নাঙ্গলকোট রেলওয়ে স্টেশনে দুই হাজার যাত্রীর বিপরীতে মাত্র ৮০টি আসন!
ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের পঞ্চম জনবহুল রেলস্টেশন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট। কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনে থেকে ৩৭ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এ স্টেশনটিতে চার জোড়া আন্তঃনগর ও চার জোড়া লোকাল ট্রেন মিলিয়ে বর্তমানে ১৬টি ট্রেনের যাত্রবিরতি রয়েছে।
সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পূর্বে স্টেশনটিতে ১৮টি ট্রেন যাত্রাবিরতি করত। সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলে দুটি কমিউটার ডেম্যু ট্রেনের যাত্রা এ রুটে বাতিল করা হয়। নাঙ্গলকোট থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে যাতায়াত করা দুই হাজার যাত্রীর জন্য মাত্র ৮০টি আসন বরাদ্দ রয়েছে।
এ স্টেশনে প্রতিদিন পাঁচ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে দুই হাজার যাত্রী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নাঙ্গলকোট স্টেশনে আসেন। যাদের মধ্যে এ উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা, পার্শ্ববতী মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার যাত্রী রয়েছেন।
কিছু সংখ্যক কৃষি ও নির্মাণ শ্রমিকও কাজের উদ্দেশ্যে নাঙ্গলকোট আসেন। নাঙ্গলকোট স্টেশন থেকে প্রতিদিন দুই হাজার যাত্রী আন্তঃনগর ট্রেনযোগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, নরসিংদী ও ভৈরবে যাতায়াত করেন। আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি যান চট্টগ্রামে। আর বাকি এক হাজার যাত্রী লোকাল ট্রেন যোগে কুমিল্লা, ফেনী, ময়মনসিংহ, আখাউড়া, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, নরসিংদী ও ভৈরবে যাতায়াত করেন।
নাঙ্গলকোটে যাত্রাবিরতি দেওয়া আন্তঃনগর ট্রেনগুলো হলো-মেঘনা এক্সপ্রেস, পাহাড়িকা এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস ও চট্টলা এক্সপ্রেসের চারজোড়া ট্রেন। মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি চাঁঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর যাওয়ার নাঙ্গলকোটে যাত্রাবিরতি দেয়।
চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া মিলিয়ে এ স্টেশনের জন্য বরাদ্দকৃত আসন ২০টি। অথচ স্বাভাবিক সময়ে (স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি বন্ধ হওয়ার আগে) নাঙ্গলকোট থেকে মেঘনা এক্সপ্রেসে করে পাঁচশ'র বেশি যাত্রী চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মাঝখানে ফেনী স্টেশনে যাত্রাবিরতি থাকলেও এ স্টেশনের জন্য নাঙ্গলকোটে কোনও টিকিট বরাদ্দ নেই। চট্টগ্রাম থেকে নাঙ্গলকোট হয়ে চাঁদপুর যাত্রাপথে লাকসাম, হাজীগঞ্জ স্টেশনেও যাত্রাবিরতি রয়েছে মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনটির। চাঁদপুরের জন্য বরাদ্দকৃত ১০টি আসন ছাড়া অন্য কোনও স্টেশনের জন্য সিট বরাদ্দ নেই নাঙ্গলকোট স্টেশনে। পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাত্রাপথে বিরতি দেয় নাঙ্গলকোট স্টেশনে। সিলেটের জন্য ১০টি আসন বরাদ্দ থাকলেও মাঝখানে যাত্রাবিরতি দেওয়া লাকসাম, কুমিল্লা, আখাউড়া ও শ্রীমঙ্গলের যাত্রীদের জন্য নেই কোনও আসন। একইভাবে সিলেট হয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে নাঙ্গলকোট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বরাদ্দকৃত আসন ১০টি। মাঝখানে ফেনী স্টেশনের জন্য নেই কোনও আসন। স্বাভাবিক সময়ে নাঙ্গলকোট থেকে পাঁচ শতাধিক যাত্রী স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়ে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস যোগে চট্টগ্রাম ও সিলেটে যাতায়াত করেন। এর মধ্যে তিনশর কাছাকাছি যাত্রী যান চট্টগ্রাম, বাকি যাত্রীদের মধ্যে শতাধিক যাত্রী কুমিল্লা ও একশর চেয়ে সামান্য কিছু কম যাত্রী সিলেটসহ অন্যান্য স্টেশনে যাতায়াত করেন। চট্টগ্রাম থেকে চট্টলা একপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা যাওয়ার পথে এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে নাঙ্গলকোট যাত্রাবিরতি দেয়। আসা-যাওয়া মিলিয়ে সমান ১০টি করে ২০টি আসন বরাদ্দ রয়েছে নাঙ্গলকোটের জন্য। নাঙ্গলকোট থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে হাসানপুর ও ফেনী যাত্রাবিরতি থাকলেও কোনও আসন বরাদ্দ নেই। একইভাবে নাঙ্গলকোট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে লাকসাম, কুমিল্লা, শশীদল, কসবা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, ভৈরব ও নরসিংদী স্টেশনে যাত্রাবিরতি থাকলেও একটিও আসন বরাদ্দ নেই। চট্টগ্রামগামী চট্টলা এক্সপ্রেসের তুলনায় ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেসে প্রায় পাঁচগুণ বেশি যাত্রী হয়। এ ট্রেনে করে নাঙ্গলকোট স্টেশন হয়ে ছয় শতাধিক যাত্রী যাতায়াত করে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনটির জন্যও নাঙ্গলকোটে বরাদ্দকৃত আসন ১০টি। মাঝখানে লাকসাম, কুমিল্লা, আখাউড়া, ভৈরব ও নরসিংদীতে যাত্রাবিরতি থাকলেও কোনও আসন বরাদ্দ নেই।
