচ্ছে চৈত্র মাছের শেষে বর্জ্য বৃষ্টি হলে এই নদগুলো বেয়ে একেবারে উজানে যায়। পরে কালবৈশাখী হলে এবং অনুকূল আবহাওয়া পেলে মেয়ে মাছ ডিম ছাড়ে, পুরুষ মাছ ছাড়ে স্পার্ম। পানির টার্বুলেশনে তার ফার্টিলাইজেশন হয়। কিন্তু স্লুইস গেইট দিয়ে মাছের এই আধারগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।"
স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, "ভুজপুরের রাবার ড্যামের কারণে স্থানীয় চা-বাগান গুলো সুফল পাচ্ছে। তবে বড় ক্ষতি হয়েছে নদীর ও স্থানীয় কৃষকদের। রাবার ড্যামটি তিন মিটারের বেশি ফোলানো হলে ভাটিতে পানি প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া এই রাবার ড্যামের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পানি প্রবাহিত হয় না। যা চাষাবাদের তেমন কাজে আছে না।"
কিবরিয়া বলেন, "এ কারণে নদীর পাশের ছড়া খাল থেকেও পানি নেমে আসছেনা। এছাড়া ৪০০ ফুট খালের মুখে ২৫ ফুটের স্লুইস গেট বসিয়ে মূলত খালগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে।"
হালদা বাঁচবে তো?
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন রাবার ড্যাম, বালির বস্তা ও ব্লক, বিভিন্ন স্থানে স্লুইস গেইট এই নদীকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে। একই সাথে নদীর তীরে বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং হাটজারির ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট এই নদী দূষণের জন্য দায়ী।
অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, "আমার যেটুকু ধারণা, হালদাকে কয়েক বছর সুযোগ দিতে হবে। ইতোমধ্যে নতুন করে লবণাক্ততা বেড়েছে। প্রকৃতি সবসময় নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে। আমার ধারণা আজ থেকে পাঁচ বছর পরে মাছ আরও উজানে গিয়ে ডিম ছাড়বে, আস্তে আস্তে তারা পানির সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করবে"।
হালদায় লবণাক্ততা কমাতে নদীর উজানের রাবার ড্যাম অপসারণ ও কাপ্তাই লেক থেকে বেশি পরিমাণে পানি ছাড়ার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।
এদিকে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর রুই জাতীয় মাছের মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ওইদিন হতেই এ নদী সংরক্ষণে ১২টি শর্ত কার্যকর করা হয়। সেগুলোর অন্যতম শর্ত ছিল-
হালদা নদী থেকে কোনও প্রকার মাছ ও জলজ প্রাণী ধরা বা শিকার করা যাবে না। কোনও অবস্থাতেই নদীর বাঁক কেটে সোজা করা যাবেনা। হালদা নদী এবং এর সংযোগ খালের ওপর নতুন করে কোনও রাবার ড্যাম এবং কংক্রিট ড্যাম নির্মাণ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তদারকি কমিটির অনুমতি ব্যতিরেকে হালদা নদীতে নতুন পানি শোধনাগার, সেচ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা যাবে না। নদীর ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয় এমন সব কাজ করা যাবে না। নদীর চারপাশের বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালী সৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমন করা যাবে না। হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৭টি খালে প্রজনন মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) মৎস্য আহরণ করা যাবে না।
এছাড়া ২০১৫ সালে মৎস ও প্রানী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের এক অফিস আদেশে হালদা নদীর গরদুয়ারা বাঁকটি পুনরুদ্ধারের ও অন্যান্য বাঁক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যদিও এখনো কোন উদ্যেগ নেওয়া হয় নাই।
২০০৭-২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে 'হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্প' নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জেলা মৎস্য কার্যালয়।
এ প্রকল্পের আওতায় ২০১০ সালে প্রায় দুই হাজার জেলেকে ঋণ হিসেবে দেড় বছরের জন্য জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে জনপ্রতি দুই মাসের জন্য ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। এই সহায়তা ২০১৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৬০ কেজি করে প্রতি পরিবারকে চাল দেওয়া হয়। এরপর চাল সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়।
২০০৭ সালে হালদা নদীর সত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়।
নদীর উৎপত্তি খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার সালদাছড়া থেকে। সেই উৎসে মানিকছড়ি এলাকায় হালদা নদীর দুই তীরে এক সময় ১০০ একরের বেশি জমিতে তামাক চাষ হতো।
কিন্তু সরকার সেই তামাক চাষীদের পুনর্বাসন করায় বর্তমানে হালদা তীরের তামাক চাষ বন্ধ হয়েছে।
ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, "২০১০ সাল থাকে হালদায় সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ। যার কারণে মাছে অসমতা দেখা দিয়েছে। আগে এখানে সকল মাছ প্রায় সম পরিমাণে ছিল, ব্যালেন্সড ছিল"। তিনি মাছ রক্ষায় এবং সমতা নিশ্চিতে কমিউনিটি বেইজড ফিশিং ম্যানেজমেন্টের কথা বলেন।