নিরাপদ উৎসের অভাবে নির্ভরতা বাড়ছে বোতলজাত পানিতে
শহরাঞ্চলে নিরাপদ পানির উৎসের অভাবে বোতলজাত পানির ওপর ভোক্তার নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ শতাংশ হারে বোতলজাত পানির ব্যবসা বাড়ছে বলে জানিয়েছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।
বোতলজাত পানির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরাঞ্চলে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাওয়ার পানির উৎস সীমিত হয়ে পড়েছে। ঢাকা ওয়াসা এবং জারের পানিতে নানা ধরনের দূষণের উপস্থিতি উৎস দুটির ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। এই সুযোগেই ব্যবসা বাড়ছে বোতলজাত পানির।
উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৩৫-৪০ কোটি লিটার বোতলের পানি বিক্রি হয়। যা টাকার অংকে ৮৫০-৯৫০ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বছরই বোতলের পানির বাজার বাড়ছে প্রায় ২০ শতাংশ হারে।
যদিও গত বছর করোনায় অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, হোটেল রেষ্টুরেন্ট, বিয়ে শাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় বোতলজাত পানির ব্যবসা ৫০ শতাংশের বেশি কমে যায়। করোনার প্রভাব এখনো থাকলেও পানির ব্যবসা বাড়ছে। এর মধ্যে গরম পড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় স্বাভাবিক গতি আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, 'আমরা যে পানিটা দিচ্ছি, সেটা ড্রিংকেবল ওয়াটার, ড্রিংকিং ওয়াটার না'। এই ড্রিংকেবল ওয়াটার খাওয়ার আগে অন্তত ১০ মিনিট ফুটানোর পরামর্শ দেন তিনি। অর্থাৎ ঢাকার খাওয়ার পানির সবচেয়ে বড় উৎস ওয়াসা হলেও সে পানি সরাসরি খাওয়া যায় না।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে জারের পানির ব্যবসা শহরাঞ্চলে বেশ জমজমাট ছিল। তবে প্রতিনিয়ত নিম্নমান ও ক্ষতিকর বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির প্রমাণ পায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেষ্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে পানির এই উৎসের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।
উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৯০ এর দশকে বাংলাদেশে বোতলজাত পানির ব্যবসা শুরু হয়। সে সময় বোতলের পানির ব্যবহার ছিল আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। পরিস্থিতি বদলে বোতলজাত পানি এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হোটেল রেষ্টুরেন্ট, বাইরে ঘুরতে গেলে, অফিস আদালতের অনুষ্ঠান ও নিয়মিত ব্যবহার, বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে বোতলজাত নিয়মিত ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশে বোতলজাত পানির ব্যবসায় 'মার্কেট লিডার' হিসেবে ব্যবসা করছে পারটেক্স গ্রুপের পানির ব্র্যান্ড মাম। পারটেক্স গ্রুপের এজিএম (ব্র্যান্ড) মো. নাহিদ ইউসুফ বলেন, 'পানির মান ধরে রাখার কারণে বোতলজাত পানিতে মানুষের আগ্রহ ও আস্থা বেড়েছে। করোনার কারণে গত বছর পানির গ্রোথ বাধাগ্রস্ত হলেও চলতি বছরে ভালো ব্যবসা হবে বলে আশা করছি।'
বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশকে বোতলজাত পানির ব্যবসার জন্য ভালো বাজার হিসেবে দেখছে। এর প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে পেপসিকো (অ্যাকুয়াফিনা) ও ২০১৬ সালে কোকাকোলার (কিনলে) মত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বাংলাদেশে পানির ব্যবসায় আসে। এছাড়া মেঘনার ফ্রেশ, প্রাণ-আরএফএলের প্রাণ, ঢাকা ওয়াসার শান্তি, সিটি গ্রুপের জীবন, একমি গ্রুপের একমি ড্রিংকিং ওয়াটারসহ দেশে ৩০ টিরও বেশি পানির ব্র্যান্ড রয়েছে।
বোতলের পানির ব্যবসা বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে প্রাণ আরএফএলের বিপনন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, 'শহরাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির অপ্রাপ্যতাই বোতলের পানির ব্যবসাকে বড় করছে। এছাড়া পানির অন্য যেসব উৎস রয়েছে সেগুলোতে মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না।'
ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে ঢাকার ছোটখাট দোকান ও রেষ্টুরেন্টগুলোতে জারের পানির ব্যাপক প্রচলন দেখা গেলেও এখন খানিকটা কমে গেছে। কারণ এই পানির মান নিয়ে অনেক সন্দেহ তৈরি হয়েছে ভোক্তাদের মধ্যে।
ধানমন্ডির এক বেসরকারী চাকরিজীবি ফরিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'রেষ্টুরেন্টে কোন খাবার খাওয়ার পর সর্বোচ্চ দুই টাকায় দুই গ্লাস পানি খেতাম। কিন্তু এগুলোতে মলমূত্রের জীবাণু পাওয়ার পর থেকে এসব পানি খাওয়া বন্ধ করেছি। প্রয়োজনে ১৫ টাকায় আধা লিটার পানি কিনে খাই।'
শুধু দেশেই না, বিশ্বব্যাপীই দ্রুত বাড়ছে পানির ব্যবসা। এশিয়া, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান দ্য বিজনেস রিসার্চ কোম্পানির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ২০১৭ সালে পানির ব্যবসার পরিমাণ ছিল ২৩৮ বিলিয়ন ডলার এবং পানি বিক্রি হয়েছে ৪৩৭ বিলিয়ন লিটার। গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে ২০২১ সালে বোতলজাত পানি বিক্রি হবে ৬২৩ বিলিয়ন লিটার যার মূল্য ৩৪৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে প্রায় ১০ শতাংশ হারে গ্রোথের কথা বলা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী যেসব কোম্পানি পানির ব্যবসা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে নেসলে, পেপসিকো, দ্য কোকাকোলা কোম্পানি, ড্যানোন, প্রিমো ওয়াটার কর্পোরেশন, ভস ওয়াটার, নংফু স্প্রিং ইত্যাদি।