দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলা: পুলিশের বক্তব্য
গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় কুরআন অবমাননার অভিযোগের জের ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছে পুলিশ।
যে কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য অথবা গুজব কিংবা উস্কানিতে বিভ্রান্ত বা উত্তেজিত না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে পরিস্থিতির উন্নয়নে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য দেশের সকল নাগরিকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ।
কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সেজন্য সারাদেশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, পুলিশ টহল জোরদার করা হয়েছে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
বুধবার (২০ অক্টোবর) পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ১৩ অক্টোবর রাত সাড়ে আটটায় চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ পৌরসভাস্থ শ্রী ত্রিনয়নী সংঘ রাজা লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়ার মোকিমাবাদ পূজামণ্ডপে ৫০০-৬০০ জন দুষ্কৃতিকারী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা পুলিশের উপর হামলা করে এবং ৫-৬টি পূজামণ্ডপ ভাংচুর করে।
দুষ্কৃতিকারীদের ইট-পাটকেলের আঘাতে ১৫ জন পুলিশ সদস্য মারাত্মক আহত হয়। জনগণের সুরক্ষায় এবং আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলিবর্ষণ করায় এ ঘটনায় ৫ জন প্রাণ হারায় বলে জানানো হয়েছে।
কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গত ১৪ অক্টোবর সকাল ১১.২০টায় নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন ছয়ানী ইউনিয়নের সর্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা মন্দিরে ৮০০- এক হাজার দুষ্কৃতিকারী জড়ো হয়ে উস্কানিমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা অসংখ্য ইট, লাঠিসোটা নিয়ে মন্দিরের সামনে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও বিজিবি'র টহল দলের উপর হামলা চালায় বলে জানানো হয় পুলিশের ওই বিবৃতিতে।
মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর করে মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। এ ঘটনায় একজন প্রাণ হারায় এবং পরবর্তীতে পুকুর থেকে অপর একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
অন্যদিকে, গত ১৭ অক্টোবর রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানাধীন বড় করিমপুর মাঝিপাড়া গ্রামের জনৈক পরিতোষ তার ফেসবুক আইডিতে কাবা শরীফের অবমাননাকর ছবি আপলোড করেছে এমন অভিযোগে প্রায় আটটার সময় এলাকার কতিপয় দুষ্কৃতিকারী ওই গ্রামের একটি মন্দিরসহ ১৮টি পরিবারের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
এছাড়া, কক্সবাজার জেলার পেকুয়া ও চকরিয়া থানা, সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানা, মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ থানা, হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানা এবং গাজীপুর মেট্রোপলিটনের কাশিমপুর থানাসহ দেশের আরও কয়েকটি স্থানে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।
এ সকল ঘটনায় সারাদেশে সাত জন প্রাণ হারায়। এরমধ্যে দুই জন হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং পাঁচ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দায়িত্ব পালনকালে ৫০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয় বলে জানানো হয়েছে।
সংঘটিত এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সারাদেশে গতকাল (১৯ অক্টোবর) পর্যন্ত ৭২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ঘটনার সাথে জড়িত ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া, আরও মামলা রুজু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এসব অপরাধের রহস্য উদঘাটনের জন্য থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটসমূহকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। দ্রুততার সাথে অপরাধের রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তি নির্ভর তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও উস্কানি রোধে সাইবার মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় ওই বিবৃতিতে।
পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং অন্যান্য
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারের সকল গোয়েন্দা সংস্থা সার্বক্ষণিকভাবে কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছে বলেও জানানো হয়।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার যে অভিযোগ উঠে তার জেরে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মণ্ডপ, মন্দির, বাড়িঘর এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়, বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।