এছাড়া লোকাল কর্ণফুলী, সাগরিকা, নাসিরাবাদ ও জালালাবাদের চার জোড়া ট্রেনের যাত্রাবিরতি রয়েছে নাঙ্গলকোট স্টেশনে।
এদিকে নাঙ্গলকোটের জন্য আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে বরাদ্দকৃত ৮০টি আসনের সবগুলোই বিক্রি হয় হাতে লেখা সনাতন পদ্ধতিতে। বিভিন্ন স্টেশন ব্যাপক আধুনিকায়ন হলেও নাঙ্গলকোট স্টেশনে নেই কোনও কম্পিউটার। প্রিন্টার না থাকায় অনলাইনেও সিট বরাদ্দ নেই। ফলে নির্ধারিত অল্পসংখ্যক টিকিট ক্রয় করতে যাত্রীদের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। উপজেলার দূরবর্তী গ্রামগুলো থেকে আগে এসে বুকিং দিলেও টিকিট নামক সোনার হরিণের দেখা পাওয়া দু:সাধ্য হয়ে পড়ে। নাঙ্গলকোটের যাত্রীরা অনলাইনে অন্যান্য স্টেশন থেকে আসন নিয়ে যাত্রা করতে হলেও পড়তে হয় দুর্ভোগে। কম্পিউটার না থাকায় টিকিট প্রিন্ট করা সম্ভব হয় না। ট্রেনে উঠলে একটু পরপর হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের।
নাঙ্গলকোটের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানকার মানুষের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাসে যাতায়াতে সময় বেশি ব্যয় হয়। যেখানে ট্রেনে চট্টগ্রাম যেতে দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়, বাসে যেতে সেখানে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টার বেশি। সড়ক পথে সিএনজি অটোরিকশা ও বাসে কুমিল্লায় যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা, ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৪৫-৫০ মিনিট। তাছাড়া নাঙ্গলকোট থেকে মুষ্টিমেয় কিছু বাস ঢাকা-চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তবে এসব বাস খুব পুরোনো, ভাড়া ট্রেনের তুলনায় অনেক বেশি। ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা, উচ্চ শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য নাঙ্গলকোটের অর্ধেকের বেশি মানুষ কুমিল্লানির্ভর। গত কয়েক বছর ধরে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের চারলেনের কাজ শুরু হওয়াতে সড়ক পথে ঢাকা ও কুমিল্লা যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন যাত্রীরা। এর কারণে ট্রেনের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলাল হোসেন জানান,' কম সময়ে চিকিৎসাসহ অন্যান্য সেবা নিতে হলে এ এলাকার মানুষের ট্রেনের বিকল্প নেই। আমরা চাই খুব দ্রুত সকল সমস্যার সমাধান হোক।'
নাঙ্গলকোট রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. জামাল উদ্দিন জানান, 'নাঙ্গলকোট স্টেশনে প্রতিদিন গড়ে ৭০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়। আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, ডিজিটালাইজেশন এবং সবগুলো স্টেশনের জন্য আসন বরাদ্দ হলে আরও ৭০ হাজার টাকার টিকিট বাড়তি বিক্রি করা সম্ভব। ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিলে এ স্টেশন থেকে বছরে আড়াই কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হবে সরকারের। সে সাথে যাত্রীরা হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে।'
নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন কালু বলেন,' নাঙ্গলকোট রেলওয়ে স্টেশনকে ডিজিটালাইজেশন ও আসন বাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। ঊর্ধ্বতন মহলে অনেকবার চিঠি দিয়েও সাড়া পাইনি। আমরা আবার বর্তমান রেলমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবো। নাঙ্গলকোটের যাত্রীদের কষ্ট লাঘবে যেসব প্রস্তাব মন্ত্রী বরাবর উপস্থাপন করা দরকার, সব করবো।'
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক আনসার আলী জানান,' নাঙ্গলকোট স্টেশনের সমস্যার বিষয়টি আমরা অবগত আছি। নতুন করে আসন বণ্টনের সময় নাঙ্গলকোটের জন্য অতিরিক্ত আসন বরাদ্দের বিষয়ে দাবি উত্থাপন করবো।'
ডিজিটালাইজেশনের বিষয়ে তিনি বলেন,' রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ২৬টি স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রাবিরতি দেয়। এরমধ্যে মাত্র সাতটি স্টেশনে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা ও কম্পিউটার সিস্টেম চালু আছে। যেহেতু নাঙ্গলকোট স্টেশনটি জনবহুল, এ স্টেশনটিকেও অনলাইনের আওতায় নিয়ে আসার যৌক্তিকতা আছে। আমি কর্তৃপক্ষের সাথে এটা নিয়ে মিটিং করবো।'