দীর্ঘ ১৩ বছরেও নির্মিত হয়নি সিডরে বিলুপ্ত বেড়িবাঁধ
পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় দীর্ঘ ১৩ বছরেও নির্মাণ কাজ হয়নি সিডরে ভেঙ্গে যাওয়া মহিপুরের নিজামপুর ও লালুয়া বেরিবাঁধ। ফলে কৃষিকাজ বন্ধসহ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে এলাকাবাসী।
বর্ষার মৌসুম শুরু হলেও বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করায় দুর্ভোগে ও আতঙ্কে রয়েছে ১০ গ্রামের মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্মাণের আশ্বাস দেয়া হলেও, বাঁধটি নির্মাণ হয়নি আজও।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, অর্থবরাদ্দ পেলে বেড়িবাঁধটি নির্মাণ শুরু করবে তারা। তবে এমন আশ্বাস নয়, কাজের বাস্তব প্রতিফলন চায়- ভোগান্তির শিকার এসব এলাকার বানভাসী মানুষ।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার শিববাড়িয়া নদী, আন্ধারমানিক নদী, পায়রা নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায়; মহিপুরের নিজামপুর, সুধীরপুর, কমরপুর গ্রামের পাঁচ কি.মি.ও লালুয়ার তিন কি. মি. বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয় ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলংকারী ঘূর্নিঝড় সিডরে।
এরপর দীর্ঘ ১৩ বছরেও সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ এ বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ না হওয়ায়, প্রতিদিন জোয়ারে পানিবন্দি হচ্ছে অন্তত বিশ হাজার মানুষ। বছরের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি সময় পানিবন্দি থাকতে হয় এ অঞ্চলের ১০টি গ্রামের বাসিন্দাদের।
ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে লবণ পানি প্রবেশ করায় বছরজুড়ে বন্ধ থাকে কৃষিকাজ। দেখা দেয় গোখাদ্য সংকট। ভেসে যায় পুকুরের মাছ। রাত ঘুম কেড়ে নেয় জোয়ার আতংক। বেকার হয়ে পড়ে সকল- কর্মজীবি মানুষ। চাষাবাদ বন্ধ থাকায় অনেক পরিবারের দিন কাটায় অর্ধাহারে, অনাহারে। ব্যাহত হয় স্কুল-মাদ্রসার শিক্ষার্থীদের পাঠদান। বানভাসী এসব মানুষ পায়না কোনো ধরনের সাহায্য। বিদ্যালয়, মাদ্রাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি কম থাকায় ভেঙ্গে পরেছে শিক্ষা ব্যবস্থা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজামপুর গ্রামের ৩ হাজার ৩৪৫ ফুট দৈর্ঘ্যের ৪৭/১ নং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি অন্তত পাঁচটি অংশ থেকে ভেঙ্গে গেছে। এখন ওই ভাঙ্গা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে ইউনিয়নের নিজামপুর, পুরান মহিপুর ও সুধিরপুর গ্রাম তলিয়ে আছে। এসব গ্রামের বাড়িঘরের উঠোনে এখন দেড় থেকে দুই ফুট পানি জমে আছে।
যে সকল জমিতে কৃষকরা বোনা আউশ চাষ করেছিল তা তলিয়ে গেছে। অধিকাংশ পুকুর ডুবে যাওয়ায় সব মাছ ভেসে গেছে। লবণ পানির কারণে চাষযোগ্য ফসলি জমির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে বাঁধ সংলগ্ন ওই তিনটি গ্রাম। এ অবস্থা চলবে আগামী ৬/৭ মাস।
নিজামপুর গ্রামের বাসিন্দা আশরাফ আলী মৃধা বলেন, 'লবণ পানি হান্দনে চাষাবাদের ক্ষতি যা অইছে, হ্যা কাইট্যা ওডাইতো মুশকিল। হ্যা ছাড়া ঘর-দুয়ার তলাইয়া যাওনে মোগো চলাফেরা করাও কষ্ট অইয়া পড়ছে।'
নিজামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো.শামসুল হক ভদ্র বলেন, জোয়ারের পানি ঢুকে চারিদিক প্লাবিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছেনা। যার ফলে পাঠদান কার্য্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। আমরা কোনো ক্লাশ করতে পারিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা সিদ্দিক মুন্সী, জিয়াউর রহমান অভিযোগ করে বলেন, বঙ্গোসাগর মোহনার আন্ধারমানিক নদীপাড়ের এ বাঁধ প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কারণে ভেঙ্গে বিধ্বস্ত হয়। তখন নতুন করে বাঁধ তৈরি করে দেওয়া হয়। এরপর আইলা, মহাসেনের প্রভাবে সাগর থেকে ফুঁসে ওঠা জোয়ারের পানির চাপে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার মেরামত করে দেওয়া হয়। তবে বাঁধের মাটির কাজ শেষের দিকে যথাযথভাবে করা হয়নি।
গ্রামের বাসিন্দারা অনেকে বলেছেন, সাগর মোহনার এ বাঁধের ওপর সরাসরি জোয়ারের চাপ পড়ে। যার ফলে বাঁধটি দ্বিতীয়-তৃতীয় দফা মেরামতের সময় পুরনো জায়গা থেকে একটু ভিতরের দিকে সরিয়ে করার জন্য বলা হয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড গ্রামবাসীর মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি। যার কারণে বাঁধটি আবার ভেঙ্গে গেছে।
নিজামপুর গ্রামের ইউপি সদস্য সুলতান খাঁ বলেন, 'আমি নিজে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কথা জানিয়েছি। কর্মকর্তারা এসে গত মাসে দেখে গেছেন। তখন তারা বলেছিল জরুরি মেরামত করে দেবে। তখনই যদি তারা তাৎক্ষনিক মেরামতের কাজ করতো, তাহলে আজ এমন অবস্থা হতোনা।'
কলাপাড়া পানিউন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসার (এসও) এবং ওই বাঁধের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.নুরুল হুদা বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ ওই পয়েন্টের মেরামত কাজ অনুন্নয়ন রাজস্ব খাত থেকে করার জন্য একটি প্রস্তাবনা আমরা পানিউন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবরে পাঠিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা আসেনি। তাহলে আমরা কী করতে পারি বলেন। এর মধ্যেই তো ক্ষতি হয়ে গেল।'