দ্বিতীয় লকডাউনে ‘নতুন দরিদ্র’ ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ: জরিপ
দেশব্যাপী সর্বশেষ কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে প্রায় ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ বাংলাদেশের 'নতুন দরিদ্র' জনসংখ্যাতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক একটি জরিপের ফলাফলে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) গত আগস্টে শহুরে বস্তি এবং গ্রাম মিলিয়ে ৪ হাজার ৮৭২ পরিবারের ওপর চতুর্থ ধাপে জীবিকা বিষয়ক জরিপটি পরিচালনা করে।
এর আগের ধাপের জরিপগুলো যথাক্রমে; ২০২০ সালের এপ্রিল, জুন এবং চলতি বছরের মার্চ মাসে করা হয়েছিল।
সমীক্ষা অনুসারে, মার্চে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। গত এপ্রিলে কোভিড-জনিত লকডাউন কার্যকরের পর আরও ৭৯ লাখ মানুষ এতে যুক্ত হয়।
আজ বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) বিআইজিডি ও পিপিআরসি আয়োজিত এক যৌথ ওয়েবিনারে জীবিকা বিষয়ক জরিপটির ফলাফল প্রকাশ করার কথা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে।
জরিপে দেখা গেছে, এ বছরের মার্চের তুলনায় শহরের বস্তি ও গ্রামবাসীর আয় যথাক্রমে; ১৮ এবং ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, যা পুনরুদ্ধার ধারার বিপরীত।
গ্রাম এবং শহুরে বস্তির যেসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার গড়ে কম আয় করলেও দারিদ্রসীমার উপরে ছিল, তারা গত লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিবারের দুই-তৃতীয়াংশই আগস্টে দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করেছে। এদেরকে বাংলাদেশের 'নতুন দরিদ্র' জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আগস্টে জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, বর্তমানে জাতীয় জনসংখ্যার ১৯.৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী "নতুন দরিদ্র"। যা ২০২১ সালের মার্চে অনুমিত ধারণার চেয়ে ৫ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।
মহামারি আসার পর দারিদ্রসীমার উপরে অবস্থানরত অন্তত ২৯ শতাংশ পরিবার দরিদ্র হয়ে পড়ে। তারা এ দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। এটি একটি বড় দুঃসংবাদ, কারণ দীর্ঘমেয়াদী এই দারিদ্র্যের কারণে পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবিকা ব্যাহত হতে পারে এবং তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়তে পারে।
অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ সর্বশেষ লকডাউনের সিদ্ধান্তকে ভালো বললেও প্রায় অর্ধেকই জানিয়েছেন এর ফলে তাদের জীবিকার সংকটের কথা।
স্বল্প-শিক্ষিত ও দরিদ্রদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, তারা প্রত্যাশিত কাজ পাননি। প্রথম লকডাউনে ৪৫ শতাংশ পরিবার সামান্য ত্রাণ পেলেও, দ্বিতীয় লকডাউনে সেটি নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে।
ফলে ফলে, জীবিকার যে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান ছিলো, তা কিছুটা বদলে গেছে এবং আগস্টে মানুষের আয় করোনা পূর্ব সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ কমেছে। কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় তা গ্রামে ১২ শতাংশ এবং শহুরে বস্তিতে ৩০ শতাংশ কম।
তাছাড়া, মহামারির পূর্বে কাজে নিয়োজিত ছিলেন এমন ১০ শতাংশ মানুষ এখনও কোনো কাজ পাননি।
কাজ এবং আয়ের অনিশ্চয়তায় গত ১৮ মাসে মানুষের জীবনযাপনের ঝুঁকি বেড়েছে। জীবনযাপনের জন্য অনেকেই পেশা পরিবর্তনের মাধ্যমে আয়ের চেষ্টা চালিয়েছে। এমনকি তারা তাদের দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন কাজেও নিয়োজিত হতে হয়। যেমন- ইলেকট্রিশিয়ান মতো নানান পেশার ১৭ শতাংশ দক্ষ কর্মী দিনমজুরের মত অদক্ষ কর্মী হিসেবেও কাজ করছেন।
মহামারির আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঋণের পরিমাণ তাদের বাৎসরিক আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ থাকলেও, চলতি বছরের আগস্টে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। অনেক পরিবারে মাংস, দুধ, কিংবা ফল খাদ্য তালিকায় থাকছে না এবং তাদের মাথাপিছু খাদ্যব্যয় মহামারির আগের তুলনায় এখনও কম। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বিশেষত শিশুদের ওপর এমন অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বড় শহরের ব্যয়-নির্বাহ করতে না পেরে গ্রামে কিংবা তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল শহরে চলে যাওয়া ১০ শতাংশ বস্তিবাসী এখনও ফিরে আসেনি।
জরিপে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর দারিদ্র্যের হার মহামারি পূর্ব সময়ের চেয়ে ১৭ শতাংশীয় পয়েন্ট উপরে অবস্থান করছে এবং শহুরে বস্তিতে এই হার ২২ শতাংশ। দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে বর্তমানে শহরের বস্তির ৭৭ শতাংশ পরিবার দরিদ্র, যা উদ্বেগজনক।
বিআইজিডি'র নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইমরান মতিন তার বক্তব্যে বলেন, "আমাদের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পেয়েছি অনেকেই বিভিন্নভাবে পুনরুদ্ধার করেছে এবং মানিয়েও নিয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষত নতুন দরিদ্ররাই রয়েছে, যাদের দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্র্যের কবলে পড়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আমাদের অবশ্যই পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে পড়ার দিকে এখনই নজর দিতে হবে।"
ডঃ হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, "নতুনভাবে সংক্রমনের ঢেউ আসার হুমকি এখনও বিদ্যমান। স্বাস্থ্যসেবা, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার সমন্বয়ে একটি সার্বিক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে, কিছুতেই এ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। কোভিডে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে সামাজিক ন্যায়বিচার একটি মৌলিক প্রশ্ন। কোনো ধরনের নীতি তৈরি না করেই বা সামান্য কিছু সাহায্য করেই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মানুষদের এ অবস্থায় রাখা যাবে না। শহরে বড় আকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, সিএসএমই পুনরুদ্ধারে বাজেটসমৃদ্ধ পরিকল্পনাকে গুরত্ব দিতে হবে। একইসাথে, স্বাস্থ্যসেবায়, শিক্ষায়, যাতায়াতে ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যয়বৃদ্ধিকে মাথায় রেখে সামষ্টিক নীতিমালা তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। শুধু তাই নয়, এর সাথে সাথে টিকাদানের কার্যকারিতা ও সচেতনতা বাড়ানোকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।"