জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে হালদার মাছ, সংকটে প্রজনন
হালদায় মা মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবার সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এছাড়াও চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হালদায় লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায়।
মৎস্য অধিদফতর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য মতে, ক্রমান্বয়ে কমেছে হালদায় মা মাছের ডিম দেওয়া।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির 'ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অন আপস্ট্রিম ওয়াটার উইথড্রয়াল টু কনসার্ভ ন্যাচারাল ব্রিডিং হ্যাবিটেট অব মেজর কার্পস ইন দ্য রিভার হালদা' গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সাত বছরে হালদায় ৫ ধরনের মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং ২১ ধরনের বিলুপ্তির পথে।
হালদার ৭৬ প্রজাতির মাছ থেকে ৫ ধরনের মাছ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন। আরো ২১ ধরনের মাছ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না, সেগুলো হালদা থেকে বিলুপ্তির পথে ধরে নিয়েছেন তারা। তবে সেগুলো বিলুপ্ত কিনা সে বিষয় আরো গবেষণার প্রয়োজন বলে তারা জানিয়েছেন। অর্থাৎ নানান বৈচিত্রতায়পূর্ণ হালদায় এখন মাত্র ৫০ ধরনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে।
এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না এমন মাছের তালিকায় রয়েছে- চিতল, গণি চাপিলা, লিলসা, তেলিপাসা, বানি ককসা, কটি, ঢেলা, ঘর পইয়া, চেপচেলা, বোয়ালী পাবদা, টেঙ্গর, গুইজ্জা আঁইর, সিলং, ঘাউরা, বাসতাসি, গাজরা, কইতর পোয়া, বাইলা, নোনা বাইলা, চিরিং, চেওয়া।
হালদা পাড়ের জেলে সুমন জলদাশ বলেন, "পাঁচ পুরুষ ধরে হালদায় মাছ ধরে সংসার চলছিলো। কিন্তু গত ১০ বছরে হালদায় অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে, ডিমও আগের মতো মিলছে না। অন্যদিকে হালদা নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকা অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার। এতে হালদার দুই পাড়ের প্রায় দুই হাজার জেলে বেকার হয়ে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে পূর্বপুরুষের পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছেন অনেকেই। কেউ রিকশা চালায়, কেউবা মজুরের কাজ করছেন।"
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, "রুই মাছের প্রজনন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত স্লুইস গেইট। বাঁধের কারণে নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে রুই ও কালবাউশের প্রধান খাদ্য বেনথোসের উপস্থিতি শূন্যের কোটায়। এ কারণে বর্তমানে হালদা নদীতে কালবাউশের উপস্থিতি মাত্র ৩ শতাংশ। রুই ৬ শতাংশ, মৃগেল ২০ শতাংশ ও কাতাল ৭০ শতাংশ।"
"নদীর সত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত যেখানে প্রজননক্ষেত্র, সেখানেও মাছের খাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। প্রজনন মৌসুমেও মাছের গোনাড পরিপক্কতার জন্য গুনগত মানসম্পন্ন পানি ও প্রচুর খ্যাদ্যের (প্লাংটন ও মাইক্রো বেনথিক অর্গাজিম) প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেখানে প্রজননক্ষেত্র (সত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট), সেখানেও মাছের খাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিযেছে," বলেন হালদা গবেষক কিবরিয়া।
হালদায় হুমকিতে বিরল গাঙ্গেয় ডলফিন
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে বিচরণ আছে অতি বিপন্ন জলজ প্রাণী গাঙ্গেয় ডলফিনের। মা মাছের পাশাপাশি ডলফিনের আবাসস্থল এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
মনজুরুল কিবরিয়া জানান, ভারতের গঙ্গা নদীর পর শুধুমাত্র হালদা ও কর্নফুলী নদীতেই এই প্রজাতির গাঙ্গেয় ডলফিনের দেখা মেলে। কয়েকশ বছর ধরে নিজেদের পরিবেশে থেকে এই ডলফিনটি নিজস্ব বৈশিষ্ট ধারণ করেছে। কিন্তু একসময় হালদায় ১৬৭টি ডলফিন থাকলেও বর্তমানে এ সংখ্যা ১২৭। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত তিন বছরে এই নদীতে মারা গেছে ২৮টি ডলফিন।
