জীবন এত সস্তা? চরম অবহেলায় আগুনে নিশ্চিহ্ন হলো ৫২ জীবন
মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে নিরাপত্তা কমিটি গঠনের এক সরকারি নির্দেশনাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করায় নারায়ণগঞ্জে ঘটলো আরেকটি মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড। যেকারণে বৃহস্পতিবার সেজান জুস কারখানায় আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিল আরও ৫২ জনের প্রাণ।
তাজরিন ফ্যাশন ও ট্রাম্পাকোসহ গত কয়েক বছর ধরেই নানা শিল্প কারখানায় ভয়াবহ কিছু অগ্নিকাণ্ড হয়েছে দেশে। যার পেছনে অপর্যাপ্ত অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং এ সংক্রান্ত সরকারি সুরক্ষাবিধি অমান্য করাকেই দুর্ঘটনাগুলোর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে জাতীয় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য ব্রিগে. জে. (অবঃ) আবু নাঈম মো. শহিদুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, কাউন্সিলের পক্ষ থেকে সব কারখানাকে সুরক্ষা কমিটি তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হলেও পোশাকশিল্প ছাড়া অন্যান্য খাতের কারখানা তা প্রতিপালন করেনি।
এর আগে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানা পর্যায়ে বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কিছু ব্যবস্থা নেয়। এ কারণেই পোশাক শিল্পে সুরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হলেও অন্যান্য খাত অবহেলিত থেকে যায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অগ্নি-সুরক্ষা সম্পর্কিত নির্দেশনা সম্পর্কে অসচেতন থাকা কারখানা কর্মীরাও আংশিকভাবে দায়ী বলেও মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় ছয়-তলা সেজান জুস ফ্যাক্টরিতে যখন আগুন লাগে তখন সেখানে ৫০ জনের বেশি শ্রমিক আটকা পড়েন।
ওই কারখানায় কর্মরত ১৭ বছরের এক কিশোরী বেঁচে ফিরেছেন। তাকে চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হাসপাতালের শয্যায় বসে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগুন লাগার পর দুই ঘণ্টারও বেশি সময় আমরা দ্বিতীয় তলায় আটকা পড়ি, বাঁচার জন্য আমরা সিঁড়ির দিকে গেলাম, কিন্তু সিঁড়িতেও দেখি দাউদাউ আগুন। ঘন ধোঁয়ায় আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। অনেক ভয় পাই। মনে হচ্ছিল হয় পুড়ে মারা যাবো, নাহয় দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।"
পরে তারা লোহার গ্রিল ও নেট লাগানো জানালা দিয়েই লাফিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন।
"এক পর্যায়ে, একজন নারী শ্রমিক আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে আমি জানালা থেকে নিচের দিকে পড়ে যাই। আরেকজন যিনি আমার হাত ধরে ছিলেন, তিনিও আমার সঙ্গেই পড়ে যান," এভাবেই দুঃসহ সেই সময়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন রোজিনা।
মুখের চোয়ালে আঘাত পেয়েছেন রোজিনা। ভয়ানক এই আগুন থেকে কীভাবে বেঁচে ফিরলেন, তা-ই ভাবছেন তিনি এখন।
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫২ জন নিহত হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে। এদের মধ্যে ঘটনাস্থলে ৪৯ জন এবং হাসপাতালে ৩ জন মারা যায়। ঘটনাস্থলে মৃত ৪৯ জনের মরদেহ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করতে জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুরুন নবী।
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (অপারেশন এবং মেইন্টেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন টিবিএসকে বলেন, চার ও পাঁচতলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ভবনটি বড় ছিল, এতে জরুরি নির্গমন পথ হিসেবে কমপক্ষে চার থেকে ছয়টি প্রশস্ত সিঁড়ি থাকার কথা। তবে ভবনটিতে মাত্র দুটি সরু সিঁড়ি ছিল। আতঙ্কিত কর্মীদের অনেকেই সিঁড়ি দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করার সময় আগুনের লেলিহান শিখার কবলে পড়েন।"
"কারখানার বিভিন্ন তলায় আমরা রাসায়নিকসহ বিভিন্ন দাহ্য বস্তু পেয়েছি। এসব উপকরণের উপস্থিতিই হয়তো পুরো কারখানাকে মরণ ফাঁদে পরিণত করে। আমরা এ দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করব। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, প্রথমে নিচ তলায় আগুন লাগে, সেখানে প্যাকেজিংয়ের কাগজ ও ফয়েল পেপার মজুদ থাকায় সেখান থেকে তা দ্রুত অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে," যোগ করেন তিনি।
দেবাশীষ বর্ধন আরও বলেন, "ছাদে যেতে পারলে হয়তো অনেক কর্মী কিছুটা নিরাপদ থাকতে পারতেন, তাদের মধ্যে অনেক জনকে হয়তো আমাদের মই দিয়ে উদ্ধার করাও সম্ভব হতো।"
দমকল কর্মী ফাতেমাতুজ রোজিনা টিবিএস'কে জানান, তারা শুক্রবার সকাল থেকেই শুধু লাশের সন্ধান পাচ্ছেন, কিন্তু আর কাউকে জীবিত উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
"চার ও পাঁচতলায় আমরা যা দেখেছি তাকে শুধু গোরস্থানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মাত্র একটি লাশ অবিকৃত অবস্থায় ছিল, বাকিগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে," বলছিলেন তিনি।
"জানালার গ্রিল বাকিয়ে কিছু শ্রমিক বাইরে আসার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। বৃহস্পতিবার রাতে অনেকে আগুন থেকে বাঁচতে নিচে লাফিয়েও পড়েন। লাফিয়ে পড়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে শিরিন শারমিন নামের এক কর্মীও ছিলেন," যোগ করেন ফাতেমাতুজ রোজিনা।
চারটি তদন্ত কমিটি গঠন
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) আজ শুক্রবার জানিয়েছে, এ ঘটনার পেছনে কারো অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
র্যাব মহাপরিচালক জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মামুন শুক্রবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, তদন্তের স্বার্থে ফায়ার ব্রিগেড, জেলা প্রশাসন ও কলকারখানা অধিদপ্তর আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে, যাদের গাফিলতি উঠে আসবে তারা যেই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর বাইরে ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুর্ঘটনার জন্য শ্রমিকদের দায়ী করলেন কারাখানার মালিক:
সেজান জুসের প্যারেন্ট কোম্পানি সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাশেম আগুন লাগার ঘটনায় শ্রমিকদের অসতর্কতার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেছেন, শ্রমিকদের অবহেলার কারণে আগুন লাগতে পারে।
তিনি বলেন, কোনো শ্রমিক সিগারেট খেয়ে সিগারেট না নিভিয়ে ফেলেছে এবং সেখান থেকেই আগুন লেগেছে।
মো. হাশেম ধারণা করেন, নিচতলায় রাখা বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থের কারণে আগুনের ব্যাপকতা বেড়েছে। তিনি বলেন, 'নিচের তলার কার্টন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওপরের তলাগুলোতে বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রপাতি ছিল।'
তবে কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, কারখানাটি শতভাগ কমপ্লায়েন্ট ছিল না।
তিনি জানান, মাত্র এক মাস আগেই তার দপ্তর কারখানা কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিত করতে একটি নোটিশও পাঠায়।
এই দুর্ঘটনার আগে থেকেই কারাখানাটির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছিল এবং বর্তমানে সেই প্রেক্ষিতে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন সৌমেন বড়ুয়া।