২০০৭ সালে নদীর কর্ণফুলীর মোহনা থেকে ফটিকছড়ি নাজিরহাট পর্যন্ত এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে সরকার। ২০১৮ সালে সরকার নদীর সব স্থানে বালুর ইজারা মহাল তুলে নিয়ে বালু উত্তোলন, বালুবাহী ড্রেজার, যান্ত্রিক নৌ চলাচল ও জাল পাতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব নিষেধাজ্ঞা ঠিকমতো কার্যকর হয় না। ফলে আঘাতজনিত কারণে ডলফিন ও মা মাছ মরে ভেসে ওঠার ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন,হালদায় ডলফিনের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। আগে যে হারে ডলফিন ভেসে উঠত, এখন আর তত দেখা যায় না।
অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, "প্রশাসন সক্রিয় হলে এই নদীতে বালুবাহী ড্রেজার চলতে পারত না। সংলগ্ন কলকারখানাও দূষণ ঘটাতে পারত না। তবে সর্বশেষ ছয় মাসে ডলফিন মৃত্যুর ঘটনা নেই।"
লবণাক্ততার কারণে ডলফিনের আবাসস্থল হুমকির মুখে জানিয়ে তিনি বলেন, "গাঙ্গেয় ডলফিন হলো মিঠাপানির জীব। পানি লবণাক্ততা বাড়ায় মা মাছের মতোই ডলফিনও তাদের আবাসস্থল হারিয়ে উজানে চলে যাবে।"
বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর সংযোগস্থল কালুরঘাট পয়েন্টে গত আট বছরে ছয়বার বিপদসীমা অতিক্রম করেছে পানির উচ্চতা। ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৯৮ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় পানির উচ্চতা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সারা বিশ্বে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। এ কারণে হালদা ও কর্ণফুলীতে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ততা। পরিবর্তন আসছে এ দুই নদীর জীববৈচিত্রেও। লবণের কারণে মা মাছ তার চিরায়ত প্রজনন ক্ষেত্র হারিয়ে উজানের দিকে চলে যাচ্ছে।"
সংকটে চট্টগ্রাম ওয়াসা
চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন ১৮০ মিলিয়ন লিটার পানি হালদা নদীর দুটি প্রকল্প থেকে উত্তোলন করে চট্টগ্রাম নগরের প্রায় ২০ লাখ মানুষের মাঝে সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রায়ই তাদের হালদা থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ রাখতে হয়। শুধু তাই নয়, হালদার পানিকে খাবার ও ব্যবহার উপযোগী করতে ৩৭টি টিউবওয়েল দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে মিশ্রিত করে লবণের মাত্রা কমাতে হয়।
বর্তমানে হালদায় লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি মেশানোর পরেও চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে লবণের পরিমাণ ৩৫০ পিপিএম, যা সাধারনত ওয়াসা ২০০ পিপিএমের মধ্যে সরবরাহ করে থাকে। ওয়াসার পানিতে অতিরিক্ত লবণের কারণে প্রায়শই নগরবাসীর মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৮ হালদা নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ এত বেশি বেড়ে যায় যে, চট্টগ্রাম ওয়াসাকে পত্রিকায় সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের পানি পান না করার অনুরোধ জানাতে হয়।
এদিকে হালদায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও পরিবেশবাদীদের আপত্তিতে 'মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানি সরবরাহ প্রকল্প' নিয়ে বিকল্পের দিকে ঝুঁকেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তারা চাঁদপুরের মেঘনা নদী থেকে পানি উত্তোলনের বিষয়ে একটি ধারণাপত্র ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, "সাধারনত ২০০ থেকে ২৫০ পিপিএম লবণ ওয়াসার পানিতে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেশি থাকায় এখন ৩৫০ পিপিএম লবণ সরবরাহ করতে হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। আমরা ভূগর্ভস্থ পানি তোলার বিপক্ষে হলেও পরিস্থিতির কারণে বেশির ভাগ সময় ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে হালদার পানি মিশ্রিত করে বিতরণ করতে হয়।"